X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

যখন রোগী এবং স্বজন দুই-ই মরে

প্রভাষ আমিন
১২ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:৫৪আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:৫৪

কয়েক দিন আগে রাতে আমাদের অফিসের এক ড্রাইভার  ফোন করে বললো, স্যার গ্রাম থেকে আমার ভাতিজা এসেছে। সে অসুস্থ। তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাকে বেসরকারি হাসপাতালে বা আইসিইউতে রাখার সামর্থ্য তার পরিবারের নেই। পরদিন সকালে আমি একাধিক সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করলাম। সব জায়গা থেকে বলা হলো, ভর্তি করা যাবে, কিন্তু এই মুহূর্তে আইসিইউ নেই। কিন্তু ছেলেটির জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ দরকার। আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিন চারেক পর ছেলেটি মারা গেলো। মাত্র ত্রিশ বছরেই মারা যাওয়া অচেনা ছেলেটির জন্য আমার গভীর মায়া হলো।

নিজের অসহায়ত্বে নিজের ওপরই ক্ষুব্ধ হলাম। তবে যতটা মায়া হলো মরে যাওয়া ছেলেটির জন্য, তারচেয়ে বেশি হলো তার পরিবারের জন্য। ঢাকা আসাই যাদের জন্য স্বপ্নের মতো, তারা ছেলেকে নিয়ে থাকলেন বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে। যাদের সামর্থ্য শূন্য, তাদেরকেই হাসপাতালের বিল দিতে হলো লাখ টাকার ওপরে। কীভাবে দিয়েছে জানি না। হয়তো শেষ সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করেই তারা ছেলেকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।

আমার আরেক সাংবাদিক বন্ধুর একমাত্র মেয়ের ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছে। দেশে একবার অপারেশন করেও পুরো টিউমার সরানো যায়নি। এখন মেয়েকে নিয়ে মুম্বাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। দেশের অপারেশন এবং অন্যান্য চিকিৎসায় এরই মধ্যে লাখ পাঁচেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। মুম্বাই নিতে হলে আরও ৩৫ লাখ টাকা দরকার। এই সাংবাদিক বন্ধুকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি। তিনি খুবই ভালো সাংবাদিক এবং সৎ মানুষ। মেয়েকে বাঁচাতে নিজের সর্বস্ব দিয়েও কুলাবে না। সবার সহায়তায় হয়তো মেয়েটির চিকিৎসা হয়ে যাবে। পরিবারটি এমনিতেই দরিদ্র। মেয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হয়তো চিরদিনের জন্য দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে হবে।

এ দুটিই সাম্প্রতিক উদাহরণ। কিন্তু আমার কাছে এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে বাবা বা মায়ের মৃত্যুর পর পুরো পরিবারটিই ধ্বংস হয়ে যায় হাসপাতালের বিল দিতে দিতে। আমি জানি, এমন উদাহরণ আমার চেয়ে আপনাদের কাছে আরও বেশি আছে। আসলে ঘরে ঘরেই এমন উদাহরণ আছে। দীর্ঘ চিকিৎসায় পরিবারের কোনও সদস্য বেঁচে এলেও গোটা পরিবারটিই দীর্ঘ দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়। সাধারণ চিকিৎসায় তবু চলে; কিন্তু ক্যানসার, হার্ট, কিডনি ডায়ালিসিসের মতো জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

গত সপ্তাহে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭–২০২০’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিকিৎসায় ব্যক্তির ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে। ২০২০ সালে চিকিৎসায় ব্যক্তির ব্যয় ছিল ৬৯ শতাংশ। আগের দুই বছরে এই ব্যয় ছিল ৬৪ ও ৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। গত একযুগে বাংলাদেশ আসলে বদলে গেছে। আমরা এখন অন্য এক বাংলাদেশের চেহারা দেখি। কিন্তু শুধু প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল দিয়ে উন্নয়ন মাপলে তো হবে না। গুনগত উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে হবে সবার ঘরে ঘরে। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাওয়া সব নাগরিকের অধিকার। তবে এটাও ঠিক ১৮ কোটি মানুষের দেশে সবার চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা কঠিনই শুধু নয়, অসম্ভবও। এটাও ঠিক বাংলাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়েও হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। তৃণমূলে জালের মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছড়িয়ে থাকার পরও বাংলাদেশের চিকিৎসা সুবিধা বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে, এমনটি বলা যাবে না। টুকটাক অসুস্থতায় ঠিক আছে। কিন্তু একটু জটিল হলেই সবাইকে ছুটে আসতে হয় ঢাকায়। আর কোনও রেফারেল ব্যবস্থা না থাকায় এসেই সবাই সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের খোঁজে হন্যে হয় মাঠে নামেন। এই চাপে কোনও কোনও ডাক্তারকে রাত ৩-৪ পর্যন্ত রোগী দেখতে হয়। দেশের অর্ধেকের বেশি জেলায় আইসিইউ নেই। তাই জটিল কিছু হলে বেশিরভাগ মানুষই ঢাকায় ছুটে আসে। এটা ঠিক, এই বাংলাদেশেরই অনেক মানুষ আছে, যারা জ্বর হলেও থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুরে ছুটে যান। আবার অনেক মানুষ আছেন, রোগী নিয়ে ঢাকায় আসার অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া জোগাড় করতেও হাত পাততে হয়। আর ঢাকায় এসেই তারা পড়েন অথৈ সমুদ্রে। হাবুডুবু খেতে খেতে তারা যখন ফেরেন, তখন আসলে একেবারে ডুবে যান। একটা অসুস্থতা একটি পরিবারকে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, নিম্নবিত্ত থেকে দরিদ্র, দরিদ্র থেকে একেবারে সর্বহারা বানিয়ে দিতে পারে। করোনার সময় আমরা আইসিইউ নিয়ে হাহাকারটা টের পেয়েছি। কিন্তু নীরব হাহাকার থাকে সারা বছরই। ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে সবসময়ই উপচে পড়া ভিড় থাকে। কয়েকটি হাসপাতাল তবু আসনের অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করে, ফ্লোরে-বারান্দায় গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিকিৎসা নেন। কিন্তু বেশিরভাগ হাসপাতালই ‘আসন খালি নেই’ সিল মেরে রোগী ফিরিয়ে দেয়। তখন সামর্থ্য থাক বা না থাক বেসরকারি হাসপাতালেই যেতে হয় রোগীকে। আর বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বজনকে সুস্থ করতে মানুষ সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কার্পণ্য করে না। পকেটে হয়তো ফুটো পয়সাও থাকে না, কিন্তু ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলে, যত টাকা লাগে, আমার সন্তানকে বাঁচান।

বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোও মানুষের এই আবেগকে পুঁজি করেই ব্যবসা করে। ডাক্তাররাও মক্কেল বুঝে ইচ্ছামতো প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দিয়ে ক্লিনিকের ব্যবসা টিকিয়ে রাখেন, নিজেরাও কমিশন পান। বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশনের খরচ শুরুই হয় লাখ টাকা থেকে। আর আইসিইউ বা লাইফ সাপোর্ট মানেই পরিবারসুদ্ধ ডুবে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। সরকারি হাসপাতালে সময় মতো আইসিইউ পাওয়া আর লটারি পাওয়া সমান কথা। ছোটখাটো তদবিরে কাজ হয় না, অন্তত মন্ত্রীর ফোন লাগে। এই সুযোগটাই নেয় আমাদের বেসরকারি হাসপাতালগুলো। অপ্রয়োজনে আইসিইউতে রাখা, মারা যাওয়ার পরও লাইফ সাপোর্টে রাখা, টাকার জন্য লাশ আটকে রাখার ভূরি ভূরি গল্প আছে আমাদের চারপাশে। হার্টের রোগীদের রিং না লাগিয়েই রিংয়ের টাকা নেওয়ার উদাহরণও কম নয়।

বাংলাদেশে এখন প্রায় সব রোগের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু চিকিৎসা কিনতে আপনার টাকা লাগবে। সমস্যা হলো টাকা দিয়েও আপনি সবসময় মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাবেন না। টাকা দিয়েও আপনি প্রতারিত হতে পারেন ।

মানুষকে রোগ থেকে বাঁচানো, সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনি এই উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়ের ফাঁদ থেকে মানুষকে রক্ষা করাও সরকারের দায়িত্ব। এই জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা আরও সহজলভ্য করতে হবে, হয়রানিমুক্ত রাখতে হবে। চিকিৎসায় সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর খরচ এবং সেবার মান মনিটর করতে হবে।  ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউসহ চিকিৎসা সুবিধা বাড়াতে হবে, ব্যয় কমাতে হবে। যখন লিখছি, ব্যয় কমাতে হবে, তখনও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডায়ালিসিসের ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে রোগীরা আন্দোলন করছেন। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন বাড়াতে হবে। বিমা সুবিধা থাকায় উন্নত বিশ্বের মানুষকে চিকিৎসা নিয়ে ভাবতে হয় না। বিমা না থাকলে সেসব দেশে চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। বিমা আওতার বাইরে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে চিকিৎসার জন্য দেশে আসেন। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিমার ধারণা প্রায় নেই বললেই চলে। কীভাবে হবে, সেটা পুরোটা জানি না। সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের বসে এর উপায় বের করতে হবে। আসলে উপায় বের করতে হবেই। সঠিক চিকিৎসার পরও মানুষ মারা যেতে পারে। কিন্তু ভুল চিকিৎসায়, বিনা চিকিৎসায়, টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে চোখের সামনে কারও মৃত্যু দেখার চেয়ে বেশি অসহায়ত্ব, গ্লানি আর কিছু নেই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ