X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভয়াবহ করোনা, চিকিৎসক ও একটি নাচের ভিডিও

লেলিন চৌধুরী
০১ মে ২০২১, ১৯:০৩আপডেট : ০১ মে ২০২১, ১৯:০৩

লেলিন চৌধুরী ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা রোগী প্রথম শনাক্ত হয়। তারপর কেটে গেছে ১৪ মাসের কাছাকাছি সময়। সারা বিশ্বের সঙ্গে আমরাও এক ভয়াবহ দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে চলেছি। বৈশ্বিক মহামারির যন্ত্রণাবিদ্ধ দিন কবে শেষ হবে সেটা এখনও অজানা। সব সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমাদের চিকিৎসক সমাজ করোনা প্রতিরোধের যুদ্ধে সামনের কাতারে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত কমবেশি ১৬০ জন চিকিৎসক এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় তিন হাজারের মতো চিকিৎসক। সীমাহীন মানসিক ও শারীরিক চাপ নিয়ে চিকিৎসকরা দিনের পর দিন কর্তব্য পালন করে যাচ্ছে। এই তীব্র চাপ নিতে না পেরে অনেকেই বিষণ্নতায় ভুগছে। অনেকের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এরকম একটি সময়ে ডাক্তারদের নাচের একটি ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মূলধারার গণমাধ্যম খবরটিকে গুরুত্ব দিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশন করে। বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহত্তম একটি হাসপাতাল হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এই হাসপাতালের তিন জন নবীন চিকিৎসক কাজের ফাঁকে পেশাগত পোশাকে ছোট্ট একটি নৃত্য পরিবেশন করে। মোবাইল টেলিফোনের ক্যামেরায় ধারণ করা নাচের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় বা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

ডাক্তারদের নাচের ভিডিওটি দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। অধিকাংশ মানুষ এটিকে স্বাগত জানায়। তারা একে চিকিৎসকদের মানসিক ক্লান্তি দূর করার উজ্জীবক বা টনিক মনে করছেন। ভিডিওটি দেশের করোনাপীড়িত মানুষের মনে ব্যাপক আশাবাদের সঞ্চার করেছে। তারা মনে করছেন, তাদের ডাক্তাররা ভেঙে পড়েনি, এখনও শক্ত আছে, অতএব তাদের কাছে চিকিৎসা পাওয়া যাবে। কিছু মানুষ নাচের ভিডিওটির সমালোচনায় সরব হয়েছে। এসব সমালোচনাকে মোট তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়।

এক. এই নাচের দ্বারা ডাক্তাররা তাদের কোড অব কন্ডাক্ট ( Code of Conduct) ভঙ্গ করেছে।

দুই.  ডাক্তাররা ডিউটি বাদ দিয়ে নাচগান বা নর্তন-কুর্দন নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে। এটা হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য পরিহাস।

তিন. নাচ-গান ইসলাম ধর্মের বিরোধী। নৃত্য পরিবেশনকারী তিন জনের দুই জন অন্য ধর্মের এবং একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী।

অন্য ধর্মীদের নাচের কারণে মুসলমানদের ধর্মনাশের সম্ভাবনা উপস্থিত হয়েছে এবং দেশীয় সংস্কৃতি বিপন্ন হওয়ার কারণ ঘটেছে। অভিযোগ তিনটি নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।

দেশে ডাক্তারদের আচরণবিধি বা কোড অব কন্ডাক্ট ‘বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ দ্বারা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী ডাক্তাররা কী কী করতে পারবে না তার একটা তালিকা দেওয়া আছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে– মিথ্যা সার্টিফিকেট প্রদান করা, রোগী দেখার সময় যথাযথ নয় এমন লাভ অর্জন, চিকিৎসা-জ্ঞান, দক্ষতা, প্রাপ্ত সুবিধাদি ইত্যাদির অপব্যবহার করা, ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কের অপব্যবহার, নিজের প্রচার, ভুয়া পদবি ব্যবহার ইত্যাদি কাজ ডাক্তাররা করতে পারবে না।

চিকিৎসকদের আচরণবিধির নৈতিক ভিত্তি হলো ‘ওয়ার্ল্ড মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক গৃহীত ডিক্লেয়ারেশন অব জেনেভা বা জেনেভা ঘোষণা’। ১৯৪৮ সালে গৃহীত ঘোষণাটি বেশ কয়েকবার সংশোধিত হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধন হয় ২০১৭ সালে। বিশ্বব্যাপী ডাক্তারদের আচরণের মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে এই ডিক্লেয়ারেশন। বাংলাদেশের জন্যও এটি প্রযোজ্য। অনেকে বলতে চাচ্ছেন ঢাকা মেডিক্যালের ডাক্তাররা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি কর্মকর্তার আচরণবিধি তাদের জন্য প্রযোজ্য। যারা এ জাতীয় কথা বলছেন তারা বাংলাদেশের সংবিধান, যা কিনা দেশের সব আইনের উৎস, তার কথা মনে রাখেন না। সেখানে স্বাস্থ্যরক্ষার সঙ্গে যুক্ত কর্মকে স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ কারণে একজন চিকিৎসক সর্বক্ষণ এবং দেশের সর্বত্র চিকিৎসক। একজন সহকারী কমিশনার বা অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা কিন্তু নির্ধারিত ভৌগোলিক সীমার বাইরে তার ক্ষমতা প্রয়োগে অপারগ। কিন্তু ডাক্তারদের জন্য দেশের আইন এই সীমাবদ্ধতা রদ করেছে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি পেশা বা বিভাগের আচরণবিধি নির্ধারণ করা হয় ওই পেশা বা বিভাগের কাজের অন্তর্গত প্রবণতা দ্বারা। কাজের ফাঁকে এক-দুই মিনিটের একটি নাচের ভিডিও করে ঢাকা মেডিক্যালের ডাক্তারেরা ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ কোনোভাবেই ভঙ্গ করেননি। বরং তারা একটি কার্যকর সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগ করে কর্মরত চিকিৎসকদের উজ্জীবিত করতে সমর্থ হয়েছেন। পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের কাজের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ বরাদ্দ থাকে।

দেশের প্রতিটি অফিসে চা খাওয়ার জন্য কয়েক মিনিট সময় দেওয়া হয়। হাসপাতাল তার ব্যতিক্রম নয়। চায়ের অবসরে দুই মিনিটের একটি ভিডিও ক্লিপ তৈরি করা হয়েছে। সবাই জানেন প্রতিটি হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার বা ওটি হচ্ছে একটি ভিন্ন জগৎ। কোনও অপারেশন না থাকলে ওটি হলো একটি জনহীন স্থান। জায়গাটি অনেকটা শব্দনিরোধী বা সাউন্ড প্রুফ। অপারেশন শেষে ফাঁকা ওটির করিডোরে (ওটি রুমে নয়) ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ তৈরি করার কারণে রোগীদের ন্যূনতম অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সম্পর্কে যারা জানেন, ভিডিওটি দেখে তারা বুঝতে পেরেছেন নাচের জায়গাটি হচ্ছে অপারেশন থিয়েটারের করিডোর। দুই নারী চিকিৎসকের হাতের মুদ্রা দেখে যে কেউ বুঝতে পারবেন নাচটি করার আগে তেমন কোনও রিহার্সেল করা হয়নি।

তৃতীয় অভিযোগটি খুবই নিন্দনীয়। এই ডাক্তাররা গত এক বছর ধরে রোগাক্রান্ত অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা দিয়ে আসছে। তাদের কারণে প্রচুর সংখ্যক মানুষ জীবনহানি ও স্বাস্থ্যহানি থেকে রক্ষা পেয়েছে। কত পরিবারের বুক থেকে দুশ্চিন্তার পাষাণভার নেমে গিয়েছে। তখন কিন্তু ডাক্তারদের ধর্মপরিচয় খোঁজা হয়নি। করোনার টিকা, সব ধরনের ওষুধপত্র, অক্সিজেনসহ রোগের চিকিৎসা ও জীবন বাঁচানোর যাবতীয় সামগ্রীর আবিষ্কারক ও প্রস্তুতকারক কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষ সে প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা হয় না। বর্তমান বিশ্বের সবকিছু যাদের তৈরি করা উপকরণের উপর দাঁড়িয়ে আছে তাদের ধর্ম পরিচয় কেউ খুঁজে কি? অথচ সমালোচনাকারীদের ধর্মের সঙ্গে মিলে যায়নি বলে নৃত্যে অংশগ্রহণকারী দুজন ডাক্তারকে গালমন্দ করা হচ্ছে। হয়তো অশিষ্ট শব্দ উচ্চারণকারীদের কোনও স্বজন বিগত দিনগুলোর কোনও সময়ে এদের কারও কাছ থেকেই চিকিৎসা সেবা নিয়েছে। এ ধরনের অভিযোগকারীদের মানসিক গঠন যে অত্যন্ত হীন তা বলার বা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। নাচের কারণে বাঙালির সংস্কৃতি বা দেশীয় সংস্কৃতি বিপন্ন হওয়ার অভিযোগ যারা করেছে তার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগেও গ্রামীণ জনপদে বিয়ে উপলক্ষে নাচ ছিল একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। এখন তো সেটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেকালে স্বচক্ষে আমার মা-চাচিদের নাচতে দেখেছি। সঙ্গে তাদের প্রিয়জনেরা যোগ দিয়েছে। আমরা ছোটরা মহাআনন্দে লাফালাফি করেছি।

ভাইরাল হওয়া নাচের ভিডিওর একাধিক তাৎপর্য রয়েছে। এটি একদিকে ক্লান্ত বিষণ্ন চিকিৎসকদের উজ্জীবিত ও প্রাণবন্ত করেছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে নৃত্যের তাল লয় ছন্দে জানিয়ে দিয়েছে- ‘আপনাদের ডাক্তারেরা এখনও পরিপূর্ণ জীবনীশক্তি নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে আছে, মানুষের জয় হবেই’। মানুষজন এতে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে। তাৎক্ষণিক একটি ভাবনা থেকে তিন জন তরুণ চিকিৎসক যে কাজটি করেছে সেটা ইতোমধ্যে আমাদের দেশে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ভূষিত হয়েছে।

আমি প্রস্তাব করছি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই তিন জন চিকিৎসককে পুরস্কৃত করা হোক।

লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ