X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

কর আওতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন কর-ন্যায্যতা নিশ্চিত করা

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:০৯আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:০৯

আয়কর আইন ২০২৩-এর প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু হয়েছে। এনবিআর যেমন নানাবিধ উদ্যোগ নিচ্ছে, একইভাবে ট্যাক্স বারসমূহ তাদের সদস্যদের প্রশিক্ষিত করছে নানা দিক দিয়ে। এত কিছু করেও করদাতার সংখ্যা বাড়ানো যাচ্ছে না। বিশেষ বিশেষ করদাতাদের জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনার করার কথাও ভাবছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যায় না। সমস্যা আসলে কোথায়? সমস্যা চিহ্নিত করতে না পারলে প্রকৃতপক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হবে।

আয়কর আইন ২০২৩-এ এনবিআরকে নানা বিষয়ে এসআরও জারি করার ক্ষমতা দিয়েছে। প্রত্যেক আইনে নির্বাহী বিভাগকে কিছুটা ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। কারণ আইন প্রয়োগে বিশেষ কোন পরিস্থিতিতে বা কোন জটিলতা থেকে নাগরিকদের তাৎক্ষণিক আইনি সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা রাখা হয়।

একইভাবে আয়কর আইন ২০২৩ (২০২৩ সালের ১২ নং আইন)-এর ৭৬(১) ধারায় একক সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা এনবিআরকে প্রদান করা হয়েছে। এই কারণে কর ন্যায্যতা নিশ্চিত করা অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সরকারি, বেসরকারি করদাতার মধ্যে যে বৈষম্য তৈরি করার রীতি আগে ছিল, তা কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন সময়ে দাবি উঠেছিল। কিন্তু তা না হয়ে বৈষম্যটা উল্টো দিন দিন বৃদ্ধি হতে থাকে। বর্তমান আইনের মধ্যেও তা উল্লেখযোগ্য হারে লক্ষণীয়।

করনীতি সব নাগরিকের জন্য সহনীয় হবে, করযোগ্য সব নাগরিক আয়ের সঙ্গে সাম্যতার ভিত্তিতে কর দেবেন, এটা হওয়াটা স্বাভাবিক। সরকার করের অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহ করবে এবং অবশিষ্ট অর্থ রাষ্ট্রে অসমতা দূর করার জন্য বিভিন্ন আয়বর্ধক ও উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করবে। এই অভীষ্টে করনীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রে। এছাড়া যে নাগরিক দেশের পরিষেবাগুলো বেশি ব্যবহারের সুযোগ পাবে, সে নাগরিক তত বেশি সরকারকে ট্যাক্স দেবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন তা হয় না, তখন নাগরিক সমাজে এই নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়।

নিম্নে বর্ণনাটি যদি লক্ষ করি, তাহলে দেখবো কর পরিধি বৃদ্ধির তুলনায় অসমতা তৈরির মানসিকতানির্ভর আইন প্রয়োগ করতে আমাদের আমলা-শাসকরা বেশি উৎসাহী।

একজন সরকারি চাকরিজীবীর জীবনমান ব্যবস্থায় সরকারি সুবিধাগুলো দেখা যাক–

নাগরিক সমাজ মনে করেন–একজন সরকারি চাকরিজীবীর সর্বপ্রথম সুবিধা হলো চাকরির সীমাহীন নিশ্চয়তা, মাস শেষে নিশ্চিত বেতন, পোষ্য কোটা পরিবারের সদস্যদের চাকরির সুযোগ, নিয়মিত সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও এসব সরকারি চাকুরে স্বামী হলে স্ত্রী আজীবন, স্ত্রী হলে স্বামী আজীবন অবসর ভাতার সুযোগ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরম অপরাধ করেও চাকরি হাতছাড়া না হওয়া ইত্যাদি জানা-অজানা নানাবিধ সুবিধা তারা ভোগ করতে থাকেন। এক কথায় বলতে গেলে একটা সরকারি চাকরি মানে শতভাগ নিশ্চিত একটা জীবন। এই নিশ্চিত ও টেনশনবিহীন জীবনে যখন একের পর এক সুযোগ যোগ হতে থাকে, তখন নাগরিক সমাজ থেকে এই নিশ্চিত জীবনের মানুষগুলো ভিন্ন হতে থাকেন। ভাবতে শুরু করেন একজন ‘মহাভাগ্যবান মানুষ’ হিসেবে।

জীবনের একপর্যায়ে এসে এই মানুষগুলো ভাবতে শুরু করেন আলাদা সমাজের বাসিন্দা হতে পারলে আরেকটু নিশ্চিত হওয়া যেত। উন্নত কোনও রাষ্ট্রে যদি একটা বাড়ি থাকতো। ভাবতে থাকেন সন্তানরা বিদেশে পড়াশোনা করতে পারলে আরেকটু ভালো হতো। এই ভাবনাগুলো থেকে তাদের চাহিদা বেড়ে যায়, ফলে যা ঘটে তা হলো তাদের মনের গভীরে একটা চাপ অনুভব হয়, এই চাপকে সামলাতে না পেরে তারা নাগরিকদের অধিকারে হাত দেন, ডান-হাত বাম-হাত দিয়ে সুবিধা গ্রহণ শুরু করেন। সব সরকারি কর্মকর্তা অবশ্য এক নয়। অনেক সৎ কর্মকর্তাও আছেন।

যাহোক, এসবের ফলে একটা সমাজে আয়-বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এই ডান-বাম আয়কারী মানুষগুলো সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে বাজারে যান, কোনও জিনিসপত্রের দরদাম জিজ্ঞাসা না করে গাড়িভর্তি বাজার করেন। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে মূল্য বাড়িয়ে  দেয়, সাধারণ নাগরিক বঞ্চিত হন, ন্যায্যবাজার মূল্য থেকে।

মোদ্দা কথা হলো, জনগণের ভাগ্য নির্ধারণ হয় নানাভাবে, অন্তরালে। সবকিছু আমরা জানি না। সামান্য কিছু আমরা বুঝতে পারি। যেমন, আয়কর রেয়াতে সুবিধা। মূল বেতন ও উৎসব বোনাস ছাড়া সব আয়কর অব্যাহতি আয় হিসেবে সুবিধা গ্রহণ। এই সিদ্ধান্ত কোনও সরকারের মন্ত্রী বা এমপি করে দেন না। আইন পাস করার জন্য প্রস্তাব দেন আমলারা। সেই আইন পাস হয় সংসদে। কে কত কর দেবে, আর কে কত কর ছাড় পাবে, তা ঠিক করার সিদ্ধান্ত সরকারি কর্মচারীর হাতে চলে আসার কারণে ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত নেন এবং তা পরিপালন করেন। যার কারণে কর ন্যায্যতা নিশ্চিত বাধাগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক।

আবারও বলছি, সব সেক্টরের সব সরকারি কর্মকর্তা অসৎ নয়। ভালো, দায়িত্ববান কর্মকর্তাও আছেন, যারা কঠোর পরিশ্রম করেন। কিন্তু তাদের সততা ও পরিশ্রম সামনে আসে না। কারণ নেতিবাচক সংবাদটি দ্রুত ছড়ায়।

আর বেসরকারি চাকরিজীবীর অবস্থা ‘টার্গেট পূরণ’! অনিশ্চিত চাকরি, মাসে শেষে বেতন কখন আসবে তা নিশ্চিত নয়, কোনোরকম সাত-পাঁচ হলেই ‘চাকরি নট’। অনিশ্চিত জীবন ব্যবস্থা, জীবনযুদ্ধে সংগ্রামের চাকরিটা যদি চলে যায় ভবিষ্যতের সব পথ বন্ধ। নেই বেকার ভাতা, নেই অবসর ভাতা, নেই ভবিষ্যৎ তহবিল। ধরতে গেলে অনেকটা অনিশ্চিত একটা ব্যবস্থার মধ্যে যাদের জীবন প্রবহমান। এই পরিস্থিতিতে যা আয় হবে, তা থেকে সংসার খরচ, পরিবার পরিজন, সন্তানের শিক্ষার খরচ, যাতায়াত ব্যয়, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা তো নিত্য দিনের কাজ!

এই পরিস্থিতি গুনতে গুনতে মাসের মাইনেটা পরবর্তী মাসের ১৫ দিনও চলা যায় না। ফলে এক অজানা, অনিশ্চিত পথে পা বাড়াতে হয় সারাটা মাস, বছর এবং কর্মজীবন।

আয় করলে কর দিতে হবে। একটা নাগরিকের দায়িত্ব। দেশের নাগরিকরা তা দিচ্ছে। অনেকের প্রশ্ন, তারা একটা অনিশ্চিত জীবনযাপন করেও কর দিতে হয় সব আয়ের ওপর। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা কি আমাদের চেয়েও অসহায়? তাদের শুধু মূল বেতন ও বোনাস ছাড়া অন্য সব আয় করমুক্ত। এটা কতটা যৌক্তিক! উত্তর নেই।

সাধারণ মানুষ মনে করছে, এটা কর ন্যায্যতার বড় ধরনের ঘাটতি। সরকারের বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া দরকার।

তবে জনমনের প্রশ্নের উত্তরে থেকে এনবিআর এই বিষয়ে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রচার করতে পারে, কেন সরকারি কর্মকর্তাদের আয়করে অধিকতর ছাড় দেওয়া হয়েছে। নতুবা সরকারি-বেসরকারি কর বৈষম্য রাজস্ব আদায়ের অন্তরায় হবে, নাগরিকদের মাঝে অসন্তোষ বিস্তার করবে।

লেখক: কর আইনজীবী

 

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
জোড়া আঘাতে হায়দরাবাদকে গুটিয়ে চেন্নাইয়ের জয় রাঙালেন মোস্তাফিজ
জোড়া আঘাতে হায়দরাবাদকে গুটিয়ে চেন্নাইয়ের জয় রাঙালেন মোস্তাফিজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ