X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

উমর ফারুক
০২ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:৪৬আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:৪৬

অনুমান করা হয়, বিশ্বের প্রায় ৭০শতাংশ জ্ঞান ও সম্পদ ইহুদিদের দখলে। কিন্তু কেন? কারণ, একটি ইহুদি শিশুর যত্ন শুরু হয় মাতৃগর্ভে, শিশু জন্মানোরও আগেই। অধিকাংশ পরিবার সন্তান ধারণে আগ্রহী ও সন্তানসম্ভবা নারীদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে। তাদের আনন্দে রাখার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়, ১১ বছর বয়স পর্যন্ত একটি শিশুকে পড়ার জন্য কোনও চাপ দেওয়া হয় না। সে তার মতো করে বেড়ে ওঠে। কাদামাটি দিয়ে খেলে। ছবি আঁকে। বন্ধুদের সাথে মেশে। এসব।

লেখার শুরুতে ইহুদিদের নাম ব্যবহার করায় কেউ কেউ মন খারাপ করতে পারেন। ক্ষমা করবেন। আমিও ইহুদিদের অনেক কিছু পছন্দ করি না। তবে তাদের মেধা ও জ্ঞান অসাধারণ, যা আমাকে জানান দেয় কখনও কখনও। এবার চলুন জাপানের কথা বলি। বিশ্বের সবচেয়ে বিনয়ী জাতি জাপান। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, তথ্য-প্রযুক্তি, সবটাতেই তাদের জুড়ি মেলা ভার; কিন্তু এই জাপানি জাতিও তাদের শিক্ষাব্যবস্থা বদলে ফেলেছে। ‘জানালার ধারে তত্ত্বচান’ বইটা একবার পড়ে দেখতে পারেন। একটি শিশুর অসাধারণ বেড়ে ওঠার গল্প। জাপানি শিশুরা পরীক্ষা দেয় না। অধিকন্তু ছোটবেলায় তারা কেবল শেখে। বিনয় শেখে। শিষ্টাচার শেখে। কীভাবে নিজের কাজ নিজে করতে হবে সেটা শেখে। নিজে জুতো পরা শেখে। নিজে খাবার খেতে শেখে। নিজে পোশাক পরতে শেখে। অন্যকে সম্মান করতে শেখে। যতটুকু জানি, জাপানি প্রাথমিক শিক্ষায় কোনও পরীক্ষা নেই। পরীক্ষা গ্রহণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

চলুন এবার ঘুরে আসা যাক ফিনল্যান্ডের দিকে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থাকে বলা হয় বিশ্বের সেরা। কিন্তু কেন? কী আছে তাদের শিক্ষাব্যবস্থায়? অথবা কী নেই? ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় সব সুযোগ-সুবিধা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। শিক্ষা সংক্রান্ত সব খরচ বহন করে সরকার। দেশের মোট বার্ষিক বাজেটের ১২.২%-এর বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় শিক্ষা খাতে। গ্রহণ করা হয় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য স্বতন্ত্র পরিকল্পনা ও পদ্ধতি। ওখানে নেই কোনও প্রথাগত নম্বর পদ্ধতি। ফিনল্যান্ডের গ্রেডিং সিস্টেমে ১০ পয়েন্টের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়। থার্ড গ্রেডের আগে স্কুলে কোনও নম্বর দেওয়া হয় না। সেভেনথ গ্রেড পর্যন্ত দেওয়া হয় মৌখিক প্রশংসাসূচক বাক্য। যেমন- আরও ভালো হতে পারে বা সুন্দর। ফিনল্যান্ডের স্কুলে কোনও নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম থাকে না। বাচ্চারা তাদের পছন্দমতো ও আরামদায়ক পোশাক পরতে পারে। স্কুল সময়ে শুতে পারে, বসতে পারে সোফায়।

তাদের বাড়ির কাজগুলোও খুব মজার; যেমন- নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে গল্প করা ও জীবনযাপন রীতির পার্থক্য তুলে ধরা। ওখানে নেই কোনও পরীক্ষা পদ্ধতি। শিক্ষক তার ক্লাসে বিশেষ প্রয়োজনে কখনও কখনও মূল্যায়ন নিয়ে থাকেন। পড়ানো হয় না কোনও নির্দিষ্ট বিষয়, বরং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার দক্ষতা তৈরি করা হয়।

প্রতি ৪৫ মিনিট ক্লাসের পর তারা পায় অন্তত ১৫ মিনিট বিরতি। ওখানে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোই ছাত্রছাত্রীদের শেখানো হয়। সাঁতার থেকে শুরু করে গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও গৃহস্থালির কাজও শেখানো হয়।  ক্লাসে রান্না, সেলাই, বোনা ইত্যাদি শেখে। পরিবেশের প্রতি যত্ন নেওয়া শেখে। ফিনল্যান্ডে স্কুল শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই একটি ওয়েবসাইট বা পোর্টফলিও তৈরি করতে পারে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ওখানকার কোনও একটি-দুটি স্কুল মানসম্পন্ন নয়। কম-বেশি সব স্কুলই সমান মানসম্পন্ন। ওখানে শিশুদের দুপুরে তাদের পছন্দের খাবার দেওয়া হয়। থাকে বছরব্যাপী নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন।

এবার ঘুরে আসা যাক আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার দিকে। তার আগে বলে নেওয়া যায়, এই যে ফিনল্যান্ডে ক্লাসে সেলাই শিখছে, সাঁতার শিখছে, পরীক্ষা হচ্ছে না, স্কুলে শিক্ষার্থীরা শুয়ে থাকছে; তবু নাকি ওই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের সেরা। ভাবা যায়! যাহোক, অনেকেই অভিযোগ করেন আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা হয় না। আমিও তাই বলি। হয় না, এবং এটাও বলি ওটা পড়ালেখা করার জায়গা নয়। ওই বয়সটা পড়ালেখা করার বয়স নয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, দেশের প্রতিনিধিত্বশীল অধিকাংশ মানুষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। চারপাশে তাকালেই দেখা যাবে। তাদের ওপর শিক্ষার অযাচিত চাপ দেওয়া হয়নি; ফলে তাদের মেধার যথাযথ বিকাশ ঘটেছে বৈকি; এবং তারা ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন ও সমাজজীবনে অনেকেই সফল হয়েছেন। বেশি পড়ালেখা হলে হয়তো তারাও অনেকেই আর দশ জনের মতো ঝরে পড়তেন।

আমাদের শিক্ষার সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ জায়গা হলো, আমরা মুখস্থবিদ্যাকে শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করতে শিখেছি। কেবল উচ্চ নম্বর প্রাপ্তিকেই মানসম্পন্ন শিক্ষা বলছি। কেবল ওখানেই আটকে আছে আমাদের শিক্ষার প্রচলিত মান। আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার এভাবেই তৈরি হয়েছে। আমাদের মায়েরা, আমাদের বাবারা, আমাদের অভিভাবকরা এভাবেই তাদের মনস্তত্ত্ব প্রস্তুত করেছেন; এবং আমরা সেভাবেই সেই রোগাক্রান্ত সমাজকে মেনে নিয়েছি ও মানছি। ছোট্ট একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, পরীক্ষা ও নম্বরের এই দৌড় প্রতিযোগিতায় আমাদের সমাজ, আমাদের শিক্ষা কী সত্যিই আলোকিত হচ্ছে? নাকি ক্রমাগত অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে? আমাদের এই চাকরিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা কি পুরো জাতিকে বিপদগ্রস্ত করছে না? কিছু বিষয় মুখস্থ করতে পারা, মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারার নাম কি শিক্ষা গ্রহণ? এটা কখনও হতে পারে? কোথায় আমাদের গবেষণা শিক্ষা? কোথায় আমাদের সৃষ্টিশীলতা? কোথায় আমাদের সৃজনশীলতা?

এ কথা সত্য, আমাদের শিক্ষায় নানাবিধ ত্রুটি আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের বাজেট কম। আমাদের আন্তরিকতা কম। সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো, স্বাধীনতার এই দীর্ঘদিনেও আমরা একটি গ্রহণযোগ্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রস্তুত ও তা গ্রহণ করতে পারিনি। কুদরত-ই খোদা শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি কোনও শিক্ষাব্যবস্থাই আমরা পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আরও বড় সংকট হলো, আমাদের দেশে কোনও উচ্চশিক্ষা নেই। যে প্রচলিত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশে বিদ্যমান ওটা আসলে উচ্চশিক্ষা নয়, ওটা টেকনিক্যাল শিক্ষা বা মুখস্থবিদ্যার আরেকটু উঁচু স্তর।

শেষ কথা হলো, আমরা কি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনকে মেনে নেবো? নাকি না? এই শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের হাজার-হাজার কোচিং সেন্টার বন্ধ হওয়ার শঙ্কা আছে। নম্বর প্রাপ্তির অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়ার শঙ্কা আছে। আমাদের প্রথাগত অশুভ পরীক্ষা পদ্ধতি বন্ধ হওয়ার শঙ্কা আছে। এত সহজে মেনে নেওয়া সম্ভব? এখন যুগ বদলেছে। এখন সময় দেশের পুরাতন, প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিকে না বলা। আশা করি, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশে সেটাই করার চেষ্টা করবে। শিক্ষাকে প্রায়োগিত ও জীবনমুখী করার চেষ্টা করবে। কোচিং নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করবে। শিক্ষাকে অনেকাংশে আনন্দময় করার চেষ্টা করবে। আরও বলা বাহুল্য, আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সংকট, আমাদের শিক্ষকদের সংকটও বর্ণনাতীত। সেসব বিষয়ও বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। সেসব সংকট সমাধানেরও দাবি রাখে।

মানতে হবে, আমাদের বিগত দিনের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল যা-তা। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাও নিশ্চিতভাবে সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তবু অপেক্ষাকৃত ভালো এই শিক্ষা পদ্ধতি নিশ্চয় আমাদের সানন্দে গ্রহণ করা উচিত। পরিবর্তিত নতুন শিক্ষা পদ্ধতির সাথে মানিয়ে নিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের একটু সময় তো লাগবেই। সেটুকু সময় সব পক্ষকে দেওয়া উচিত।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
ভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগ, সেমিফাইনালভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ