X
মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪
৩১ বৈশাখ ১৪৩১

শনির দশা কাটালো ‘শনিবার বিকেল’

জনি হক
২২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:৩১আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:৩১

বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত একটি প্রবাদ হলো শনির দশা। সাধারণত মানুষের দুরবস্থা কিংবা দুঃসময়ের বিষয় বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়। ধারণা করা হয়, কারও জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে মানে তার শনির দশা চলছে। শনিবারেই শনির দশা বেশি ভর করে এমন কুসংস্কার ছোটবেলায় চারপাশে অহরহ শুনতাম। শনিবার যেন একটা জুজু! শনিবারে দূরের গন্তব্যে যাওয়া থেকে বিরত থাকে অনেকে। অংক পরীক্ষা শনিবারে থাকলে আগেই ফেল আতঙ্ক ঢুকে যায় কারও কারও মনে। শনিবারে খেলা থাকা মানেই যেন হার! কিন্তু শনিবারে এক পক্ষ হারলেও অন্য দল তো ঠিকই জেতে। শনিবারেই পরীক্ষা দিয়ে ছেলেমেয়েরা জিপিএ-৫ পায়। শনিবারে কোনও পরিবহন বন্ধ থাকে না। সুতরাং শনিবার একটা জুজু। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ ছিল সেন্সর বোর্ডের কাছে এমন একটা কল্পিত ভয়। সেই ভয় কেড়ে নিয়েছে তার চারটা বছর।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার কূটনৈতিক পাড়া গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কে হোলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার ছায়া অবলম্বনে ‘শনিবার বিকেল’ পরিচালনা করেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এটি যৌথ প্রযোজনায় এক টেকে চিত্রায়িত। বাংলাদেশে এক শটে নির্মিত এটাই প্রথম চলচ্চিত্র। গোটা পৃথিবীতেই এমন ছবি হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি। সেদিক থেকে এটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ। যারা শুটিং করেন বা করান তারা তো বটেই; যারা জীবনে একবার হলেও শুটিং প্রক্রিয়া দেখেছেন, তারাও ভালো করে বুঝবেন– এক টেকে গোটা একটা গল্প বলা কত কঠিন।

২০১৯ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ৪১তম আসরে রাশান ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকস জুরি পুরস্কার এবং কমেরসান্ত পুরস্কারসহ আরো অনেক ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হয় ‘শনিবার বিকেল’। এছাড়া মিউনিখ, বুসান ও সিডনিসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশনে স্থান পায় ছবিটি।

কিন্তু দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে এমন আশঙ্কায় সিনেমাটির মুক্তি আটকে দেয় সেন্সর বোর্ড। এটা আসলে ছিল ‘ভাওতাবাজি’! ‘ব্যাচেলর’, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ এবং ‘টেলিভিশন’ যিনি বানিয়েছেন, তার ছবিতে নাকি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা তৈরির মতো উপাদান আছে। এটা পুরোপুরি আজব আর বানোয়াট কথাবার্তা। এক্ষেত্রে দি হলিউড রিপোর্টারের একটি পর্যালোচনার কথা বলতে পারি। তাদের দৃষ্টিতে, ‘ছবিটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়াতে পারে। এমনকি ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারেও জোরালো আবেদন তৈরি করতে পারে।’

যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে বিদেশি কলাকুশলী আনার জন্য শুটিংয়ের আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয় এবং পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হয়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এসব করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে অনুমোদনের পাশাপাশি উৎসাহ পেয়েছিলেন। ছবিটি ছাড়পত্রের জন্য জমা দেওয়ার পর এর প্রথম সেন্সর প্রদর্শনী দেখে বোর্ডের সদস্যরা প্রশংসা করেন। ফলে দ্রুত সনদ পাওয়াটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু পরে আবারও ছবিটি দেখা হলো সেন্সর বোর্ডে। এরপরই আটকে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে দীর্ঘ চার বছর ধরে আটকে থাকলো ‘শনিবার বিকেল’। প্রশ্ন হলো, ছবিটি যদি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে বলে মনে হয়, তাহলে এটি বানানোর অনুমোদন দেওয়া হলো কেন?

গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ফ্রি স্যাটারডে আফটারনুন’ ও ‘রিলিজ স্যাটারডে আফটারনুন’ হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে শুরু। এরপর ‘শনিবার বিকেল’কে সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়াসহ পাঁচ দফা দাবি জানাতে বিভিন্ন প্রজন্মের নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলী ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে কাঁটাতার দেওয়া মঞ্চে সমবেত হন। সংবাদ সম্মেলনটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলা চলচ্চিত্র বা কনটেন্টে সেন্সরশিপের খড়গ: গল্প বলার স্বাধীনতা চাই’। পরে ফিল্ম অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ (ফ্যাব) ছবিটির মুক্তির দাবি জানায়। আমাদের দেশে একটু স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র বানাতে গেলেই যেন মনে হয় সেন্সর বোর্ড আটকে দেবে! নিজের ছবির জন্য ফিল্মমেকারদের অসহায়ত্ব দেখলে তাদের নন্দঘোষ মনে হয় আমার। যত দোষ তাদের! ফিল্মমেকিং যেন আমাদের দেশে একটা অপরাধ। অথচ ভারতে মন্ত্রী-এমপি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার সমালোচনা করা হয় চলচ্চিত্রে। আমরা কেন বুঝতে পারি না, কোনও একজনকে মন্দভাবে উপস্থাপন করা মানেই সবাইকে খারাপ বলা নয়।

গুলশানের হোলি আর্টিজানের ঘটনা অবলম্বনে বলিউডে নির্মিত ‘ফারাজ’ মুক্তি পাচ্ছে ৩ ফেব্রুয়ারি। অথচ চার বছর আগে একই ঘটনার ছায়ায় ‘শনিবার বিকেল’ বানিয়ে ফেলেছিলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। কিন্তু তার চোখের সামনে ‘ফারাজ’ মুক্তি পেয়ে যাবে! এ কারণে ‘ফেব্রুয়ারির তিন তারিখের আগেই মুক্তি চাই’ এবং ‘ফারাজ সিনেমার একঘণ্টা আগে হলেও শনিবার বিকেল মুক্তি দেওয়া হোক’ দাবি ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তির দাবিতে যেমন প্রতিবাদ হয়েছে এবং দাবি উঠেছে, সেসব আমাদের দেশে সংগঠিত করতে হয় ফোন কিংবা সভা করে। কিন্তু ছবিটির বেলায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেকে সরব হয়েছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়াটা বিফলে যায়নি। ২১ জানুয়ারি শনিবারেই আমরা পেলাম ‘শনিবার বিকেল’কেন্দ্রিক সুসংবাদ। ছবিটি সিনেমা হলে মুক্তিতে আর কোনও বাধা নেই। আপিল বোর্ডের অন্যতম সদস্য সাংবাদিক শ্যামল দত্ত একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, “ছবিটি আমরা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর ছবিটি প্রদর্শনে কোনও ধরনের বাধা নেই। আমরা সবাই ছবিটি দেখেছি। যেহেতু ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি হোলি আর্টিজানের ঘটনার হুবহু রূপায়ন নয়, তাই এর মুক্তিতে কোনও বাধা নেই। কোনও দৃশ্য সংযোজন বা পরিমার্জন করারও প্রয়োজন নেই। এ ছবির ঘটনার সঙ্গে হোলি আর্টিজানে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এটি হোলি আর্টিজানের ঘটনার সরাসরি চিত্রায়ন না, আমরা এ রকম একটা ঘোষণা পরিচালককে দিতে বলেছি। আমরা বলেছি, এরপর আপনি ছবিটি মুক্তি দিয়ে দিন।”

সেন্সর বোর্ডের মতিগতি বোঝা ভার! শর্তটির কথা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে চার বছর আগে বলে দিলেই তো হতো। দীর্ঘ চার বছর ‘শনিবার বিকেল’ আটকে রাখা হলো কেন? তিনি বারবারই বলে এসেছেন, ‘শনিবার বিকেল’ হোলি আর্টিজানের ঘটনা পুনর্নির্মাণ করেনি। এমনকি সেই ক্যাফের ভেতরের কোনও চরিত্র পুনর্নির্মাণ করেনি। তারপরও সাজা ভোগ করতে হলো তাকে। চারটা বছর তাকে কে ফিরিয়ে দেবে? মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ২১ জানুয়ারি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমার মতো এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেন কোনও ফিল্মমেকার না যায়। আমরা বাঁচি আর কয় দিন। কাজের সময় খুব কম। এইভাবে তা অপচয়ের কোনও মানে নাই।’

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বাধা-বিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছে। ছবিয়ালের মাধ্যমে পর্দায় খাঁটি শহুরে ভাষা ও অবয়ব ছড়িয়ে দেওয়ায় অনেকে তাকে তুলোধুনা করে ছেড়েছিলেন। তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেড় বছর সেন্সর বোর্ডে আটকা ছিল। এবার চার বছর ধরে আটকে রাখা হলো ‘শনিবার বিকেল’। ফিল্মমেকারের কাছে তার চলচ্চিত্র সন্তানের মতো। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সন্তানকে সেন্সর বোর্ড চার বছর ধরে আটকে রেখেছিল। এতটা দিন তিনি সব কষ্ট মুখ বুজে সয়েছেন। তার বেদনা কেবল একজন ফিল্মমেকারের পক্ষে বোঝা সম্ভব।

একটা কথা শোনা যায়, আমাদের দেশের ফিল্মমেকাররা দ্বিধাবিভক্ত। একজনের ভালো নাকি আরেকজনের সয় না! কেউ বিপদে পড়লে অন্যরা পাশে দাঁড়াতে চায় না। আমরা তখন প্রচলিত একটা কথা বলে ফেলি- ‘আমার বিপদে তো সে আসে নাই, আমি কেন যাবো!’ ফিল্মমেকাররা ভুলে যান কেন, দশের লাঠি একের বোঝা। ‘শনিবার বিকেল’ ছবির জন্য নবীন-প্রবীণ অনেক নির্মাতা সোচ্চার হয়েছেন। এসব কণ্ঠস্বর আপিল বোর্ডকে বাধ্য করেছে ছবিটি ছেড়ে দিতে। এটা তো দিবালোকের মতো পরিষ্কার। আগামীতেও কারও ছবিকে অন্যায়ভাবে আটকে দেওয়া হলে লড়াই করতে হবে আপনাদেরই। বাংলাদেশে শিল্পের স্বাধীনতার এমন জয় অব্যাহত থাকুক।

কয়েক মাস আগে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ফোনালাপ হয়েছিল আমার। ‘শনিবার বিকেল’ ছিল আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। তবে ছবিটির নামকরণ নিয়ে কথা হয়নি। তখন তাকে বলেছিলাম, ওটিটির যুগে সেন্সর বোডর্কে থোড়াই কেয়ার করে ছবিটা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে ছেড়ে দিলেই পারেন! তিনি পরীক্ষিত পরিচালক। তাছাড়া তার যে যোগাযোগের পরিধি এবং আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে তাতে সেটা ডালভাত। কিন্তু তিনি আমাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কিছু করতে চাই না। নিজের দেশের দর্শকদেরই যদি ছবিটা দেখাতে না পারি তাইলে আর বানালাম কেন?’

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আত্মবিশ্বাস ছিল, ‘শনিবার বিকেল’ মুক্ত হবেই। তার প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। সেন্সরের জটিলতা দূর হয়ে ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তি পাচ্ছে ভাবতেই ভালো লাগছে। চার বছরের বাধা এবং সবার সোচ্চার হওয়া, অতঃপর জয়। আখেরে এসব ছবিটির জন্য শাপে বর হয়েছে! চারপাশে এত আলোচনার কারণে অনেকের মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে, ‘শনিবার বিকেল দেখতে হবে।’ সম্ভবত ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’র পর বাংলাদেশ আরেকটি বাম্পার হিট চলচ্চিত্র পেতে যাচ্ছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে আগাম অভিনন্দন!

লেখক: ডেপুটি নিউজ এডিটর, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবারের পর্দা উঠছে অদ্ভুত মেজাজে!
কান উৎসব ২০২৪এবারের পর্দা উঠছে অদ্ভুত মেজাজে!
কেমন থাকবে আজকের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আজকের আবহাওয়া?
মুম্বাইয়ে বিলবোর্ড ভেঙে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৪
মুম্বাইয়ে বিলবোর্ড ভেঙে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৪
ক্যানসার দমাতে পারেনি মাহাথিরকে, হতে চায় মানবিক চিকিৎসক
ক্যানসার দমাতে পারেনি মাহাথিরকে, হতে চায় মানবিক চিকিৎসক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ