X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বিঘ্নে বিশ্বাস লালন করার অধিকার থাকুক সবার

প্রভাষ আমিন
১০ মার্চ ২০২৩, ১৭:২৬আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৩, ১৭:২৬

মার্চ এলেই অন্যরকম এক আবেগে আন্দোলিত হই আমরা। মার্চ আমাদের স্বাধীনতার মাস। মার্চের প্রতিটি দিনই যেন অগ্নিঝরা, রক্তেভেজা। একাত্তরে মার্চের প্রতিটি দিনই ছিল উত্তাল। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ এবং সৈন্য সমাবেশের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বিজয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মকে পুঁজি করে গঠিত পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষায়। এই অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতাই বাংলাদেশের মূল বৈশিষ্ট্য, মৌলিক চরিত্র। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী এবং ধর্মীয় উগ্রবাদী অপশক্তি বারবার বাংলাদেশের এই মৌলিক চরিত্রে আঘাত হানার চেষ্টা করেছে। বারবার বাংলাদেশ রুখে দাঁড়িয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতিই হলো বাংলাদেশের মূল সুর।

এবারের মার্চের শুরুতেই সেই অপশক্তি আবারও বাংলাদেশের মৌলিক চরিত্রে আঘাত হানার চেষ্টা করে, আবারও রক্তাক্ত হয় বাংলার মাটি। আহমদিয়া মুসলিম জামাতের ৯৮তম বার্ষিক সালানা জলসার এবারের আসর বসার কথা ছিল পঞ্চগড় জেলার উপকণ্ঠে আহমদিয়া জামায়াত অধ্যুষিত আহম্মদনগর এলাকায়। এবারের সালানা জলসার আয়োজন ছিল তিন দিনের। বৃহস্পতিবার থেকেই সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে একটি অংশ উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। শুক্রবার দুপুরে জলসার কার্যক্রম শুরু হলে বিক্ষোভকারীরা হামলা চালায়। ছয়ঘণ্টার সংঘর্ষে ২ জন মারা গেছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। কিন্তু আর্থিক ক্ষতির চেয়েও বড় ক্ষতি হলো বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের ওপর আঘাত।

ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে থাকবে বাংলাদেশেরই নাগরিক, নিরীহ সাধারণ মানুষ; এটা বাংলাদেশের জন্য অমর্যাদার। তবে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। সংবিধানে কী লেখা আছে, তাতে পরে আসছি। সাধারণ নীতি নৈতিকতাও বলে, নিজ নিজ বিশ্বাস লালন করার অধিকার আমাদের সবার আছে। সংখ্যাগুরুদের দায়িত্ব হলো সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একটা দেশে সংখ্যালঘুরা যত নিরাপদ, সংখ্যাগুরুরা তত ভালো। সংখ্যালঘুদের আক্রান্ত হওয়ার দায় অবশ্যই সংখ্যাগুরুদের।

এবার আসি সংবিধানের কথায়। ১৯৭১ সালের বিজয় অর্জনের পর ৭২ সালেই আমরা পেয়েছিলাম অসাধারণ একটি সংবিধান। বারবার কাটাছেঁড়ার পরও বাংলাদেশের সংবিধান এখনও সব মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের মর্যাদার সুরক্ষা নিশ্চিত করে। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা অংশে বলা হয়েছে, ১২। ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য– ক. সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, খ. রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, গ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, ঘ. কোনও বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে। ধর্ম, প্রভৃতি কারণে বৈষম্য অংশে বলা হয়েছে, ২৮.১ কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। আর ধর্মীয় স্বাধীনতা অংশে বলা হয়েছে, ৪১.১ আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে ক. প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে। যে দেশের সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে এমন সুস্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করা হয়েছে, সে দেশে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে বারবার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা লজ্জাজনক।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম কোনও জবরদস্তিতে বিশ্বাস করে না, কারও ওপর নিজেদের বিশ্বাস চাপিয়ে দেয় না। ইসলাম বিশ্বজয় করেছিল ভালোবাসা দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে নয়। কিন্তু একজন সত্যিকারের মুসলমানের জন্য বিষয়টি বেদনার যে ইসলামের নামেই চলে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ। ইসলামের নামেই চলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা। কোনোভাবেই ইসলাম অন্য ধর্ম বা বিশ্বাসের ওপর হামলাকে সমর্থন করে না, সন্ত্রাস সমর্থন করে না। যারা ইসলামের নামে হামলা চালায়, সন্ত্রাস করে; তারা আসলে ইসলামের শত্রু, তারাই ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। ইসলাম ধর্মে আবার বিশ্বাসের নানা রকমফের আছে।

আমি যেমন জন্মসূত্রে সুন্নি মুসলমান। আমি বিশ্বাস করি সুফিবাদে, ইসলামের শান্তির বাণীতে। শিয়াদের সাথে আমার বিশ্বাস পুরোপুরি হয়তো মেলে না, আহমদিয়াদের সঙ্গেও মেলে না। কিন্তু তাই বলে তো আমি শিয়া বা আহমদিয়াদের ওপর হামলা করবো না, তাদের মেরে ফেলবো না, তাদের বাড়িঘরে আগুন দেবো না। একজন ভালো মুসলমান হিসেবে, দেশের সংবিধান ও আইন মানা নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব ভিন্নমত, ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শুধু সুন্নি, শিয়া বা আহমদিয়া- ইসলামের ভাগটা এত সরল নয়। ছোট ছোট অনেকে বিষয়েও মতভেদ আছে। একপক্ষ শবেবরাত পালন করে, আরেকপক্ষ করে না; একপক্ষ মাজারে যায়, আরেক পক্ষ যায় না; একপক্ষ মিলাদের মাঝে হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানায়, আরেক পক্ষ বসে শ্রদ্ধা জানায়; একপক্ষ নামাজ শেষে মোনাজাত করে, আরেক পক্ষ করে না; একপক্ষ তাবলিগ জামাতে বিশ্বাস করে, আরেকপক্ষ করে না; একপক্ষ সৌদি আরবের সঙ্গে মিলিয়ে রোজা-ঈদ পালন করে, আরেকপক্ষ বাংলাদেশে চাঁদ দেখে রোজা-ঈদ পালন করে। এমন অসংখ্য মতভেদ আছে। দেশভেদে এই মতভেদেও ভিন্নতা আসে। এখন যদি মুসলমানরা এসব মতভেদের কারণে একপক্ষ আরেকপক্ষকে মারতে শুরু করে; তাহলে তো আখেরে ইসলামেরই ক্ষতি, মুসলমানরাই দুর্বল হবে। কিন্তু আমরা ইসলামের কথা ভাবি না। মতে না মিললেই নাস্তিক, মুরতাদ ঘোষণা করে চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কারও ধর্মীয় জলসায় আগুন দেই।

আহমদিয়া মুসলিম জামায়াত বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরীহ ধর্মবিশ্বাসী গোষ্ঠী। তারা নিজেরা একত্রিত হয়ে নিজেদের মতো থাকে। শুধু আক্রান্ত হওয়ার কারণেই তারা বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। নিজেরা কখনও হামলা করেনি, তাদের বিশ্বাস কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। কিন্তু একটি উগ্র অংশ আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু কে মুসলিম, কে অমুসলিম, কে হিন্দু, কে খ্রিষ্টান তা ঘোষণা দেওয়ার এখতিয়ার তো রাষ্ট্র, কোনও দল বা ব্যক্তির নেই। আর বাংলাদেশের সংবিধানে তো সকল মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ বিচার করবেন কে মুসলমান, কে নয়, কে ভালো, কে মন্দ। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, পঞ্চগড়ে যারা ইসলামের নামে হামলা করে মানুষ মেরেছে, তারা অবশ্যই ভালো মুসলমান নয়। আইন হাতে তুলে নিয়ে তারা অপরাধ করেছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা। আর শেষ বিচারের দিনেও নিশ্চয়ই তাদের জন্য শাস্তি অপেক্ষা করছে।

আহমদিয়াদের বিশ্বাসের ব্যাপারে আমি বিস্তারিত জানি না। জানতে চাইও না। তারা তাদের নিজেদের বিশ্বাস লালন করুক, তারা কারও ওপর জবরদস্তি না করলে, আইন হাতে তুলে না নিলে আমার কোনও আপত্তি নেই। পঞ্চগড়ে হামলার পর আহমদিয়া মুসলিম জামায়াতের সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়েছে, ‘আহমদিয়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে অসত্য, মনগড়া ও বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, তাদের উসকে দেওয়া হচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে। অথচ আহমদিয়ারা অর্থাৎ আমরা মুসলমান। ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভ: কলেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর অকৃত্রিম বিশ্বাস এবং শরিয়তের বিধান এবং সুন্নতে রাসুল (সা.) অনুযায়ী নামাজ, রোজা, জাকাত এবং হজ পালন করে থাকি।’ সংবাদ সম্মেলনে আরও দাবি করা হয়েছে, ‘আমাদের নামে অপপ্রচার করা হয় যে আমরা নাকি হজরত মুহাম্মদ (সা.) খাতামান্নাবীঈন মানি না। এটি আমাদের ওপর সম্পূর্ণ একটি মিথ্যা অপবাদ। আরবি ভাষায় খাতাম শব্দের যত অর্থ আছে সব অর্থেই আমরা হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-কে খাতামান্নাবীঈন মান্য করি।’ অন্য মুসলমানদের সাথে আহমদিয়া মুসলমানদের পার্থক্যও তুলে ধরা হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে, ‘আহমদিয়া মুসলমানদের সাথে কোনও কোনও ক্ষেত্রে মতভেদ রয়েছে, আর তা হলো মূলত ইমাম মাহদীর (আ.) আগমনকে নিয়ে। আহমদিয়া মুসলমানগণ বিশ্বাস করেন, হজরত মির্যা গোলাম আহমদ হচ্ছে সেই প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী (আ.) আর অন্যরা তাঁর আগমনের অপেক্ষায় রয়েছেন। আহমদিয়া এবং অ-আহমদিয়া মুসলমানগণের মধ্যে এটিই প্রধান পার্থক্য।’ আগেই বলেছি, আমি একজন সুন্নি মুসলমান। তাই আহমদিয়া মুসলমানদের সাথে আমার বিশ্বাসের সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু তারা যাতে তাদের ধর্মচর্চা নির্বিঘ্নে লালন করতে পারে, তা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া না করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে, ৩০ লাখ মানুষ রক্ত দিয়েছে; সবার জন্য একটা দেশ গড়বে বলে। এখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, বিশ্বাস নিয়ে কোনও বৈষম্য নেই। আবহমান কাল ধরে আমরা যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে আসছি, তাকে এগিয়ে নেওয়াই হোক এবারের মার্চের শপথ।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা সরাতে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা সরাতে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ
ওরসে ঝগড়া, সেই শত্রুতায় ছুরিকাঘাতে যুবককে হত্যা
ওরসে ঝগড়া, সেই শত্রুতায় ছুরিকাঘাতে যুবককে হত্যা
ন্যাপ বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলোর প্রতি পর্যাপ্ত সহায়তার আহ্বান
ন্যাপ বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলোর প্রতি পর্যাপ্ত সহায়তার আহ্বান
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ