নতুন অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারসহ আর্থিক খাতের রোগ সারানোর কোনও উদ্যোগ নেই বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
তারা বলেন, অল্প কয়েকজন ব্যক্তি দেশের ব্যাংকগুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। অথচ তাদেরকেই নতুন করে টাকার জোগান দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এভাবে চললে দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না।
শনিবার (১৫ জুন) রাজধানীতে বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে এডিটরস গিল্ড আয়োজিত ‘প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫: অর্থনৈতিক-রাজনীতির হিসাব’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলে তারা। এডিটরস গিল্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবু বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন।
বৈঠকে অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের ওপর কর বাড়ানোর কারণে মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর চাপ বাড়ানো হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। বর্তমানে ব্যাংক ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাসহ অর্থনৈতিক সংস্কারের কোনও উদ্যোগ নেই বাজেটে।’
সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘রির্জাভ কমার অন্যতম প্রধান কারণ টাকাপাচার। তবে , আমি বলবো, এবারের বাজেট মোটেই গতানুগতিক নয়। কেননা, বাস্তব কারণে এই বাজেটটি আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী— ৯ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সেটা করা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এই কমে যাওয়াটা পরিস্থিতির কারণে হয়েছে। এর চেয়ে আর কমানো ঠিক হবে না।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাজেট গতানুগতিক হবেই। কারণ, বাজেটের ৮০ শতাংশ বিষয় হচ্ছে গতানুগতিক। বেতন তো দিতেই হবে৷ চলমান প্রকল্পগুলোকে চালু রাখতেই হবে। থাকলো বাকি ২০ শতাংশ। ওইখানেই সরকারকে সৃজনশীলতা দেখাতে হবে। আমাদের বাজেটের চ্যালেঞ্জটা হলো অর্থায়নটা কীভাবে হবে। আমি বলছি, ১ লাখ ৩৭ হাজার নেবো ব্যাংকিং খাত থেকে। যতগুলো ব্যাংক আছে, সবগুলো এক করে ডিপোজিট হবে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এখন সরকার এখান থেকে নেবে ৮০ শতাংশ, যা সরকারের জাতীয় আয়ের ১৪ শতাংশ। আর আমরা নেবো ২০ শতাংশ। এটা তো হতে পারে না। বানরের পিঠার ভাগের মতো করে তো আমরা নেবো না। এখানে সরকারকে কাজ করতে হবে।’
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ বলেন, ‘কর নির্ধারণ এনবিআর করে না, করেন সংসদ সদস্যরা। এক্ষেত্রে তাদের বিবেচনা করা দরকার— কোথায় কর বসানো উচিত। সরকার একদিকে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াচ্ছে, কিন্তু এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।’
অর্থনীতিবিদ ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো বাজেট নিয়ে এমন আলোচনা-সমালোচনা পৃথিবীর আর কোনও দেশে হয় না। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমার পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেট আলাদাভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। নয়-ছয় সুদ হার বহাল রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেরিতে সুদ হার বাড়িয়েছে।’
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য এ কে আজাদ বলেন, ‘হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তি দেশের সবগুলো ব্যাংক ফাঁকা করে দিয়েছে। এভাবে ব্যাংকগুলোকে শেষ করে দেওেয়া ব্যক্তিরা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন।’
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। বলেন, ‘অর্থনৈতিক খাতে সুশাসনের ভয়াবহ ঘাটতি আছে। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণ কি সংসদ সদস্যরা করেন, না আমলারা করেন, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘গত দুই বছরে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ, সাংবাদিক বা রাজনীতিকবিদ— যারা পরামর্শ দিচ্ছেন, তা নেওয়া হচ্ছে না। আমি গণতান্ত্রিক সরকারকে বলবো, অর্থনীতিতে এই অরাজকতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। জিরো টলারেন্সের কথা বলছি, কিন্তু এর প্রয়োগটা কোথায়?’