X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভিক্ষুক ও ভিক্ষাজীবী

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১১ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:৪৮আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:৪৮

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচি থাকা সত্ত্বেও ঢাকা শহরে কেন ভিক্ষুক? গত বছরের ৬ নভেম্বর, জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে সমাজকল্যাণমন্ত্রীকে এই প্রশ্নটি করেছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ। বলা বাহুল্য, মন্ত্রী গতানুগতিক উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ঢাকা শহরে ভিক্ষুকদের উৎপাত নিরসনে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

কিন্তু ভিক্ষুক কমেনি। শহরের বড় রাস্তা ছেড়ে, ঘনবসতি এলাকা পূর্ণ করে ভিক্ষার হাত এখন পুরো শহর এলাকারও অলিতে গলিতে। উন্নয়নের যত প্রচেষ্টাই থাকুক, যত গল্পই বলা হোক, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় মানুষ অভাব সামলে নিতে পারছে না। এবং সে কারণেই শহরে অভাবী মানুষ হাত পাতছে মানুষের কাছে। বাস্তবতা হলো, বাড়িতে-বাড়িতে, পাড়ায়-পাড়ায় এখন যে হারে ভিক্ষুক আসে সেটি কয়েক বছর আগেও এমন ছিল না। তবে প্রকৃত অভাবীর পাশাপাশি প্রচুর পেশাদার ভিক্ষাজীবী যে আছে, সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই।

এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে ঢাকা এখন ভিক্ষুকের হাট। রাস্তায়, ফুটপাতে, ট্রাফিক সিগন্যালে, পাড়ায় পাড়ায় বাড়িঘরের সামনে শুধু ভিক্ষুক আর ভিক্ষুক। সারা দেশের রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের সামনে, মাজার, বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাটে অজস্র ভিক্ষুক। পুরো দেশ দূরে থাক, শুধু এই ঢাকা শহরে কত ভিক্ষুক আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও জানা নেই।

ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, কূটনৈতিক এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তি এবং সামগ্রিকভাবে রাজধানীকে ভিক্ষাবৃত্তিমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একসময় ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সক্রিয়তাও ছিল। এখন অভিযান বন্ধ থাকায় ভিক্ষুক বাড়ছে দেদার। রাজধানীর গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি এলাকা ভিক্ষুকদের জন্য নিষিদ্ধ হিসেবে পরিচিত। আইন অনুযায়ী এই তিন এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। গুলিস্তান, ফার্মগেট বা যাত্রাবাড়ির চেয়ে এখন এসব অঞ্চলেই ভিক্ষুকের সংখ্যা বেশি। তাই ভিক্ষুকমুক্ত সাইনবোর্ড এখন এক প্রহসনে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের আইনে ভিক্ষাবৃত্তিকে সহায়তাকারী বা এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত অপরাধে অন্তত তিন বছরের কারাবাসের বিধান রয়েছে। সরকারও এই ধরনের কাজে উৎসাহদানকারী চক্রের দমনে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা নানা সময়ে বলেছে। কিন্তু তারপরেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ২০১০ সালে দেশে ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদাকর পেশা থেকে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর আবাসন, ভরণ-পোষণ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে এই কাজে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। এ কাজে বিভিন্ন এনজিওকে যুক্ত করা হয়েছিল। উদ্যোগ ছিল ভিক্ষুকদের নিজ নিজ জেলায় পুনর্বাসন করার। কিন্তু সেগুলো কোনও কাজে আসেনি।

তাহলে সমাধান আসলে কোথায়? শাসন ব্যবস্থা পরিচালনাকারীদের সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। প্রথমে ভাবতে হবে বৈষম্য নিয়ে। আর্থিক অসাম্য দূর না হলে আমাদের সব সংকল্প ব্যর্থ হয়ে যাবে। যারা নীতিনির্ধারণী জায়গায় আছেন, তাদের মানতে হবে যে পরিস্থিতি সঙ্গিন। সমস্যাটি সমৃদ্ধির নয়, আর্থিক প্রবৃদ্ধির হারেরও নয়। অতিমারির ধাক্কা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও শুধু নয়। উৎপাদনের সমস্যাও নয়, সমস্যাটি বণ্টনের, সমস্যা রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে। মানুষের জন্য সৃষ্ট রাষ্ট্র তার শাসনপ্রণালিতে মানুষের জন্য কোনও ভাবনা রেখেছে কিনা সমস্যা সেখানে।

আমাদের প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় বাড়ার বড় গল্প চালু আছে। কিন্তু সেই বৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে কিনা সেটা ভাবা হয়নি একদম গভীরে গিয়ে। অথচ মানুষের আর্থিক বৃদ্ধির ভাগীদার হওয়ার অধিকার অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি, অধিকতর মানুষের ক্রমশ অভাবের অতলে পৌঁছে যাওয়ার দৃষ্টান্ত এই ভিক্ষুক বেড়ে যাওয়া। অতিমারি, হরেক ধাক্কায় নাজেহাল এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কথা কোথাও সেভাবে উচ্চারিত হয় না। ধনী আরও ধনী হচ্ছেন, আর গরিব আরও গরিব। আর দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরই একটি অংশ বেকার, কর্মহীন বা অসুস্থ হয়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথে পা বাড়াচ্ছে।

ভিক্ষাবৃত্তি কোনও স্বীকৃত পেশা নয়, কোনও শোভন পেশাও নয়। শারীরিকভাবে অক্ষম, দৈহিকভাবে প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের পাশাপাশি আছে বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীরা। এর বাইরে বেকারত্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও কর্মসংস্থান সংকটের কারণে যেমন ভিক্ষুক বাড়ছে, তেমনি আছে শ্রম বিমুখতা।

ভিক্ষাবৃত্তি একটি সামাজিক অনাচার– এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর প্রতিকার খুঁজতে হবে সরকারকে। অবশ্যই প্রচুর অভাবী মানুষ বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করছে, তবে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন চক্র। আমরা জানি সারা দেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও পক্ষকেই প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

ভিক্ষুক পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা আমরা অনেক শুনেছি। এগুলোতে কোনও কাজ হবে না। সরাসরি ভিক্ষাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ভিক্ষাবৃত্তি যেমন কোনও পেশা নয়, তেমনি ভিক্ষা দেওয়ার নামে কোনও একজনকে করুণা করাও কোনও সুনাগরিকের কাজ নয়।

লেখক: সাংবাদিক 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ