বিমসটেক-এর (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকনোমিক কো-অপারেশন) ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলন আসন্ন। সংগঠনের বর্তমান চেয়ার থাইল্যান্ড ২০২৫ সালের ৪ এপ্রিল ব্যাংককে এই সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছে। পূর্বে কয়েকবার স্থগিত হওয়ার পর সশরীরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে এমন শীর্ষ সম্মেলন সর্বদা সহায়ক।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড—এই সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিমসটেক প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি সেতু। এই সেতুর দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো পশ্চিমে বাংলাদেশ ও পূর্বে মিয়ানমার—সুতরাং তাদের সম্মিলিত শক্তি এই সেতুর স্থায়িত্বের জন্য অপরিহার্য।
চলতি বছর বিমসটেক তার ২৭তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। কৌশলগত অবস্থান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রাচুর্যময় প্রাকৃতিক সম্পদ ও সমুদ্রে প্রবেশাধিকার— এরকম অনন্য কিছু সুবিধা এর সদস্যদের রয়েছে। সদস্য রাষ্ট্রগুলো একত্রিত হলে তাদের সম্মিলিত শক্তি চলমান বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার নেতিবাচক প্রভাব থেকে এই অঞ্চলকে রক্ষা করতে পারবে।
আসুন দেখে নিই, চলমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিমসটেক কীভাবে তার সদস্যদের সহায়তা করতে পারে।
প্রথমত, এটি আমাদের কাছে স্পষ্ট যে মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক উত্তেজনার একটি প্রধান উৎস। এটি শুল্কের মতো সংরক্ষণবাদী ব্যবস্থার দাবিকে বাড়িয়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নশীল বিশ্ব (পড়ুন বিমসটেক) থেকে আমদানি কমাতে চায়, যা বিমসটেকের মার্কিন বাজারে রফতানির ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে। যদি বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বৃদ্ধি করে, তাহলে বাংলাদেশ অতিরিক্ত উৎপাদন বা অপ্রত্যাশিত পণ্য কোথায় পাঠাবে? এখানেই একটি শক্তিশালী বিমসটেকের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বিমসটেকের শক্তিশালী আঞ্চলিক সহযোগিতা নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক একীকরণকে শক্তিশালী করবে, আঞ্চলিক মূল্য শৃঙ্খলা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে ত্বরান্বিত করবে। সুযোগগুলো বিশাল। এই সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশ ও অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভেদ ও অস্থিতিশীলতাকে পাশ কাটিয়ে যৌথভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করতে হবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে দীর্ঘ সময় লাগে, কিন্তু তা ভাঙতে এক মুহূর্তই যথেষ্ট। মনে রাখতে হবে, সহায়ক উপাদান জীবনকে সহজ করে তোলে। দ্বিতীয় বিকল্প হলো সর্বোত্তম সমাধান।
দ্বিতীয়ত, বিমসটেক গোষ্ঠীর বৃহত্তর অর্থনীতি। এখানে ভারত তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত। এটি একটি বহুসংস্কৃতির সমাজ যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায় শান্তি ও সম্প্রীতিতে বসবাস করে। ভারতের বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যা, ভাষা ও ঐতিহ্য একটি সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি করেছে। ভারত জাতি হিসেবে তার গণতন্ত্র, গভীরভাবে প্রোথিত প্রতিষ্ঠান, সুপ্রতিষ্ঠিত আইনি কাঠামো, স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডা এবং জাতীয়তাবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
ভারত পরামর্শকে প্রাধান্য দেয় এবং সংকটে সর্বদা প্রথম প্রতিক্রিয়া জানায়। তারা বিমসটেক ও অন্যান্য আঞ্চলিক জোটের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এর রয়েছে ৭০০ মিলিয়ন ভোক্তার বাজার—যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার চেয়েও সংখ্যাটি বড়। এই বাজার বিমসটেকের জন্য একটি সুযোগ। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি এটি কেন কাজে লাগানো উচিত নয়? ভারতীয় অর্থনীতি ও আর্থিক খাত আজ বহির্বিশ্ব থেকে আসা যে কোনও হুমকি মোকাবিলায় সক্ষম ও সহনশীল। ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারত ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০৩১ সালের মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারে। বিমসটেকের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি থাইল্যান্ড দ্রুত একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। একটি স্থায়ী ও চিরন্তন অংশীদারত্ব বিমসটেককে আগামী কয়েক দশকের জন্য আশার আলো হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
তৃতীয়ত, বিমসটেকের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত। কিন্তু তারা এই সম্মিলিত জলরাশিকে দ্বিপাক্ষিকভাবে ব্যবহার করে। সম্মিলিত জলরাশি দ্বারা সংযুক্ত হলেও দেশগুলো অতীতে আঞ্চলিক পরিবহন সংযোগের জন্য অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে খুব কমই প্রচেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক পরিস্থিতি বদলে দেবে এবং ত্রিপাক্ষিক মহাসড়ক একটি বহুমুখী করিডোর হিসেবে কাজ করবে। ভুটানের আসন্ন গেলেফু মাইন্ডফুলনেস সিটি, ভারতের আসামে সেমিকন্ডাক্টর ও লজিস্টিক্স হাব, থাইল্যান্ড-তামিলনাড়ু বহুমুখী লজিস্টিক্স করিডোর, পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র ও সংগীত, বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়—এগুলো প্রকৃতপক্ষে বিমসটেকের জনগণের জন্য কিছু নতুন আঞ্চলিক কল্যাণমুখী সুবিধা। এই পরিস্থিতিতে, সদস্য রাষ্ট্র ও অংশীদার দেশগুলোর উপকার হয়, বিমসটেককে এমন কিছু বাস্তবসম্মত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে কিছু সমস্যাও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিমসটেক সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তিটি এখনও সব সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন পায়নি। সুয়েজ ও পানামা খাল উভয়েই অকার্যকর হলে আঞ্চলিক সামুদ্রিক সংযোগ শক্তিশালীকরণ হবে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও উন্নয়নের চাবিকাঠি। বিদ্যমান সামুদ্রিক চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য বিকল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছাড়া বাংলাদেশের পোশাক, ভারতের অটোমোবাইল, থাইল্যান্ডের ইলেকট্রনিক্স, ভুটানের উদ্যানবিদ্যা, শ্রীলঙ্কার চা ও নেপালের হস্তশিল্প বিশ্ব বাজার ও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে। তাই এই ধরনের সম্মিলিত চ্যালেঞ্জের জন্য ‘প্রতিবেশীকে দুর্বল করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি’ নীতির বদলে আঞ্চলিক সমঝোতার মাধ্যমে ‘প্রতিবেশীকে সমৃদ্ধ করে এগিয়ে চলা’ নীতির পথ প্রশস্ত করতে পারে। যদি বিমসটেক উন্নতি করে, তাহলে এর সব সদস্যই লাভবান হবে।
চতুর্থত, আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে লাভ এখনও পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। অশুল্ক ব্যবস্থার আকারে উচ্চ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাধাগুলো এই অঞ্চলকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করেছে। বিমসটেকের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য এখন ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে যা ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এই বৃদ্ধি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য সম্পূরকতা নির্দেশ করে। যদি সদস্য রাষ্ট্রগুলো আঞ্চলিক মানদণ্ড চালু, সীমান্ত সংযোগ উন্নয়ন, বাণিজ্য সহায়ক ডিজিটালাইজেশন এবং একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করত, তাহলে বিমসটেক ঘিরে আজকের চেয়ে অনেক বড় আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হতো। তবে, আশার কথা হলো, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বিমসটেকের প্রতিটি সদস্য সামান্য হলেও আঞ্চলিক রফতানিতে অবদান বেড়েছে।
ভুটান ও নেপালের জন্য বিমসটেক অন্যদের চেয়ে বেশি প্রয়োজন। একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) মাধ্যমে বৃহত্তর আঞ্চলিক বাণিজ্য বিমসটেক একীকরণে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। আগামী বছর বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের ক্লাবে উন্নীত হবে। তালিকায় এরপর আছে নেপাল। এই এফটিএ-সমর্থিত আঞ্চলিক বাজার উন্নয়নশীল বিশ্বের যাত্রায় উভয় এলডিসির জন্য অপরিহার্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলো কী কী?
বিমসটেকের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। যেমন, বিমসটেক গ্রিড আন্তঃসংযোগ চুক্তি; অপরাধমূলক বিষয়ে পারস্পরিক আইনি সহায়তা সম্পর্কিত বিমসটেক কনভেনশন; বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক অ্যাকাডেমি/প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারক ইত্যাদি। পঞ্চম বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের পর থেকে এখন পর্যন্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ঘটেছে, যা সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখাচ্ছে। এখানে আমি কিছু আলোচনা তুলে ধরছি।
ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনে স্বাক্ষর হতে যাওয়া চুক্তিসমূহ*
ক্রমিক নং | বিষয়বস্তু |
১ | বিমসটেক সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তি** |
২ | বিমসটেক ভিশন ২০৩০ |
৩ | বিমসটেকের কার্যবিধি |
৪ | বিমসটেকের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা সম্পর্কিত ইপিজি রিপোর্ট |
৫ | বিমসটেক ও অংশীদারদের মধ্যে সহযোগিতা সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারক |
*ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত/স্বাক্ষরিত হবে
**আলোচনা এখনও চলছে এবং দুটি দেশ এখনও নিশ্চিত করেনি।
উৎস: বিমসটেক সচিবালয়ের ভিত্তিতে লেখকের নিজস্ব
বিমসটেক ২০২২ সালে বিমসটেক সনদ চালু করেছে। ২০২৩ সালের শুরুতে ব্যাংককে ১৯তম মন্ত্রী পর্যায়ের সভার পর সহযোগিতার বেশ কয়েকটি নতুন ক্ষেত্র উদ্ভূত হয়েছে। মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় মন্ত্রীরা বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত থেকে উৎসারিত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নথি বিবেচনা ও অনুমোদন করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বিমসটেক কোর মেকানিজমের কার্যবিধি; বিমসটেক সেক্টরাল মেকানিজম; এবং বিমসটেকের বাহ্যিক সম্পর্ক। কার্যবিধি ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত হবে। বিমসটেক এমিনেন্ট পারসন্স গ্রুপ (ইপিজি) রিপোর্ট ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে; সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তি, যা স্বাক্ষরিত হতে পারে; এবং বিমসটেক ব্যাংকক ভিশন ২০৩০ চালু করা হবে।
বিমসটেক নেতারা সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তি অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) খসড়া প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে বলেছেন, যা যৌথ শিপিং কমিটিতে আলোচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে। তারা বিটিসিডাব্লিউজিকে বিমসটেক ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট ও যানবাহন চলাচল সম্পর্কিত ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির কনসেপ্ট নোট চূড়ান্ত করতে উৎসাহিত করেছেন, যা ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির খসড়া প্রণয়নে সহায়তা করবে। বিমসটেক নেতারা বিমসটেক মোটর যানবাহন চুক্তির সমান্তরাল আলোচনা ও চূড়ান্তকরণের ওপর জোর দিয়েছেন।
বিমসটেক আঞ্চলিক পর্যটন, বাণিজ্য সহায়তা, শক্তি, অপ্রথাগত নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছাতে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। সভাগুলো নিয়মিত হচ্ছে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণও তাই। বিমসটেক স্থায়ী কর্মকর্তা কমিটির (বিপিডব্লিউসি) ৮ম সভা ২০২৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা আসন্ন ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা।
বিমসটেকের ৪র্থ মহাসচিব সীমিত সম্পদ নিয়ে অঞ্চলের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। পরবর্তী মহাসচিব মিয়ানমার থেকে হবেন। সচিবালয় এখন তার ১০ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে। এই যাত্রা শুরু হয়েছিল শ্রীলঙ্কার প্রথম মহাসচিব রাষ্ট্রদূত সুমিথ নাকান্দালার অক্লান্ত পরিশ্রমে। এরপর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম ও ভুটানের তেনজিন লেকফেল তাদের নেতৃত্ব ও উদ্যমে এই গতিবেগ বজায় রেখেছেন। ভারত সচিবালয়কে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করেছে। অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোও তাদের সহায়তা বাড়াতে এগিয়ে আসতে পারে।
বিমসটেক জ্বালানি-বিদ্যুৎ, সীমান্ত সংযোগ, বাণিজ্য সহায়তা, পর্যটন, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আরও বেশি সহযোগিতা অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। বিমসটেকের অগ্রাধিকার হবে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জনসংযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে একীকরণ গভীর করা, চলমান এফটিএ ও সংযোগ আলোচনা সম্পন্ন করা এবং ইন্ডাস্ট্রি ৪.০, ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (ডিপিআই), স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতা উৎসাহিত করা। বিমসটেক শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য বিমসটেক ফেলোশিপ চালু করার কথা বিবেচনা করতে পারে।
সুযোগগুলো থাকবে নবায়ণযোগ্য জ্বালানি, ডিজিটাল পেমেন্ট ও আইসিটি ব্যবহার এবং শিক্ষা (অনলাইন ও অফলাইন), পর্যটন, স্বাস্থ্য (প্রথাগত ও অপ্রথাগত), বাণিজ্য সহায়তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে। ভারত ২০২৪ সালে প্রথম বিমসটেক বিজনেস সামিট আয়োজন করেছে এবং অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকেও বি টু বি প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে হবে।
আগামীর পথ
বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি এবং বিমসটেক বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
প্রথমত, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ বিমসটেকের জন্য একটি সুযোগ। বিমসটেক এফটিএ আলোচনা দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন। তবে, বিমসটেক অশুল্ক বাধা হ্রাস, নিয়ন্ত্রক কাঠামো সুসংহতকরণ এবং মানসমূহের সমন্বয় সাধনে এখনও কোনও অর্থপূর্ণ অগ্রগতি করতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য ও ট্রানজিট সহায়তাকে জ্বালানি ও ডিজিটাল সংযোগের পাশাপাশি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিমসটেক নেতারা বাণিজ্য আলোচনা কমিটি ও তার ওয়ার্কিং গ্রুপগুলোকে বিমসটেক এফটিএ ও এর সহযোগী চুক্তিসমূহ, যার মধ্যে অ্যানেক্সও রয়েছে, দ্রুত চূড়ান্ত করতে বলেছেন।
তৃতীয়ত, বিমসটেক সচিবালয়কে সংযোগ প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে হবে। সম্ভবত, ভারতের গতি শক্তি মাস্টার প্ল্যানের অনুরূপ বিমসটেক সংযোগ মাস্টার প্ল্যানের ২য় সংস্করণ চালুর সময় এসেছে।
চতুর্থত, সচিবালয়কে পর্যাপ্ত সম্পদে সজ্জিত করতে হবে এবং বিমসটেক জুড়ে কার্যক্রম সমন্বয়কের ভূমিকা পালনের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে হবে। সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে এখন বিমসটেক সচিবালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটি রোডম্যাপ প্রণয়নের প্রয়োজন। ভারত একটি আন্তঃসরকারি সম্পদ কেন্দ্র গঠনে সহায়তা করতে পারে, যা জ্ঞান সৃষ্টি ও সম্পদ বিনিময়ের মাধ্যমে বিমসটেককে সমর্থন দেবে, যা আসিয়ানের ‘ইরিয়া’ মডেলের অনুরূপ হতে পারে। বাংলাদেশের সিপিডি, সানেম, বিআইআইএস, বিআইডিএস ইত্যাদির মতো কিছু বিশিষ্ট থিংক ট্যাঙ্ক রয়েছে, যাদের এই প্রস্তাবিত উদ্যোগে অবদান রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে, পাশাপাশি আরআইএস, সিএসইপি, সাউটী, এমআইআইএসএস, চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এএসসি, টিডিআরআই ইত্যাদি আঞ্চলিক থিংক ট্যাঙ্কগুলোও অংশ নিতে পারে।
ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের পর থাইল্যান্ডের কাছ থেকে বিমসটেকের সভাপতিত্ব গ্রহণ করবে বাংলাদেশ। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের মধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠক সম্ভবত এই সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান তার স্মৃতিকথা ‘আন্ট্রানকুইল রিকালেকশনস’-এ লিখেছেন কীভাবে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অনমনীয় রাজনৈতিক নেতাদের একটি জাতি গঠনে রাজি করিয়েছিলেন, যা ভারত-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ককে মজবুত করেছিল (পৃ. ২৩৩)। সেভাবেই সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বিভেদ ও বিভ্রান্তি প্রতিরোধ করে ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এটাই এখন সময়ের দাবি।
উপসংহারে বলা প্রয়োজন, অতীতে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হওয়ায় সংগঠনটির একীকরণ প্রক্রিয়া ধীর হয়েছে। এটিকে আবার উন্নয়নের পথে ফিরিয়ে আনতে নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। এপ্রিল সেই মাস যখন বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব নববর্ষ পালন করে। আশা করা যায়, এপ্রিল মাসে একটি শীর্ষ সম্মেলন সুযোগ ও অংশীদারত্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, দিল্লির থিংকট্যাঙ্ক আরআইএসে অধ্যাপনা করেন