X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে কংগ্রেসের বিজয়: রাজনীতিতে জাতীয় দলের প্রয়োজনীয়তা

স্বদেশ রায়
১৬ মে ২০২৩, ১৪:১৯আপডেট : ১৬ মে ২০২৩, ১৬:৫২

দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটকে বিপুল বিজয়ের ভেতর দিয়ে ওই রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরেছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। মাত্র কয়েক মাস আগে ভারতের ৫টি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ওই রাজ্যগুলোতে কংগ্রেস নামমাত্র আসন পেয়েছিল। ওই রাজ্যগুলোতে কংগ্রেস নামমাত্র সংখ্যক আসন পাওয়ার পর ভারতের রাজনীতিতে বা কিছু কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের বিশ্লেষণে একটি প্রশ্ন নানাভাবে সামনে আসে। তাদের বক্তব্য ছিল, আগামী ২০২৪-এ ভারতের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের বিপরীত জোটের নেতৃত্ব কোন দল দেবে?  অনেকেই কিছু কিছু আঞ্চলিক দলের নেতার নাম সামনে আনার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, যিনি ভারতের লোকসভার ৫৪৩ আসনের মাত্র ২৩টি আসনের অধিকারী এবং পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যার কোনও ভোট ও জনপ্রিয়তা নেই– তিনিও কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিজেপিবিরোধী জোটের নেতা হওয়ার জন্য কয়েকটি মিটিং ও কিছু দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন। ওই সময় বিজেপির সাবেক সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বার এবং দুটি রাজ্যের সাবেক রাজ্যপাল প্রবীণ রাজনীতিক, গবেষক ও লেখক তথাগত রায় তাঁর এক টুইট বার্তায় লিখেছিলেন– ৫টি রাজ্য থেকে কংগ্রেসকে এভাবে ওয়াইপআউট করাটি সঠিক রাজনীতি নয়। এর ফলে দেশে জাতীয় রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব কমে যাবে। আঞ্চলিক ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে নানান ধরনের সুবিধা নেবে– যা কখনোই একটি দেশের জন্য ভালো না।

লেখক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ তথাগত রায়ের বক্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ বিষয়ে বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে এটা উল্লেখ করা দরকার– ওই রাজ্যগুলো থেকে বিজেপি কংগ্রেসকে ওয়াইপআউট করেছিল কিনা, নাকি বাস্তবে কংগ্রেস দুর্বল ছিল– ওই আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, কর্ণাটকে কংগ্রেস যে বিজয় লাভ করেছে এবং এ বিষয়ে ভারতের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া, সোশ্যাল ফোরামে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাতে একটা বিষয় এ মুহূর্তে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে– ভারতের আগামী ২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি জোটের বিপরীত জোটে নেতৃত্বে কংগ্রেসই থাকবে। অর্থাৎ দুটো জাতীয় দলের নেতৃত্বেই ভারতের আগামী রাজনীতি আবর্তিত হবে। যেকোনও দেশের রাজনীতি বাস্তবে ওই দেশের যে দুটো বা তিনটে জাতীয় দল থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণেই দেশের সার্বিক রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত।

জাতীয় রাজনৈতিক দল, তা সে ডানপন্থি হোক আর বামপন্থি হোক– তাদের চিন্তার ভেতর সবসময়ই দেশের সমগ্র মানুষ থাকে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়নও তারা সামগ্রিক দেশ ও মানুষকে মাথায় রেখে করার চেষ্টা করে। এবং এই ধরনের জাতীয় রাজনৈতিক দল, যারা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, তারা সাধারণত দেশকে চরম বিশৃঙ্খলতার পথে নিয়ে যায় না।

তবে তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটা দুর্ভাগ্য হলো– কোনও একটি জাতীয় দল বা তার নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রক্ষমতাসহ নানা অস্ত্র ব্যবহার করে তাঁর প্রতিপক্ষ জাতীয় দলটিকে নিঃশেষ করার বা ধ্বংস করার সার্বক্ষণিক চেষ্টা করে। তারা মনে করে, এই ধ্বংস করার কাজে তারা অবশ্যই সমর্থ হবে। এবং প্রতিপক্ষকে এভাবে ধ্বংস করেই তারা দীর্ঘদিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকতে পারবে। বা প্রতিপক্ষের রাজনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারবে।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গত সাত আট দশক ধরে যে গণতন্ত্র চলছে সেখানে এই ধ্বংস করার চেষ্টাটি সব দেশেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো– কেউ কাউকে ধ্বংস করতে পারছে না। হয়তো সাময়িকভাবে কেউ ১০, ১৫, ২০ বছরের জন্য এককভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে। এই সময়টুকু ব্যক্তিজীবনে বেশ লম্বা সময়, কিন্তু একটি জাতীয় জীবনে অতি সামান্য সময়। কারণ, যেকোনও জাতি বা জনগোষ্ঠীর জীবন অনেক দীর্ঘ। তাই ওই দীর্ঘ সময়ের সার্বিক বিচারে এই সময়টুকু ইতিহাসের পাতায় অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্থান পাবে। তবে গত সাত আট দশকে তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের ভেতর এই একে অপরকে ধ্বংস করার প্রতিযোগিতা ও আচরণের মধ্য দিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে– এ বিষয়টি মূলত গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, ও গণতান্ত্রিক মানসিকতার, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার বিপক্ষেই কাজ করে চলেছে।

আর এর ফলে আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠী নির্ভরতা, ধর্মীয় উগ্রতা ও অগণতান্ত্রিক মানসিকতা– রাষ্ট্র ও সমাজে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সব থেকে বড় যে বিষয়টি ঘটেছে– রাজনৈতিক দলগুলোর মূল শক্তি যে ‘রাজনৈতিক শক্তি’, যার কারণে তারা সমাজে শক্তিশালী ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় যায়– তাদের সে রাজনীতি কোনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তো পায়নি, বরং আরও দুর্বল হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সঠিক রাজনৈতিক শক্তি গড়ে না ওঠার এই একটি বড় কারণ। একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, রাজনীতিতে যেকোনও রাজনৈতিক দল তার রাজনৈতিক শক্তি অর্থাৎ সাংগঠনিক শক্তি, সময়োপযোগী বাস্তব রাজনৈতিক কর্মসূচি ও অন্যান্য বিষয়ের মাধ্যমে তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের থেকে এগিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হবে এটাই রাজনৈতিক আচরণ। এর বিপরীতে যদি প্রশাসন, ক্ষমতা, কৌশল ও ব্যবসায়িক শক্তিসহ রাষ্ট্রের নানান শক্তি ব্যবহার করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয় তাহলে বাস্তবে ওই সেখানে প্রশাসন ও ব্যবসায়িক শক্তি ক্রমে ক্রমে রাজনৈতিক শক্তির চেয়ে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে যাদের ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয় তারাও যেমন সঠিক কোনও রাজনীতি করার সুযোগ পায় না। তেমনি যারা ধ্বংস করতে চায় তাদেরও এই কাজ করতে গিয়ে প্রকৃত রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার পথ কমে যায়। যে কারণে তাদের রাজনীতিও অগ্রসর হয় না। এমনকি এই ধ্বংস করার কাজে তৃণমূলে এক ধরনের পেশিশক্তি’র প্রয়োজন হয়, আর তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে সেটা ঘটেই চলেছে। তাই দেখা যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দিন দিন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতার অবস্থান দখল করে নিচ্ছে একশ্রেণির পেশিশক্তির মানুষ।

অন্যদিকে এই ধ্বংস করার প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে ফেডারেল দেশগুলোতে অনেক বেশি আঞ্চলিক দল জন্ম নেওয়ার সুযোগ নেয়। যা ওই দেশগুলোর সার্বিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিপন্থি। তাছাড়া ছোট বড় সব দেশে জন্ম নেয় অনেক বেশি ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠী, বর্ণ, ভাষাগত এমনকি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-বহির্ভূত শক্তি উগ্র হয়ে ওঠে। এবং তারা কোনও না কোনোভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করে। এদের এই রাজনীতিতে প্রবেশ মূলত যেকোনও দেশের সমাজকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এবং এই প্রক্রিয়ার ওই সব উগ্রতার বা অশুভতার অনেক কিছু জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করে। হয়তো অনেক কনজারভেটিভ দলের পক্ষে এ ধরনের অনেক উগ্রতা গ্রহণ করা সম্ভব। কিন্তু একটা পর্যায়ে ভোটের স্বার্থে উদার রাজনৈতিক দলগুলোও গ্রহণ করে ওই সব উগ্রতা ও অন্ধত্ব।

রাজনীতির এ ধরনের আচরণের ফলে একটা বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে, আজ থেকে একশ’ বছর আগে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ওপর যে শ্রদ্ধা ও আস্থা জন্মেছিল তা সমাজে এখন আর নেই। এখন যেটা আছে তার বড় অংশ সুবিধাবাদ ও ভয়। রাজনীতিবিদদের শ্রদ্ধার থেকে ভয় করে বেশি। আর ব্যক্তিগত সুবিধার জন্যেই কেবল রাজনীতিবিদদের কাছে যায়। ভালোবাসা বা ভক্তি থেকে যাওয়ার হার অনেক কমে গেছে। এছাড়াও যেহেতু প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার ইচ্ছে থেকে সব দেশেরই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দেশের সকল মানুষের থেকে তার জন্যে সুবিধাজনক মানুষকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এর ফলে সমাজের ভালো মানুষের ভেতর ক্রমেই এক বিতৃষ্ণা জন্মে ওঠে রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি। এর ফলে আর যাহোক তারা কর্মী ও সুবিধাবাদীদের কাজে যতই জনপ্রিয় থাকুক না কেন, সামগ্রিক সমাজের শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। আজ থেকে শত বছর এমনকি ৫০ বছর আগে রাজনীতিকরা যেমন সবার কাজে পূজনীয় ছিলেন, তেমনটি আর নেই।

তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাজনীতি এই যেখানে ঢুকে গেছে এখান থেকে বের হয়ে আসা বেশ সময় সাপেক্ষ বিষয়। আর এই প্রক্রিয়ার পরিণতি কী– নিশ্চয়ই তৃতীয় বিশ্ব একদা অনেকের জন্য অনুকরণীয় মাহাথির মোহাম্মদের পরিণতি থেকে বুঝতে পেরেছেন। তবে তারপরেও তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাজনীতি এখান থেকে সহজে বের হয়ে আসতে পারার দৃশ্যমান লক্ষণগুলো এই মুহূর্তে কম। তারপরও ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে কংগ্রেসের বিজয়ের ভেতর দিয়ে অন্তত সে দেশে একটি বিষয় নিশ্চিত হতে চলেছে, ২০২৪-এর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি জোটের বিপরীতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটই থাকবে। যার ফলে দুটো জাতীয় দলের নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যেই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকবে। এটি আসলে অন্য যেকোনও ধরনের প্রতিযোগিতার থেকে অনেক বেশি সুস্থ প্রতিযোগিতা সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর তাই অন্য সব কারণ বাদ দিলেও কংগ্রেসের এই কর্ণাটক রাজ্যের বিশাল বিজয় বেশি গুরুত্ব রাখছে আগামী জাতীয় রাজনীতির জোটের নেতৃত্বের দৌড়ের বিষয়ে। যদিও বিহারের মুখ্যমন্ত্রীসহ অনেকের নেতৃত্বে এখনও কংগ্রেসকে নেতৃত্বে না রেখে জোট গড়ার চেষ্টা চলছে। তবে তারপরও বলা যায়, কংগ্রেসের কর্ণাটকের এই বিজয়, ভারতে নির্বাচনি রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলের নেতৃত্বাধীন কোনও ভিন্ন ধরনের নির্বাচনি প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করার সুযোগ অনেকটা হলেও কমিয়ে দিলো।

লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
থাইল্যান্ডে সফর দুই দেশের ফলপ্রসূ অংশীদারত্বের নতুন যুগের সূচনা করেছে: প্রধানমন্ত্রী
থাইল্যান্ডে সফর দুই দেশের ফলপ্রসূ অংশীদারত্বের নতুন যুগের সূচনা করেছে: প্রধানমন্ত্রী
‘গরমে অসুস্থ’ হয়ে মারা যাওয়া সেই শ্রমিকের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন
‘গরমে অসুস্থ’ হয়ে মারা যাওয়া সেই শ্রমিকের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ