X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

আপনি কি ‍সুখী?

আমীন আল রশীদ
২১ মার্চ ২০২৩, ১৯:০২আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৩, ১৯:০২

সুখী দেশের তালিকায় ২৪ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। তার মানে কি বাংলাদেশের মানুষের জীবন থেকে সুখ কমে যাচ্ছে? অথচ সবসময় যে বলা হয় বাংলাদেশের মানুষ খুবই সুখী, সেটির ভিত্তি কী? সুখ পরিমাপের যন্ত্র কোথায় পাওয়া যায়? জাতিসংঘ বলে দিলো যে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ২৪ ধাপ পিছিয়েছে—সেটি মেনে নিতে হবে? সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেখা যাক জরিপ কী বলছে?

প্রতি বছর ২০ মার্চ সুখী দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ করে জাতিসংঘ। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও তারা যে ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২৩’ বা ‘বৈশ্বিক সুখের প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, সুখী দেশের তালিকায় ১৩৭টি দেশের মধ্যে টানা ষষ্ঠবারের মতো শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড। চতুর্থ থেকে দশম অবস্থানে জায়গা করে নেওয়া দেশগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ইসরায়েল, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ ও নিউজিল্যান্ড। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮তম। যদিও ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৪। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে এবার বাংলাদেশ ২৪ ধাপ পিছিয়েছে। শুধু তাই নয়, এবার পাকিস্তানও আছে বাংলাদেশের ১০ ধাপ ওপরে। (ডয়েচেভেলে, ২০ মার্চ ২০২৩)।

সুখী দেশের তালিকা করার ক্ষেত্রে ছয়টি সূচক যাচাই করা হয়। এগুলো হচ্ছে– ১. মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), ২. সামাজিক সহায়তা, ৩. সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশা, ৪. জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, ৫. বদান্যতা, ৬. দুর্নীতি নিয়ে মানুষের মনোভাব। এ বছর অবশ্য সুখী দেশের তালিকা করতে গিয়ে করোনা মহামারিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কারণ, কোভিড-১৯ মানুষের ভালো থাকার খরচ বাড়িয়েছে, সেই সঙ্গে যুক্ত করেছে সীমাহীন বেকারত্ব। এর প্রভাব পড়েছে সূচকে।

যেসব মানদণ্ড বিবেচনায় একটি দেশের সুখ পরিমাপ করা হয়, সেদিকে নজর দিলে আমরা কী দেখবো? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি বণিকবার্তার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ে। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে চূড়ান্ত হিসাবে মাথাপিছু আয় কমে হয়েছে ২ হাজার ৭৯৩ ডলার। আগের অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৮২৪ ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কিছুটা কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এটি খুবই স্বাভাবিক যে মানুষের আয় কমে গেলে কিংবা তার আয়ের তুলনায় জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেলে তার মনে এর প্রভাব পড়ে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংকট তার সুখী হওয়ার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।

যেসব দেশ বরাবরই সুখী দেশের তালিকার শীর্ষে থাকে, সেসব দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সংকট নেই। মানুষের কাজ না থাকলেও তার খাওয়া-পরা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। তার চিকিৎসা, সন্তানের পড়ালেখাসহ মৌলিক প্রয়োজনগুলো রাষ্ট্র এমনভাবে নিশ্চিত করে যে জীবনের অনেক জটিলতা তাকে স্পর্শ করে না। ফলে তার পক্ষে সুখী হওয়া সহজ। অর্থাৎ রাষ্ট্র যখন নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে, সেটি তার সুস্থ জীবনযাপনে সহায়তা করে।

জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা সুখ পরিমাপের একটি উপায়। বাংলাদেশের মানুষের বিরাট অংশ এখনও জীবনযাপনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা স্বাধীন—তা প্রশ্নসাপেক্ষ। নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করতে পারা; যেটি ভালো লাগে সেই কাজ করে সম্মানজনক জীবিকা নিশ্চিত করতে পারা এখনও খুব সহজ নয়। বরং বিরাট অংশের মানুষকে জীবিকার প্রয়োজনে নিজের অপছন্দের কাজ করতে হয়। ফলে একজন মানুষ যখন দিনের বিরাট অংশ নিজের মনের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের ও পরিবারের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান- চিকিৎসা শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত থাকেন—তার পক্ষে সুখে থাকা কঠিন। তারওপর শহর ও নগর জীবনে ট্রাফিক জ্যাম ও যানবাহনের ভয়াবহ শব্দ তাকে মানসিকভাবে অস্থির করে রাখে। ফলে গ্রাম ও মফস্বল শহরের তুলনায় বড় শহর ও মহানগরীর মানুষের মধ্যে সুখে থাকার সম্ভাবনা কমে আসতে থাকে। বিশেষ করে যাদের দিনের বড় অংশই কাজ এবং কর্মস্থলে যাওয়া-আসার জন্য রাস্তায় ব্যয় করতে হয়।

আবার হাঁড়ভাঙা খাটুনির পরেও মাস শেষে যে বেতন পান, সেই টাকা বাসা ভাড়া এবং বাজার খরচের পেছনেই ফুরিয়ে যায়। তার ওপর বড় কোনও অসুখ হলে চিকিৎসার জন্য ধারদেনায় জর্জরিত হওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। সুতরাং এতসব জটিলতার মধ্যে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় ‘কেমন আছেন’ বা ‘আপনি নিজেকে কতটা সুখী মনে করেন’—তখন ভদ্রতার খাতিরে সবাই ‘ভালো আছি’ কিংবা ‘জি আমি অনেক সুখী’ বললেও সত্যিকারের সুখী মানুষের সংখ্যা কত—সেটি তর্কের বিষয়।

সুখ পরিমাপের আরেকটি তরিকা হলো দুর্নীতি নিয়ে মানুষের মনোভাব। বাংলাদেশের মানুষ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিরক্ত এই ইস্যুতে। বলা হয়, বাংলাদেশ যদি দুর্নীতিমুক্ত হতে পারতো, তাহলে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ‍সুখী দেশের তালিকা শীর্ষে চলে যেতো। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিত্তবান—প্রতিটি মানুষ কোনও না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার। বাংলাদেশে বিদ্যমান যাবতীয় সমস্যার কেন্দ্রে আছে দুর্নীতি। শুধু এই একটি জায়গায় রাষ্ট্র যদি শুরু থেকে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতি অবলম্বন করতে পারতো, তাহলে অন্যান্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক সংকট মোকাবিলা করা সহজ হতো বলে মনে করা হয়।

যেমন, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য অসংখ্য সেবা অনলাইনে তথা ঘরে বসে পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর সুফল পায় না। সার্ভার ডাউন, ইন্টারনেটের গতি কম, দক্ষ লোকবল নেই, এরকম নানা অজুহাতে নাগরিকদের বাধ্য করা হয় অফিসে সরাসরি যেতে এবং যে কাজ ১০ মিনিটে হওয়ার কথা, সেই কাজের জন্য তাদের দিনের পর দিন ঘুরতে হয়; যতক্ষণ না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে খুশি করা হয় (ঘুষ), ততক্ষণ ওই কাজটি ঝুলে থাকে।

বাংলাদেশের মানুষ কতটা সুখী, সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা খুব কঠিন, আবার খুব সহজ। খুব কঠিন এই কারণে যে এটি জানতে হলে দেশের নানা শ্রেণির মধ্যে জরিপ করতে হবে। তখন সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ নানারকম জবাব দেবেন। হয়তো আর্থিকভাবে সচ্ছল অনেক মানুষও বলবেন যে তিনি সুখী নন। আবার আর্থিক সংকটে থাকা অনেকে হয়তো বলবেন তিনি ‍সুখে আছেন। কারণ সুখের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। কে কখন কীভাবে সুখে থাকবেন, সেটি সব সময় আর্থিক সচ্ছলতার ওপর নির্ভর নাও করতে পারে।

প্রাচুর্যের ভেতরে থাকা অনেক মানুষও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনি নানা ঝামেলার কারণে অসুখী হতে পারেন। আবার দিন আনি দিন খাই প্রচুর মানুষ সুখী। বলা হয়, যিনি রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন, তিনিই সবচেয়ে সুখী। রাজধানীর কারওয়ানবাজারের যে শ্রমিকেরা ফুটপাতে, যানবাহনের তীব্র হর্ন ও শব্দের মধ্যেও পণ্য বহনকারী সাজি বা ডালার ভেতরে গুটিসুটি মেরে ঘুমান, তাদের চেয়ে সুখী আর কে আছেন? তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় কেমন আছেন, তিনি হয়তো একগাল হেসে দিয়ে বলবেন, ‘ভালো আছি’। এ কারণে বলা হয় সুখ টাকা দিয়ে কেনা যায় না। আসলে কি তা-ই?

এর উত্তর যা-ই হোক না কেন, জরিপ চালিয়ে সুখের সঠিক পরিমাপ করা যায় না। বড়জোর একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জটিল রাজনৈতিক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত অথচ বিকাশমান অর্থনীতির এমন একটি ক্ষুদ্র আয়তনের দেশে—যেখানে প্রায় ১৮ কোটি লোকের বসবাস এবং পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি; যেখানে নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার পরেও খাদ্যের হাহাকার নেই এবং যেখানের মানুষ সম্পর্কে বলা হয় যে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অল্পতেই খুশি। ফলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ যেখানেই থাকুক না কেন, এই দেশে সুখের সংজ্ঞাটা বোধহয় ভিন্ন। ফিনল্যান্ডের মানুষ যে অর্থে ‍সুখী, কারওয়ানবাজারে সাজি বা ডালার ভেতরে ঘুমাতে পারা মানুষটির কাছে সুখের সংজ্ঞা নিশ্চয়ই সেরকম নয়।  

আপনার সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করছি।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভান মুন নোয়াম বমকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
ভান মুন নোয়াম বমকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
পরোয়ানা জারির ৬ বছর পর উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার
পরোয়ানা জারির ৬ বছর পর উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার
পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার-অনিন্দিতার জামিন চেয়ে আবেদন
পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার-অনিন্দিতার জামিন চেয়ে আবেদন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ