X
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ছয় দফার মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
০৭ জুন ২০২৩, ০০:৪৩আপডেট : ০৭ জুন ২০২৩, ০০:৪৩

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙালির ওপর পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির শোষণ বঞ্চনা, নির্যাতন ও বৈষম্য আরও বেড়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে সবভাবে শোষণ করা শুরু করে। প্রথম আঘাত করে ভাষার ওপর, রক্ত দিয়ে বাঙালি মাতৃভাষার মর্যাদা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ববঙ্গে নানাভাবে অন্যায় অত্যাচার চালিয়ে যায়, মার্শাল ’ল জারি করে জনগণের অধিকার হরণ করে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, যা চলে ১৭ দিন ধরে। এই যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব বাংলা ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত।

যুদ্ধের পরিস্থিতি পূর্ববঙ্গে বাঙালির নিরাপত্তাহীনতাকে আরও প্রকট করে। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তাসখন্দ চুক্তি হয়, এ চুক্তি নিয়ে পাকিস্তানজুড়ে সমালোচনা হয় যে সামরিক শাসক আইয়ুব খান চুক্তিতে পাকিস্তানের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে। সে সময় পাকিস্তানজুড়ে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো তাসখন্দ চুক্তিসহ সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে পাকিস্তানের উভয় অংশের বিরোধী নেতৃত্বের একটি জাতীয় সম্মেলন বা কনভেনশন আহ্বান করে, যেখানে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কয়েকজন পূর্ব পাকিস্তান থেকে লাহোরে যান। এ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২১ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬০০ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। ৫ ফেব্রুয়ারি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসায় কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হয়। সাবজেক্ট কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছয়-দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন, সেখানে উপস্থিত সবাই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে, ফলে তা এজেন্ডায় রাখা হয় না। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের ফরিদ আহমদও এ প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এরমাঝেই ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি পত্রিকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এ দাবির বিরুদ্ধে প্রচার করে যে পাকিস্তানের দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন করতে ৬-দফা দাবি আনা হয়েছে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর ৬-দফা সম্পর্কে বলেন, “.....প্রদেশে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন কায়েম এবং পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য অধিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যে প্রয়োজন রহিয়াছে, তাহা সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধে প্রমাণিত হইয়াছে। . . .  পূর্ব পাকিস্তানিরা সঙ্গে সঙ্গে হইাও বুঝিতে পারিয়াছে যে দেশ রক্ষার ব্যাপারে প্রদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করিতে হইবে।  . . . প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন জাতি ও সংহতির কোনও ক্ষতি তো করিবেই না বরং পাকিস্তানকে আরও বেশি শক্তিশালী করিবে।.... পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদ কর্তৃক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে  আলোচনার পূর্বে তাসখন্দ ঘোষণা সম্পর্কে এই পর্যায়ে তিনি কোনও মতামত প্রকাশ করিবেন না।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিনিধি দল নিয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং পুরাতন তেজগাঁও বিমানবন্দরেই তিনি সাংবাদিকদের সামনে ৬-দফা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৫ কোটি মানুষের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভব নহে।’ উল্লেখ্য, লাহোর সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত ৬ দফা ছিল সংক্ষিপ্ত ও প্রস্তাব আকারে যেখানে শাসনতান্ত্রিক ফেডারেশন গঠনের সুপারিশ ছিল। ফেডারেল সরকার দেশ রক্ষা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ের দায়িত্ব পালন করিবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শাসনতন্ত্র মতে স্টেটসমূহকে আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্রের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্যারা মিলিটারি বা আঞ্চলিক বাহিনী সংরক্ষণের অধিকারদানেরও সুপারিশ করেন। তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে লাহোর সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের প্রভাবশালী একটি মহল পূর্ব পাকিস্তানের দাবি দাওয়া আলোচনা তো দূরের কথা, শুনিতে পর্যন্ত প্রস্তুত না থাকায় তিনি তাঁর প্রতিনিধিদলসহ সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিতে বাধ্য হইয়াছেন।

১৩ ফেব্রুয়ারি ছয় দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে সর্বপ্রথম বিবৃতি দেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ, আব্দুল্লাহ আল হারুন, এম এ হান্নান, জানে আলম দোভাষ, আবুল কাশেম (সাব-জজ) প্রমুখ। ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি বিবৃতির মাধ্যমে ছয় দফার প্রতি সমর্থন জানালে অনেকের নজরে আসে এবং মানুষ ছয় দফার পক্ষে সচেতন হতে শুরু করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফার সমালোচনা ও প্রত্যাখ্যান করে কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আইন ও পার্লামেন্টারি মন্ত্রী, নেজামে ইসলাম ৬-দফার বিপক্ষে বক্তব্য দেয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহসহ ৫ জন বিরোধী দলীয় নেতাকে আটক করা হয়। ওই দিন শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ অফিসে সংবাদ সম্মেলন করে ৬-দফার বিষয়বস্তুর ওপর বিশদ ব্যাখ্যা দেন।

১৯৬৬-এর ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভায় ৬-দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত আওয়ামী লীগের এই ৬-দফার দলীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সহকারে পুস্তিকা প্রকাশ করে তা দেশবাসীর মধ্যে বিতরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ১৮, ১৯, ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অুনষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকেই ৬-দফা আওয়ামী লীগের দলীয় ইশতেহারে পরিণত হয়।

নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ ৬-দফাকে সমর্থন জানিয়ে সভা করে বক্তব্য দেয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম লালদিঘি ময়দানে প্রথম জনসভা করে ছয়-দফার পক্ষে জনমত গঠন শুরু করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৬ দফার পক্ষে দেশের বিভিন্ন জেলায় জনসভা শুরু করেন এবং জনসমর্থন পেয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিটি জেলায় ছাত্রলীগ জনসমর্থন আদায়ে কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল, ছাত্রলীগ কর্মীরা ৬-দফার আন্দোলনকে বেগবান করতে দারুণ ভূমিকা পালন করেছিল।

১৯৬৬ সালের ৯ মার্চ ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ‘৬-দফা দাবি আমাদের জীবন মরণ প্রশ্ন।’ ১১ মার্চ ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের জেলা কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে বৃহত্তর সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।

১৯৬৬-এর ১৮-২০ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ৬-দফা কর্মসূচি সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয় এবং এই ৬-দফা বাস্তবায়নে কাউন্সিলরগণ যেকোনও ত্যাগ স্বীকারে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করে। কাউন্সিল সভায় শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ কাউন্সিল অধিবেশনে ৬-দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে ৬-দফার ব্যাখ্যাসহ “আমাদের বাঁচার দাবি ৬-দফা’ এ নামে একটি পুস্তিকা বের  করা হয়। যা সারা দেশে নেতাকর্মীদের মাঝে প্রচার করা হয়।
এদিকে মার্চ মাসে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে এক সভায় প্রকাশ্যে ৬-দফার  সমালোচনা করে এবং পূর্ব বাংলার গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খানও ৬-দফার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৬-দফা দাবি নিয়ে জনসমর্থন পেতে সারা দেশে জনসভা চালাতে থাকেন এবং ব্যাপক সাড়া পান। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও দারুণভাবে মাঠে কার্যক্রম চালিয়ে যায়। কয়েক মাসেই অনেক সভা-সমাবেশ করেন। ১৯৬৬-এর ১১ এপ্রিল দিনাজপুরে জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন,‘ ৬-দফা প্রশ্নে আপস নাই।’

পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ৬-দফার প্রচার ঠেকাতে উঠেপড়ে লাগে এবং বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও গ্রেফতার করে। ৬-দফার প্রচারাভিযানে তাঁকে ৩ মাসে ৮ বার আটক করা হয়। এর মাঝে ২৯ এপ্রিল কুমিল্লার জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিব ঘোষণা করেন যে ৬-দফাই আমাদের মুক্তির একমাত্র পথ। এরপর ৮ মে তিনি গ্রেফতার হন, তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় ১২টির বেশি মামলা করেছিল তৎকালীন সরকার এবং প্রায় ৩ বছর একনাগাড়ে কারান্তরীণ থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতারের ফলে সারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হয়। অল্প সময়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬-দফা হয়ে উঠে বাঙালির প্রাণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এই দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়।

বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে, নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারা পূর্ববঙ্গে ১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ দিবস পালন ও সভা-সমাবেশ করে। সারা পূর্ব বাংলার জনগণ এসব জনসভায় ৬-দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে এবং ঘোষণা করে যে জেল-জুলুম ও ধরপাকড়ের সাহায্যে আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে না। সারা পূর্ব পাকিস্তানে জনগণ যেকোনও ত্যাগের বিনিময়ে এই আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা করে এবং অঙ্গীকার করে যে এ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শেষ হবে ৬-দফার পূর্ণ বাস্তবায়নের পর। এরূপ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকায় আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় ৩০ মে, যেখানে ৬-দফা বাস্তবায়নের নীতি অব্যাহত রাখা, ৭ জুন সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তান সরকার তখন শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে দমাতে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর মোনায়েম খান এক বিবৃতিতে ৬-দফার আন্দোলন কঠোর হস্তে দমনের হুমকি প্রদান করে। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সরকারের হুমকি গ্রেফতার উপেক্ষা করে হরতাল কর্মসূচি পালন করতে সারা প্রদেশে সভাসমাবেশ, মশাল মিছিল ও বিভিন্ন প্রচারপত্র বিলি চালিয়ে যেতে থাকে। ২ জুন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে আটক করা হয়। পাকিস্তানি সরকার ব্যাপক ধরপাকড় করে এবং পত্রপত্রিকার ওপর অঘোষিতভাবে কঠিন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, সেসময় ইত্তেফাক ব্যতীত অন্য কোনও পত্রিকায় ৭ জুনের হরতালের খবর প্রকাশ না করলেও সারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ৭ জুনের হরতালের কর্মসূচি জেনে যায়।

পূর্ব ঘোষিত ৭ জুন হরতাল পালনে বঙ্গমাতা বেগম মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি গোপনে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিকনির্দেশনাসহ নানা সহযোগিতা করেছেন। তবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও হরতাল প্রতিহত করতে দমননীতি গ্রহণ করেছিল কিন্তু জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ঠেকাতে পারেনি। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে অভূতপূর্বভাবে হরতাল পালিত হয়েছিল। সমগ্র প্রদেশ সেদিন অচল হয়ে যায়; কলকারখানা, দোকানপাট, গাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এই হরতালে পূর্ব বাংলার আপামর খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে বিনা উস্কানিতে পুলিশ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। ঢাকার তেজগাঁও, ডেমরা, , টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, আদমজিসহ পূর্ব বাংলার অনেক স্থানে পুলিশের নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, আবুল হোসেনসহ ১১ জন নিহত হয় এবং দেড় হাজার মানুষকে আটক করা হয়। এমন হরতাল এর আগে কখনও পূর্ব পাকিস্তানে হয়নি এবং এত হতাহতের ঘটনাও আগে ঘটেনি। এই ৭ জুনের হরতাল পূর্ব পাকিস্তানের জনমানুষকে আরও বেশি অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতে শক্তি দেয়। রাওয়ালপিন্ডিতে ৮ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ ও ঢাকায়  অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের সদস্যরা ৭ জুন হরতালে গুলিবর্ষণ ও সরকারের দমননীতির তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বিরোধীদলের মূলতবি প্রস্তাব অগ্রাহ্য হলে সদস্যরা প্রতিবাদে ওয়াক আউট করে।  

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর সরকার দমনপীড়ন বাড়িয়ে দেয় কিন্তু আওয়ামী লীগ পিছপা হয়নি। সরকারের নির্যাতনের মাত্রা বাড়লেও আন্দোলন ও প্রতিবাদ চলতে থাকে। হরতালে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ আওয়ামী লীগকে শক্তি ও প্রেরণা দেয়। এরই মাঝে ১৯৬৬-এর ১৬, ১৭, ১৮ জুন আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করে। সরকার নির্যাতনের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অব্যাহত রাখে তবে ৬-দফা আন্দোলন থেমে থাকেনি বরং তা জনগণের দাবিতে পরিণত হয়। দিন দিন ৬-দফার পক্ষে জনমত বাড়তেই থাকে।

৬-দফার আন্দোলন নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’-এর ৭৩ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “ছয় দফা যে পূর্ব বাংলার  জনগণের প্রাণের দাবি-পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণি যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরিব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবে না, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামগঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনও শাসকের চক্ষুরাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণির ছয় দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত। .... ... যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কালো রাস্তা লাল করলো, সেই রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ”

এরপর একই বইয়ের ৮৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেন, “৬ দফার বাস্তবায়নের সংগ্রাম আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে তাও ঘোষণা করেছে। এখন আর আমার জেল খাটতে আপত্তি নাই, কারণ আন্দোলন চলবে। ”

১৯৬৬ সালের ২৩ ও ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ব্যক্ত করা হয় যে শাসক মহল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা গ্রহণের মাত্রা যত বৃদ্ধি করছে, জনগণের সহানুভূতি তত বেশি আওয়ামী লীগ লাভ করছে এবং শেখ মুজিব প্রদত্ত ৬-দফার আন্দোলন তত বেশি গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে যাচ্ছে। এই সভায় পূর্ব পাকিস্তানের সব জেলা ও গ্রামে ৬-দফা আদায়ে জনমত সৃষ্টির জন্য কাজ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। সারা দেশে এই আন্দোলন তীব্রতর হয়। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন জেলায় জনসভা করে ৬-দফার পক্ষে জনমত বাড়াতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান সরকার স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে দেশদ্রোহী বলে প্রচার চালায় কিন্তু জনভিত্তি পায়নি। বাংলার জনগণ ঠিকই ৬-দফার পক্ষে অবস্থান নেয়।

আওয়ামী লীগ সারা পূর্ব বাংলাব্যাপী ১৯৬৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৬-দফার দাবি দিবসের কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করে। ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬-দফার আন্দোলন চালিয়ে যাবার পক্ষে দৃঢ় মত ব্যক্ত করা হয়। এরমধ্যেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ৬-দফার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে ভাষণ দেয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ নিয়ে জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলামসহ আরও কয়েকটি দল নিয়ে ২ মে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা পিডিএম নামক বিরোধী জোট গঠন করা হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যুক্ত হয়নি। এই পিডিএম ৬ দফার পাল্টা ৮ দফা পেশ করে যা আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করে। ৩ মে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, ৮ দফা আওয়ামী লীগের ৬ দফার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। যদিও আওয়ামী লীগের একটা অংশ ৮ দফার পক্ষ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টির চেষ্টা করে। কারণ ১৯৬৭ সালের ২১ মে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা ৮ দফার প্রতি সমর্থন জানালেও জেলা ও মহকুমার বেশিরভাগ নেতারাই ৬ দফার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তাই ২২ মে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটি ৬ দফার সংগ্রাম জোরদার করার ঘোষণা দেয়। তৃণমূল নেতৃত্ব সেদিন বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষ নিয়েছিল। সাধারণ কর্মী সমর্থক ও জেলা-মহকুমার নেতাদের সমর্থনে ৮ দফার ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়।

অবশ্য ২১ মে এর আগে জেলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন, বঙ্গবন্ধু তাদের ৬ দফার ব্যাপারে আপস হবে না বলে জানান এবং বলেন, পিডিএমে যোগদান করতে পারে না ওয়ার্কিং কমিটি। ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ৭ জুন সারা দেশে পালন করে, যদিও সরকার আগেই কয়েক স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল এবং গ্রেফতার করে অনেককে। সরকারের দমন নীতি উপক্ষো করে সারা দেশে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ছাত্রসমাজ ৬ দফার পক্ষে ও সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। ৬-দফা ভিত্তিক গণজোয়ার শাসকশ্রেণিকে শঙ্কিত করে তোলে, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকলেও ৬ দফার প্রশ্নে তিনি ও দলের কর্মীসমর্থক যে আপসহীন তা পাকিস্তান সরকার টের পেয়ে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের এক নম্বর দুশমন বলে চিহ্নিত করে, এমনকি আওয়ামী লীগকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু কোনও কিছুই ৬ দফার জনসমর্থনকে দুর্বল করতে পারেনি। উল্টো পশ্চিম পাকিস্তান সরকার শঙ্কিত হয়ে পড়ে, তাই তারা নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানাবার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। গোপনে তাঁকে ঢাকা জেলখানা থেকে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও প্রথম কয়েক দিন কেউ জানতে পারেনি বঙ্গবন্ধুকে কোথায় রাখা হয়েছে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১ নম্বর আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয় পাকিস্তানের আইয়ুব খান সরকার। এই ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ মামলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরও ৩৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই খবর প্রচারের পর আওয়ামী লীগ ১৯৬৮-এর ২১ জানুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির এক জরুরি সভা করে এবং সভায় শেখ মুজিবকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগসহ দেশের প্রচলিত আদালতে বিচারকার্য ফিরিয়ে আনার দাবি করে।

ছাত্রসমাজ শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করে।  এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে বঙ্গবন্ধু ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন বা স্বাধীন করার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং আগরতলায় কর্মরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। বঙ্গবন্ধুসহ বাকিদের বিচারের জন্য ক্যান্টনমেন্টে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯-এ জুন বিচারকার্য শুরু হয়, ট্রাইব্যুনালে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বঙ্গবন্ধু নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তিনি তাঁর জবানবন্দিতে বলেছিলেন, “ . . . কেবল আমার ওপর নির্যাতন চালাইবার জন্য এবং আমার দলকে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও আমাদিগকে কুখ্যাত করিবার জঘন্য মনোবৃত্তি লইয়া আমাকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা জড়িত করা হইয়াছে। ৬-দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চাকরির সংখ্যা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমতার ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা এবং নিষ্পেষণ করাই ইহার মূল উদ্দেশ্য।” তিনি আরও বলেন, “আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। ইহা একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল- দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যাহার একটি সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত নীতি ও কর্মসূচী রহিয়াছে। আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কদাপি আস্থাশীল নই। আমি দেশের উভয় অংশের জন্যে ন্যায়বিচার চাহিয়াছিলাম- ৬-দফা কর্মসূচিতে ইহাই বিধৃত হইয়াছে। দেশের জন্যে আমি যাহাই করিয়াছি ভাবিয়াছি আমি সর্বদাই তাহা নিয়মতান্ত্রিক গণ্ডির ভিতরে জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছি এবং এই নিমিত্ত আমাকে সর্বদাই শাসকগোষ্ঠী এবং স্বার্থবাদীদের হাতে নিগৃহীত হইতে হইয়াছে। তাহারা আমাকে ও আমার প্রতিষ্ঠানকে দমন করিয়া পাকিস্তানের জনগণের, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ ও নিষ্পেষণ অব্যাহত রাখিতে চায়।”

তিনি আরও বলেছিলেন, “আমার উক্তির সমর্থনে আমি মহামান্য আদালতে আরও নিবেদন করতে চাই যে আমাকে প্রতিহিংসাবশত মিথ্যা এই মামলায় জড়িত করা হইয়াছে। . . .বর্তমান মামলা উল্লিখিত নিষ্পেষণ ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নহে। অধিকন্তু স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক শোষণ অব্যাহত রাখার যে ষড়যন্ত্র জাল বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিস্তার করিয়াছে এই মামলা তাহারই বিষময় প্রতিক্রিয়া।. . .  . . . . আমি নির্দোষ এবং এ ব্যাপারে পরিপূর্ণরূপে অজ্ঞ। তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।”

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয় যতই প্রকাশ্যে আসতে থাকে, বাংলার জনগণ ততোই বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী হতে থাকে। তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই মামলা প্রহসনমূলক ও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্দেশ্যে দায়ের করা হয়েছে। পূর্ব বাংলার জনগণ তখন হয়ে উঠে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদী। ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে এবং গঠন করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধু ৬-দফাকে অন্তর্ভুক্ত করে, মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করাসহ ১১ দফা দাবি এক ইশতেহারের মাধ্যমে পেশ করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। ১৯৬৮ এর নভেম্বর থেকে ১৯৬৯ এর মার্চ পর্যন্ত সারা পূর্ব বাংলায় প্রবল গণবিদ্রোহ হয় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও ৬-দফার পক্ষে; সারাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সারা বাঙলার ছাত্র-জনতা রাস্তায় বিক্ষোভ করে। সারাদেশে শুরু হয় তীব্র গণআন্দোলন। সর্বত্র উচ্চারিত হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করো, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’; ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো শেখ মুজিবকে আনবো’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ৬-দফা, ১১-দফা, মানতে হবে, মানতে হবে।’ পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, ৬-দফার দাবি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ হয়। ১৯৬৯ এর ১১ই ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদে আহ্বানে ‘শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। অগ্নিগর্ভ পূর্ব বাংলায় গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। আইয়ুব খানের ভীত নাড়িয়ে দেয় বাংলার ছাত্র-জনতা। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তিদান ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, অত্যন্ত গোপনীয়তায় ২২-এ ফেব্রুয়ারি দুপুরে একটা সামরিক জিপে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ধানমন্ডির বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়, বাকিরাও মুক্তি পায়।

২৩-এ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। গণআন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হলে ২৫-এ মার্চ আরেক সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ  করে। পাকিস্তানে দ্বিতীয় সামরিক শাসন জারি পূর্ব পাকিস্তানে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। এদিকে ২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে রাওয়ালপিন্ডি যান, যাবার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় স্পষ্টভাবে জানান যে, ৬-দফা ভিত্তিক ১১ দফা দাবি মানা না পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে কোনও আপস তিনি করবেন না। এদিকে ইয়াহিয়া খান নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান, তিনি হয়ে যান প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক প্রশাসক এবং সর্বাধিনায়ক। ১৯৬৯-এর ৪ আগস্ট একটি বেসামরিক মন্ত্রিসভা গঠন করে, এই মন্ত্রিসভায় সবাই ছিলেন সামরিক জান্তার বিশ্বস্ত লোক।  নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা দেখা যায়নি।

১৯৬৯-এর নভেম্বরে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যান, সেখানেও তিনি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। আর প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু হবার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দলকে সুসংগঠিত করতে গ্রামগঞ্জে সভা-সমাবেশ চালিয়ে যান। তিনিই হয়ে উঠেন আওয়ামী লীগ ও জনগণের মহান নেতা। ১৯৭০-এর ৬ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের সময় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠানের দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, ‘৬-দফা বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোনও বিকল্প পথ নেই। একইভাবে জুনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু বলেন, আওয়ামী লীগ চায় জনগণের মুক্তি। ৬-দফার প্রয়োজনে সবকিছু ত্যাগ করতে আমি প্রস্তুত। . . . কোনও অবস্থাতেই আমি আপস করবো না।’’

১৯৭০-এর ৮ জুন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের বিশাল জনসমাবেশে একটাই স্লোগান ছিল-বাঙালির বাঁচার দাবি ৬-দফা কায়েম করতে হবে। বঙ্গবন্ধু এ জনসভায় সংগ্রামের জন্য সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এরপর বঙ্গবন্ধু সারা পূর্ব পাকিস্তানে চষে বেড়ান। তিনি জনগণের পূর্ণ সর্মথন পেয়ে যান এবং ঘোষণা করেন, এবারের নির্বাচন বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। ৬-দফা কায়েম করতেই হবে। এভাবেই ৬ দফা হয়ে উঠে বাঙালির প্রাণের দাবি। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইস্যু ও স্লোগান হয়ে উঠে ৬ দফা। কারণ, ৬-দফার আলোকে রচিত হয় আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার। এই ৬-দফাই রূপ নেয় বাঙালির মুক্তির সনদে। ৬-দফার প্রতি সমর্থন জানিয়েই পূর্ব বাংলার জনগণ আওয়ামী লীগকে ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিপুল জয় এনে দেয়। এ বিজয় ছিল পাকিস্তানি শোষণ বঞ্চনা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে, এ বিজয় ছিল ৬-দফার পক্ষে ও বাঙালির মুক্তি অর্জনের সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে। জনগণের এই ম্যান্ডেটই বঙ্গবন্ধুকে বাঙালিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করতে বৈধতা প্রদান করেছিল। জনগণ যে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখেছিল তার প্রমাণই হলো ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়। ফলে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করছিলেন, তার শেষ অংশের শুরু ছিল এই ৬-দফা, যা তিনি নিজে প্রণয়ন করেছিলেন। কারণ, দফা ৬টা হলেও আসল দফা ছিল একটা- সেটা হলো স্বাধীনতা, যার প্রমাণ আমরা পাই মাত্র ৫ বছর পর। ৬-দফা পূর্ব পাকিস্তানের সব মানুষকেই ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল কারণ পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর ১৯৪৭ সাল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে চলা নানা শোষণ, নির্যাতন অবিচার এবং দমননীতির বিরুদ্ধে ৬-দফার মাধ্যমে বাঙালি নিজের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ৬-দফা আন্দোলন বাঙালিকে বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শক্তি দেয়, বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহস দেয়। ৬-দফা বাঙালির ‘ম্যাগনা কার্টা’য় পরিণত হয়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই ৬-দফার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনসাধারণ শোষণ নির্যাতন বৈষম্য, বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে, পরাধীনতা থেকে মুক্তির নবজোয়ার সৃষ্টি করে এবং পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। ১৯৬৬-এর ৬ দফার পর থেকে সব আন্দোলন-সংগ্রামেই ৬-দফা দাবি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল এবং মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছিল যে ৬ দফা বাস্তবায়ন হবে অপশাসনের অবসান হবেই, কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আসবেই। তাই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক অধ্যায়ের মধ্যে এই ৬-দফা দাবি অন্যতম।  

১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়ী হবার পর ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন অর্থাৎ ৬-দফা বাস্তবায়নের শপথ নেন। পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন, বাঙালি জাতিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেন এবং ১৯৭১-এর ৭ই মার্চে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। জাতির পিতার নির্দেশে বাঙালি সশস্ত্র গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করে স্বাধীনতা। ৬ দফা দাবি ঘোষণার ৫ বছর পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্বে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র- বাংলাদেশ।

আজকের দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা বেগম মুজিব, ৬-দফার দাবি আদায়ে ৭ জুন শহীদ ১১ জনসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও কলামিস্ট।

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থ-
১. কারাগারের রোজনামচা-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  
২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি, প্রথম খণ্ড। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত।
৩. বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা- শেখ হাসিনা। ২০২০ সালের ৭ই জুন তারিখে প্রকাশিত।
৪. ঐতিহাসিক ৬-দফা দিবস উপলক্ষে¨ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ। (তারিখ: ০৭.০৬.২০২২)
৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ-এম এ ওয়াজেদ মিয়া।
৬. আমাদের বাঁচার দাবি, ৬ দফার ৫০ বছর-হারুণ অর রশিদ।
৭. বঙ্গবন্ধু ... ৬ দফা থেকে স্বাধীনতা,- ড. আনু মোহাম্মদ।
৮. ছয় দফার ইতিহাস- এস এম শহিদুল্লাহ।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের অধ্যায়
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের অধ্যায়
ত্বক তারুণ্যদীপ্ত দেখানোর ৮ টিপস 
ত্বক তারুণ্যদীপ্ত দেখানোর ৮ টিপস 
আসছে না পাকিস্তান, প্রথমবার খেলবে উগান্ডা 
আসছে না পাকিস্তান, প্রথমবার খেলবে উগান্ডা 
‘গডফাদার’ স্রষ্টাকে শুরুতে ৪, শেষে ৭ মিনিটের করতালি
কান উৎসব ২০২৪‘গডফাদার’ স্রষ্টাকে শুরুতে ৪, শেষে ৭ মিনিটের করতালি
সর্বশেষসর্বাধিক