X
বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫
৫ চৈত্র ১৪৩১

‘এল নিনো’ এবং বাজেট ভাবনা

মুনেম আহমদ চৌধুরী
০২ আগস্ট ২০২৩, ১৭:১৪আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২৩, ১৭:১৪

‘এল নিনো’ শব্দের অর্থ ছোট ছেলে, এটি মূলত স্প্যানিশ ভাষার শব্দ। স্বাভাবিক  অবস্থায় বাণিজ্যবায়ু (ট্রেড উইন্ড) প্রশান্ত মহাসাগরে নিরক্ষরেখা বরাবর পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। এটি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে উষ্ণ জল এশিয়ার দিকে নিয়ে আসে। এই উষ্ণ জলের পরিবর্তে সেই স্থলে ঠান্ডা জল সমুদ্র গভীর থেকে উত্থিত হয়। এল নিনোর সময়, পশ্চিমমুখী বাণিজ্যবায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। বায়ুচাপ এবং বাতাসের গতির পরিবর্তনের কারণে উষ্ণ পৃষ্ঠের জল নিরক্ষরেখা বরাবর পূর্বদিকে, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে চলে যায়। উষ্ণ জলের আধিক্য ঠান্ডা জলের স্বাভাবিক উত্থান ঘটতে দেয় না। যার ফলে মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের অস্বাভাবিক উষ্ণতা লক্ষ করা যায় এবং বায়ুমণ্ডলীয় প্যাটার্নে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভারতীয় উপমহাদেশে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া। ইউএস ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনুসারে এল নিনো গড়ে প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছরে ঘটে এবং শক্তিতে পরিবর্তিত হয়। সর্বশেষ শক্তিশালী এল নিনো ছিল ২০১৬ সালে। সে বছরই পৃথিবীতে গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ অনুভূত হয়েছিল। জার্নাল অব সায়েন্সে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, এল নিনো সংঘটিত হওয়ার পরের ৫ বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ক্ষতি হতে পারে। যা একুশ শতকের শেষ নাগাদ গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৮৪ ট্রিলিয়ন ডলারে।

করোনা মহামারির প্রভাব, ডলার ঘাটতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান সংঘাত এমনিতেই বিশ্ববাজারে সংকট ও মন্দাভাব সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে তীব্র জ্বালানি সরবরাহে সংকট, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি এবং রিজার্ভ ঘাটতির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চলমান তাপপ্রবাহ। এমতাবস্থায় এল নিনোর প্রভাব যে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও তাঁতিয়ে দেবে তা সহজে অনুমানযোগ্য। তবে প্রশ্ন আসতে পারে, এল নিনো কি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও খারাপ করতে পারে? বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এল নিনোর সংঘটিত হওয়ার বছরগুলোতে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রায় ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এল নিনো পর্যায় শুরু হয়ে গেছে এবং বছরের শেষ নাগাদ যদি এর প্রভাব প্রকট আকার ধারণ করে, তবে তা বিশ্বনেতাদের প্রতিশ্রুত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পর্যায়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, প্যারিস এগ্রিমেন্টে বিশ্বনেতারা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন যে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

তীব্র দাবদাহ যেমন জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে, তেমনই চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে জ্বালানি সংকটকে জটিল করছে। এল নিনোর প্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪, বিগত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ফলশ্রুতিতে বিদ্যমান দাবদাহ অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে। এতে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পাওয়া, প্রতি ইউনিটে শীতাতপযন্ত্র ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে লোডশেডিংয়ের সময় বর্ধিত হতে পারে। এছাড়া জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হলে রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে। ফলে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে প্রধানত জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অভাব দেখা দিতে পারে।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এল নিনোর প্রভাবে অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে খরা দেখা যেতে পারে এবং ভারত তথা এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেতে পারে। বৃষ্টিপাত হ্রাস খাদ্য উৎপাদনকে ব্যাহত করবে। এর প্রভাব আঞ্চলিক খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। কৃষিজ উৎপাদন হ্রাস এ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় করা কঠিন হয়ে পড়বে। জীবিকার ভারসাম্য রক্ষায় তাদের হয়তো প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ক্রয় করা কমাতে হবে, অথবা আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে  হবে। এটি দেশের বিদ্যমান আয় বৈষম্যতাকেও বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ, মূল্যস্ফীতির ফলে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে ধনিক শ্রেণি ক্রয় থেকে পিছপা হবে না। এর ফলে শুধু দু’শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতার বৈষম্য নয়, ভোগ বৈষম্যও বৃদ্ধি পাবে। ফলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ তখন নিজেকে আরও বেশি দরিদ্র বলে অনুভব করবে।

খাদ্য সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়া, এসব কিছু একসঙ্গে মিলে সমাজে টানাপোড়েন বৃদ্ধি পেতে পারে। তাছাড়া অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, আকস্মিক বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ঘটার পরিমাণ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে উপকূলীয় জনজীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং সরকারের দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার ব্যয়ও বৃদ্ধি  পাবে।

উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো এল নিনো সম্পর্কিত জলবায়ুর ক্ষতিকারক প্রভাব হ্রাসের জন্য এখন থেকেই তোড়জোড়ে কাজ শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পেরুর সরকার জলবায়ু পরিবর্তন ও বিরূপ আবহাওয়া মোকাবিলার জন্য প্রায় ১.০৬ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। এই উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের লক্ষ্য হলো এল নিনোর সঙ্গে সম্পর্কিত জলবায়ু পরিবর্তন এবং আবহাওয়ার ঘটনা– এ উভয় থেকে উদ্ভূত ক্ষতিকর পরিণতিগুলোকে সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা করা এবং প্রশমিত করা।

যেখানে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩-২৪ মৌসুমে তাপমাত্রা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং বিশ্ব জলবায়ু ভঙ্গুর অবস্থায় পতিত হতে পারে, সেখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে আমাদের নীতিনির্ধারকরা বর্তমান বাজেটে এ বিষয়কে মাথায় রেখেছেন কি? সম্ভবত না।

চলমান অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৩-২৪ এ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং এর তীব্রতা কমাতে বাংলাদেশ সরকার ৩৭ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে। বাজেট নথি অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রস্তাবিত বরাদ্দ কমেছে ১৬৭.২৩ কোটি টাকা। অথচ আমাদের সামনে সুবর্ণ সুযোগ ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে এল নিনো সম্পর্কিত জলবায়ু পরিবর্তনকে আমলে নিয়ে জলবায়ু বাজেট প্রণয়ন করা এবং তা দিয়ে বিশ্ববাসীর সম্মুখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে জলবায়ু-সহনশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য, সরকার তাদের বার্ষিক বাজেট পরিকল্পনায় এল নিনোর আসন্ন প্রভাব বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এল নিনো  একটি জলবায়ু ঘটনা যা প্রশান্ত মহাসাগরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বেশি উষ্ণতার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, যা বাংলাদেশের আবহাওয়ার ধরন এবং কৃষি উৎপাদনশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, সঙ্গে শিল্পের উৎপাদনের ওপরও।

আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা হচ্ছে এটি ১৯৯৭-৯৮ সময়কার সুপার এল নিনোর মতো ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া এল নিনোর ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সৃষ্ট তীব্র ঝড়, তাপপ্রবাহ, দাবানল, বন্যা, তুষারপাত এবং খরার মতো ধ্বংসাত্মক বিপর্যয়গুলো অসংখ্য প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি এবং যথেষ্ট আঘাতের কারণ হয়েছিল। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী সংশ্লিষ্ট ক্ষতির অনুমান আর্থিক মূল্য ৩২ বিলিয়ন থেকে ৯৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ছিল।

২০০০ সালে প্রকাশিত “বাংলাদেশে ১৯৯৭-৯৮ এল নিনো ইভেন্টের প্রভাব, প্রতিক্রিয়ার এবং কৌশল মূল্যায়ন” শীর্ষক এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৯৭-৯৮ এল নিনোর কারণে বাংলাদেশে ৬০% বৃষ্টিপাতের ঘাটতি হয়েছিল। যার ফলে এ দেশ স্বল্প সময়ের জন্য খরা, কৃষি উৎপাদনে হ্রাস (আমন ধান উৎপাদনে ২৫-৩০% হ্রাস), খাদ্য সংকট, চালের উচ্চ মূল্য, রাজস্ব হ্রাস, মূল্যস্ফীতি এবং উন্নয়নের জন্য সরকারের বাজেট হ্রাস- এসব আর্থসামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল।

সেক্ষেত্রে বৈশ্বিক এই দুর্যোগকে বিবেচনায় রেখে জলবায়ু বাজেট করা কতটা দরকার তা এখনই ভাবার সময় এসেছে। পেরুর অর্থমন্ত্রী অ্যালেক্স কনটেরাস হিসাব করেছেন, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে জলবায়ু জনিত অর্থনৈতিক প্রভাব পেরুর মোট জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। ২০২২ সালের জিডিপি অনুসারে যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ৪ বিলিয়ন ডলারে। আর এল নিনো সৃষ্ট জলবায়ু পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পেরু সরকার বরাদ্দ করেছে ১.০৬ বিলিয়ন ডলার। যা প্রাক্কলিত সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির ২১.৮৬%। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশও তার সম্ভাব্য ক্ষতির ২০ শতাংশ বিনিয়োগের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এর পাশাপাশি অতীত অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে এবং দীর্ঘমেয়াদে এল নিনোর সম্ভাব্য প্রভাবকে আমলে নিয়ে কোন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা যায় তা নিয়ে এখন থেকে কাজ শুরু করা। এ বিষয়ে যত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে দেশের জন্য ততই মঙ্গল।

লেখক: গবেষক (অর্থনীতি বিভাগ), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট, ঢাকা ।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় নতুন করে স্থল অভিযানও শুরু করেছে ইসরায়েল
গাজায় নতুন করে স্থল অভিযানও শুরু করেছে ইসরায়েল
ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত ছাত্রদল নেতার মৃত্যু
ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত ছাত্রদল নেতার মৃত্যু
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র করে লাভ হবে না: আমিনুল হক 
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র করে লাভ হবে না: আমিনুল হক 
চট্টগ্রামের রাউজানে বিএনপির দুই গ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষ, একজন গুলিবিদ্ধসহ আহত ১৫
চট্টগ্রামের রাউজানে বিএনপির দুই গ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষ, একজন গুলিবিদ্ধসহ আহত ১৫
সর্বশেষসর্বাধিক