X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আগামী নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:৫৬আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:৫৬

বেশ কয়েক মাস যাবৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলছে বিভিন্ন ধরনের হিসাব-নিকাশ। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিনিয়ত তাদের কৌশল পরিবর্তন করে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য যেমন নতুন নতুন কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টির বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় যে কৌশলটি বিরোধী দলের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে তা হলো নির্বাচন বর্জনের কৌশল। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন বর্জনের বিষয়টি নতুন কোনও কিছু নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনকেও তারা বর্জন এবং প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেই নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল এই দলটি। তবে সেই নির্বাচনেও তারা তেমন কোনও সুবিধা করতে পারেনি। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন বর্জন করার হুমকি প্রদর্শনের মাধ্যমে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে এই দলের নেতারা।

একই সঙ্গে নতুন গঠিত নির্বাচন কমিশনকে আস্থায় না নিয়ে এবং নির্বাচন কমিশনের আলোচনায় অংশগ্রহণ না করে বিএনপির পক্ষ থেকে যে বার্তাটি প্রদান করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা হলো, সরকারের পদত্যাগের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠনের মাধ্যমেই তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। বিরোধী দলের নেতারা মনে করছেন আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে সরকারের পক্ষে নির্বাচনের বৈধতা অর্জন করা কঠিন হবে। আর এই ধারণা থেকেই তারা একদিকে যেমন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, ঠিক তেমনি বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে ধরনা দিচ্ছে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য।

এটা ঠিক যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তি অনেক সময় চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। কিন্তু গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ যে শক্তি অর্জন করেছে তার ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে এই সরকারকে চাপ সৃষ্টি করে কোনও কাজ করতে বাধ্য করা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। তবে এ কথাও ঠিক বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বর্তমান সরকারও চায় দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তন হোক। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনও বিকল্প নেই। তবে, বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের রাজনীতি ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে- এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

কয়েক মাস যাবৎ বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের মতামত প্রদান করে চলেছেন। এমনও জানা গেছে যে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে শক্তিধর রাষ্ট্রের মাধ্যমে সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশের সরকার এবং বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হতে চলেছে মর্মে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে জাতিকে সরকারবিরোধী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল ২০২২ সালের শেষের দিকে। ফলে, জনগণের মধ্যে এক ধরনের উৎকণ্ঠা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল।  

তবে বছর শেষ হয়ে গেলেও বাংলাদেশ সরকার কিংবা কোনও ব্যক্তির ওপর কোনও ধরনের  নিষেধাজ্ঞা আরোপিত না হওয়ায় বিরোধীদল এক ধরনের ব্যাকফুটে চলে গেছে। দেশের রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ ঘটনাটিও বিরোধীদলের জন্য খুব কাঙ্ক্ষিত ছিল না। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তার এই সফরকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে আশা করা হয়েছিল যে ডোনাল্ড লু সফরের সময়কালে সরকারের ওপরে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করবেন। কিন্তু  লু'র বাংলাদেশ সফর বিরোধী দলকে খুশি করতে পারেনি। কারণ, তিনি সরকার এবং র‍্যাবের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেছেন।

এমনকি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তার সরকারের সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ডোনাল্ড লুকে ইমরান খানের পতনের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে বিএনপির পক্ষ থেকে তার সফরকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু তার বাংলাদেশ সফরের পরে বিরোধী দলের মধ্যে এক ধরনের হতাশা দেখা গেছে। বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দকে যে বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত তা হলো বাংলাদেশ এশীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যান্য রাষ্ট্র প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও এশীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনেক রাষ্ট্রই বাংলাদেশকে মাথায় রাখে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিগত ১৪ বছর রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে যে সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে তা আগামী দিনের রাজনীতিতে তাদের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।

আমরা সবাই জানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৈরিতা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের রাজনীতির জন্য একটি বড় বিষয়। এই বৈরিতাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সম্পর্ক উন্নয়ন হয়েছে গত এক প্রায় এক দশকে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সম্পর্কের সমীকরণ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাবে মর্মে যে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল সেই প্রত্যাশা বাস্তবে পূরণ হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন না।

একটি স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে সেই দেশের জনগণের মাধ্যমে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। প্রতি ৫ বছর অন্তর নির্বাচন কেন্দ্রিক অচলাবস্থা নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে এক ধরনের অনীহা তৈরি করেছে। নির্বাচন বর্জন এবং নির্বাচন প্রতিহত করার রাজনীতির কবলে পড়ে একদিকে যেমন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুসংগত হচ্ছে না, ঠিক তেমনিভাবে নির্বাচনকালীন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে দেশের অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণ গেছে। সেই অবস্থা থেকে বাংলাদেশের মানুষ উত্তরণ চায়।  আর সে অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে হলে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরই এগিয়ে আসতে হবে।  উন্মুক্ত মন নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুসংহত করার ক্ষেত্রে সরকারি দলের যেমন ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনি বিরোধীদলেরও সমান ভূমিকা রয়েছে। সরকারি দলের যেমন উচিত বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতে দেওয়া, ঠিক তেমনি বিরোধীদলের উচিত সরকারের সব কাজের বিরোধিতা না করে গঠনমূলক বিরোধিতার মাধ্যমে সরকারকে সহায়তা করা, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একেবারেই দেখা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এখন নিজেদের ভালো এবং খারাপ বুঝতে শিখেছে। বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভব নয়।  

এই অবস্থায় সব দলের রাজনৈতিক বাস্তবতা উপলব্ধি করা উচিত। যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে সেই দেশগুলো বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র। সেসব বন্ধু রাষ্ট্রকে বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টির জন্য যদি বৈদেশিক শক্তিকে ব্যবহার করা হয়, সেটিও দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। সব রাজনৈতিক দলকে বুঝতে হবে ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র উপায় হচ্ছে জনগণের ভোট। তাই বিদেশি বন্ধুদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল না হয়ে জনগণকে আস্থায় নিতে পারলে নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব।

যারা এতদিনেও এসব বিষয় উপলব্ধি করতে পারেননি তাদের উচিত অতিসত্বর তা উপলব্ধি করে রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন করা। সরকারের তরফে জনগণকে আস্থায় নেওয়ার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সরকার জনগণকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসবার চেষ্টা করবে- এটিই স্বাভাবিক।

সরকারি দলের মতো বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের ভুলগুলো শুধরে বাইরের বন্ধুদের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে জনগণকে আস্থায় নিয়ে আসবার কৌশল খুঁজে বের করা উচিত। তাদের মনে রাখতে হবে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় তারা ইতোমধ্যে ব্যাকফুটে চলে গেছে। আবার মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধরনের অযৌক্তিক বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে শঙ্কা তৈরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার ফলে তাদের ওপর জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছে। ফলে জনগণকে আস্থায় নিতে না পারলে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না, এই কথাটি উপলব্ধি করে রাজনীতির বাস্তবতাকে গ্রহণ করে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। এই ক্ষেত্রে বিরোধীদলের তুলনায় সরকারি দল অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আর এই কারণেই আগামী নির্বাচনে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারি দল অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ