X
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
৩০ বৈশাখ ১৪৩২

‘ক্ষমা করেছি, কিন্তু ভুলবো না’

প্রভাষ আমিন
২২ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:১০আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:১০

বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত দলটি শুধু বয়সেই বড় নয়, সমর্থনেও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়। টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকায় দলটির জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়েছে বটে, তবে তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা সংগঠনের জোরে অনেক ঝড়ঝাপটা সামাল দিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে দলটি। এই তৃণমূলই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি। স্বাধীনতার আগে-পরে একাধিকবার আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেকেই ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগ বুঝি আর ফিরে আসতে পারবে না। ফিরে আসতে সময় লেগেছে বটে, তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করছে। দল যেমন বড়, তাতে কোন্দলও তেমনি বেশি। সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি সবার প্রশ্নাতীত আনুগত্য, তবু নিজেরা নিজেরা মারামারি-হানাহানিতে পিছিয়ে নেই।

আওয়ামী লীগে কোন্দলের সূত্র ধরেই দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। কোন্দল জর্জরিত আওয়ামী লীগে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনাকে দলের সভানেত্রী করা হয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার ছয় বছর পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তিনি। তার নেতৃত্বেই ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই আর গণতন্ত্রের বন্ধুর পথে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে এনে গণতন্ত্রের দীর্ঘ লড়াইয়ে শেখ হাসিনার মূল শক্তি ছিল তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা সংগঠন আর দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা। শেখ হাসিনা অনেকবারই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি যেমন তার তৃণমূলে বিস্তৃত সংগঠন, তেমনি সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তৃণমূলে বিস্তৃত দলীয় কোন্দল। আওয়ামী লীগের সবাই বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত হলেও তারা ঐক্যবদ্ধ নয়। বড় দলে নেতাও বেশি, তাদের মধ্যে কোন্দলও বেশি। কোন্দল সবসময় থাকলেও তা চাঙা হয় কোনও নির্বাচন এলে। জাতীয় নির্বাচনে ততটা না হলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় কোন্দল দেখা দেয় কদর্যরূপে। বিশেষ করে সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর পর এই কোন্দল আরও দৃশ্যমান হয়েছে। দল তথা শেখ হাসিনার মনোনয়ন দেওয়া প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারাই। এই বিদ্রোহীদের একটা বড় অংশ জয়ও পেয়েছেন। এমনকি কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নাস্তানাবুদ করার দায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের তো আছেই,; আছে তাদের পৃষ্ঠপোষক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, কেন্দ্রীয় নেতা, দলীয় এমপির। এমনকি মন্ত্রিসভার কোনও কোনও সদস্যের দায়ও কম নয়। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, সেটা তো সবাই জানে। এই বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষক কারা, কারা শেখ হাসিনার প্রার্থীকে হারিয়ে দেন, নৌকার জামানত বাজেয়াপ্ত করেন; তা কারও অজানা নয়। এসবই আওয়ামী লীগে ওপেন সিক্রেট।

প্রতিটি নির্বাচনের আগেই এ নিয়ে দলে অনেক নাটক হয়। প্রথমে বোঝানো হয়, ভবিষ্যতে মূল্যায়নের আশ্বাস দেওয়া হয়; তাতেও কাজ না হলে বহিষ্কার করা হয়। আর কখনও দলে ফেরানো হবে না, কখনও মনোনয়ন দেওয়া হবে না; এসব হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব হুমকি-ধমকিতে কোনও কাজ হয় না। কাজ হয় না কেন? এনিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কারণ, বিদ্রোহীরা জানেন তর্জন-গর্জনই সার। জিততে পারলে তো বটেই, না জিতলেও আস্তে ধীরে দলে ফিরতে পারবেন। অতীতে অনেকবারই এ ধরনের বিদ্রোহ, হুমকি, বহিষ্কার এবং ফিরিয়ে আনার ঘটনা ঘটেছে। তাই আওয়ামী লীগের হুমকিকে আওয়ামী লীগাররা একদমই ভয় পায় না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনপূর্ব হুমকি এখন মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের গল্পের মতো হয়ে গেছে। এবারও যখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা তর্জন-গর্জন করছিলেন, আমার হাসি পেয়েছিল। হাসির কারণটা নিশ্চয়ই সবাই এতক্ষণে টের পেয়েছেন।

গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সভায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীসহ দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতাকর্মীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির যে কয়জন নেতা বক্তব্য রাখেন তাদের সবাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী কিংবা দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে সাময়িক বহিষ্কার করা নেতাদের ক্ষমা করে দেওয়ার আহ্বান জানান। জেলা থেকে আসা নেতারাও তাতে সায় দেন। তারা বলেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ সময় বহিষ্কৃতদের ফিরিয়ে না আনলে দল দুর্বল হয়ে যাবে। এ পর্যায়ে যেসব বহিষ্কৃত নেতা ক্ষমার জন্য আবেদন করেছেন, তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। আর ভবিষ্যতে যারা আবেদন করবেন, তাদের জাতীয় কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে ক্ষমা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

হৃদয়ে যারা বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেন তাদের একবারের ভুলের কারণে একেবারে দল থেকে বহিষ্কার করে দেওয়াটা হয়তো একটু রূঢ় সিদ্ধান্ত। কিন্তু বারবার সাধারণ ক্ষমা বারবার ভুল করতে বা বিদ্রোহ করতে প্রলুব্ধ করবে। শেষ পর্যন্ত দলে ফেরার সুযোগ থাকবেই, এটা জানলে কিছু মানুষ প্রতি নির্বাচনেই দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজেদের ভাগ্য যাচাই করার চেষ্টা করবে– জিতে গেলে তো ভালো, না জিতলেও অসুবিধা নেই, দলে ফেরার সুযোগে তো থাকছেই। তবে বারবার এই সাধারণ ক্ষমায় তৃণমূলে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে ভুল বার্তা দেবে। সাধারণ ক্ষমা পাওয়া যাবে, এই নিশ্চয়তা থাকলে ভবিষ্যতে আরও অনেক নেতা বিদ্রোহ করতে উৎসাহী হবে।

তবে আওয়ামী লীগে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা শেখ হাসিনার। আর সবাই ভুলে গেলেও শেখ হাসিনা কাউকে ভোলেন না। হঠাৎ করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অপরিচিত অনেকে ঠাঁই পেয়ে যান। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ছাত্রজীবনে তার অনেক ত্যাগ ছিল। শেখ হাসিনা সেটা মনে রেখেছেন, মূল্যায়ন করেছেন। ৭৫’র পর আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দুঃসময় এসেছিল ১/১১ সরকারের সময়। অবশ্য তখন শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দুঃসময়টা ছিল রাজনীতিরই। সেই সময়ে আওয়ামী লীগের অনেকে দলে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কারাগারে থাকা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার চেষ্টাও হয়েছে। ১/১১-তে আওয়ামী লীগের অনেকের কপাল খুলেছে যেমন, কপাল পোড়া লোকের সংখ্যাও কম নয়। অনেক বাঘা নেতা ১/১১-এর পর বিড়াল বনে গেছেন। ১/১১’র পরও অঘোষিত ‘সাধারণ ক্ষমা’র সুযোগ পেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। একেবারে দল ছেড়ে গেছেন এমন অল্প কিছু নেতারা ছাড়া, বাকি সবাই দলেই থাকতে পেরেছেন। তবে ১/১১’র পর দলের নেতৃত্ব, মনোনয়ন, মন্ত্রিত্ব- সবকিছুর মাপকাঠি ছিল ১/১১’র সময়কার ভূমিকা। ১/১১-এর সংস্কারপন্থিরা দলে থাকলেও কোণঠাসা হয়েই ছিলেন, এখনও আছেন। ১/১১-এর শেখ হাসিনার একটি উক্তি অমরত্ব পেয়েছে- ‘ফরগিভ বাট নট ফরগেট। ক্ষমা করেছি, কিন্তু ভুলবো না।’ এবার যারা সাধারণ ক্ষমা পাচ্ছেন, তাদের বিষয়টাও নিশ্চয়ই শেখ হাসিনা মনে রাখবেন। এমনভাবে মনে রাখতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সাহস না করেন।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জমি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৪, কৃষকের কব্জি বিচ্ছিন্ন
জমি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৪, কৃষকের কব্জি বিচ্ছিন্ন
শিল্পী ও সাবেক এমপি মমতাজের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন
শিল্পী ও সাবেক এমপি মমতাজের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন
হাইকোর্টের রায় স্থগিত: নগদে প্রশাসক নিয়োগ অবৈধ
হাইকোর্টের রায় স্থগিত: নগদে প্রশাসক নিয়োগ অবৈধ
তেজগাঁওয়ে ময়লার স্তূপে শিশুর মরদেহ, গায়ে আঘাতের চিহ্ন
তেজগাঁওয়ে ময়লার স্তূপে শিশুর মরদেহ, গায়ে আঘাতের চিহ্ন
সর্বশেষসর্বাধিক