X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা কতদূর?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
২১ মার্চ ২০২১, ১৮:৫২আপডেট : ২১ মার্চ ২০২১, ১৮:৫৪

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
পাকিস্তানের একটি প্রদেশের নাম বেলুচিস্তান। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর বেলুচিন্তানই এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। পাকিস্তান ছাড়াও আফগানিস্তান এবং ইরানের মধ্যে সাবেক বেলুচিস্তানের অংশ বিশেষ রয়েছে। ভৌগোলিক জাদুকরী স্থান হিসেবে পরিচিত বেলুচিস্তানের মোট আয়তন বর্তমান পাকিস্তানের মোট আয়তনের শতকরা ৪৩ ভাগ তথা এক লক্ষ একত্রিশ হাজার আটশত পঞ্চান্ন বর্গমাইল। এটি আয়তনে ব্রিটিশ দ্বীপ থেকে বড় এবং গ্রিস, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও হল্যান্ডের সম্মিলিত আয়তন থেকেও অধিক।

বেলুচিস্তানের অবস্থান ইরানের মালভূমির দক্ষিণ-পূর্বাংশে। এ অঞ্চলটি কিরমানের মালভূমি ও বাশগিরদের পার্বত্যাঞ্চল থেকে সিন্ধু এবং পাঞ্জাবের দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। বেলুচিস্তানের প্রধান অধিবাসী বেলুচ। তবে অতি নগণ্য বারাহুঈ, হাবশী, জাঠ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকও সেখানে বসবাস করেন। প্রথম একেশ্বরবাদী জরথুস্থ ধর্মের ধর্মগ্রন্থ আবেস্থায় বেলুচিস্তানকে “মাকা” নামে অভিহিত করা হয়েছে। এছাড়া গ্রিক ও চীনা ঐতিহাসিকরা এ অঞ্চলের প্রাচীন নাম যথাক্রমে “গাদ রাশিয়া” ও “যাংলা” বলে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে জানা যায়, নাদির শাহ আফশারই সর্বপ্রথম কোয়েটা ও কালাতের বর্তমান প্রশাসনিক বিভাগকে বেলুচিস্তান নামকরণ করেন। তবে রোমীয় উপাখ্যান মতে বর্তমান বেলুচিস্তানে বেলুচদের আগমন ঘটে এগার শতকের শেষ দশকে। সরদার আমির জালাল খান কিরমান থেকে প্রথমে সিসতান অতঃপর জামপুর হয়ে মাকরানয়ে আগমন করেন। তার আগমনের পর থেকে মাকরান বেলুচিস্তান নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। আমির জালাল খানের বংশধররা প্রায় সাড়ে তিনশত বছর শাসন করেন। এরমধ্যে আমির চাকার খান রণদের সময় সমগ্র বেলুচিস্তান বেলুচদের অধিকারে আসে এবং তারা সেখানে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।

প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের প্রতি বহিশত্রুর লোলুপ দৃষ্টি ছিল। আলেকজান্ডর থেকে শুরু করে চন্দ্রগুপ্তের সৈন্য-সামন্তরা এ সমৃদ্ধশালী অঞ্চল জয়ে অভিযান প্রেরণ করেন। যুনুত্নরাইন উপাধিপ্রাপ্ত ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.)-এর সময়ে মদিনা কেন্দ্রিক ইসলামি খিলাফতের প্রতিনিধি হিসেবে হাকিম ইবনে জাবাল আল-আবদারিও এ অঞ্চল জয়ে অভিযান পরিচালনা করেন। জ্ঞানের দরজা খ্যাত খলিফা হজরত আলীর (রা.) সময়েও ওই অভিযানের ধারা অব্যাহত থাকে এবং হজরত হারিছ ইবন মুরবা আল আবাদি বেলুচিস্তান আগমন করে কিছু অঞ্চল জয় করেন। তবে আরব মুসলিমরা সর্বপ্রথম পরিপূর্ণ সাফল্য পায় রাজতান্ত্রিক উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়া (রা.) শাসনামলে বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি মুহালাব ইবন আবী সুফরা কর্তৃক তুর্কিদের পরাজিত করার মধ্য দিয়ে। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবরও এ অঞ্চলের প্রতি নজর দেন। তাঁর আত্মজীবনী তুজুক-ই-বাবুরী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তিনি এ অঞ্চল অভিযান প্রেরণ করেন। বাবরের উত্তরাধিকারী হুমায়ুনের হারানো সিংহাসন উদ্ধারে এই বেলুচদের জোরালো ভূমিকা ছিল। পরবর্তীকালে দ্বীন-ই-ইলাহির প্রবর্তক সম্রাট আকবরের সময় বেলুচরা মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও শেষ পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ বাদশা আওরঙ্গজেবের বশ্যতা স্বীকার করেন। তবে মুঘল শাসন পরবর্তী যুগে বেলুচিস্তানের ইতিহাসে স্বর্ণযুগের প্রবর্তন করেন নাসির খান। কিন্তু দ্বিতীয় নাসির খান ইংরেজ সেনাপতি লেফটেন্যান্ট কর্নেল মার্শালের নিকট কোটরার যুদ্ধে পরাজিত হলে বেলুচরা ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ইংরেজরা ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন বলে এই উপমহাদেশে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটালে বেলুচিস্তানের একটি অংশ নানা ঘটনা প্রবাহে কালাত নেতা আহমদ যার খানের নেতৃত্বে ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।

বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করার জন্য মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বেলুচবাসীকে নানাভাবে বঞ্চিত করে রেখেছে। ফলে বর্তমানে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বেলুচিস্তান উন্নয়নের দিক দিয়ে নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। বাঙালিদের মতো বেলুচরা তাই দীর্ঘদিন থেকেই স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার। কিন্তু পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রভাবের কাছে তাদের এ দাবি বাস্তবায়ন বাস্তবিকপক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যদিও প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেন। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসম্যান ডানা রোহারাবাচ ও তার দুই সহযোগী বেলুচিস্তানের জনগণের সার্বভৌম অধিকার সম্পর্কিত একটি বিল (এই বিলে বলা হয়েছে বেলুচিস্তানের জনগণ নির্যাতন ও সহিংস হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রক্ষার্থে তাদের সার্বভৌম রাষ্ট্র চাওয়ার অধিকার রয়েছে) উত্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে বেলুচদের স্বাধীনতার দাবি আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয়। যদিও এ প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। আজও স্বাধীনতা পায়নি বেলুচবাসী।

বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির সংঘাত নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু সেই সংঘাতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হলেও বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা সুদূরপরাহত। কারণ, বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার হিসাব-নিকাশ ভিন্ন। স্বাধীন বেলুচিস্তানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র নয়, প্রতিবেশী ইরান ও আফগানিস্তানের সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু ইরান ও আফগানিস্তানের পক্ষে ওই সমর্থন দেওয়া কখনও সম্ভব নয়। তারা কখনোই খাল কেটে কুমির আনতে চাইবে না। যদি ইরান ও আফগানিস্তান বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দেয়, তবে তাদের নিজেদের অস্তিত্বও ঝুঁকিতে পড়বে। পাকিস্তানের বেলুচরা স্বাধীনতা অর্জন করলে ইরান ও আফগানিস্তানের বেলুচরা স্বাধীন বেলুচিস্তানে যোগ দিতে চাইবে। ফলে তারাও বিদ্রোহী হবে। আর এমনটি হলে ওই দুটি রাষ্ট্রের মানচিত্রের পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তারা কখনই চাইবে না যে বেলুচিস্তান স্বাধীনতা লাভ করুক।

স্বাধীনতার জন্য বালুচবাসীরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে তাদের ওই সশস্ত্র সংগ্রাম অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে প্রতিবেশী ইরান ও আফগানিস্তানের সমর্থন ছাড়া বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা লাভ অসম্ভব। আর পাকিস্তানের মতো ইরান ও আফগানিস্তান নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে কখনোই বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করবে না। যদিও পাকিস্তানের অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ভূমিকাও এক্ষেত্রে কম নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত যেমন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সহায়তা দেয় তেমনি যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেলুচিস্তানের মুক্তিকামী মানুষদের সহায়তায় হাত প্রসারিত করে, তবে বেলুচিস্তান একদিন স্বাধীন হবে তা আশা করা যায়। অন্যদিকে পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে সামরিক বাজেটে টান পড়লেই বিশাল সেনাবাহিনী মোতায়েন করে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করে রাখা তাদের পক্ষে বেশি দিন সম্ভব হবে না। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে আমেরিকা ও চীনের প্রভাব এক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমেরিকার নতুন বাইডেন প্রশাসনের পরবর্তী কার্যক্রম ও তাদের দক্ষিণ এশিয়া নীতিই বলে দেবে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভবিষ্যৎ।

পরিশেষে, বাংলাদেশে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে যতটা আলোচনা-সমালোচনা হয়, বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে ততটা হয় না। বেলুচরা মুসলিম হলেও বাংলাদেশের কোনও ইসলামি দলকে বেলুচিস্তানে নির্যাতন ও নিপীড়নের স্বীকার মুসলিম ভাইদের রক্ষার জন্য কোনও মানববন্ধন ও মিছিল-মিটিং করতে দেখা যায় না। বাংলাদেশের মুসলিম রাজনৈতিক দলগুলোর এই দ্বিচারিত অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও বেলুচদের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয় সীমিত। যদিও বেলুচদের স্বাধীনতার দাবি সারা বিশ্বের অন্য অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষদের স্বাধীনতার দাবি থেকে কোনও অংশে অন্যায্য নয়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পেছন থেকে মোটরসাইকেলে ধাক্কা, ছিটকে পড়ে কাভার্ডভ্যানের চাপায় চালক নিহত
পেছন থেকে মোটরসাইকেলে ধাক্কা, ছিটকে পড়ে কাভার্ডভ্যানের চাপায় চালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ