X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবাদিকতা শিক্ষায় অনাগ্রহ!

মো. সামসুল ইসলাম
৩০ আগস্ট ২০২১, ১৯:৩৫আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২১, ১৯:৩৮
মো. সামসুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এবং সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের এক পরিচিত শিক্ষকের সঙ্গে আমি সম্প্রতি কথা বলেছিলাম। তিনি জানালেন যে কোভিডকালে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিষয়ক শিক্ষার্থী বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণমাধ্যম, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ক বিভাগগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এমনকি আগস্টে ফল সেমিস্টারে বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু সাংবাদিক যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়েছেন বলে তিনি জানালেন। আমিও কয়েকজনকে চিনি।

প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা সম্পর্কিত বিভাগ পাবলিক প্রাইভেট মিলিয়ে বোধকরি গোটা বিশেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। একসময় সাংবাদিকতা পড়ার ব্যাপারে দেশের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আগ্রহের কারণে বেশ কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ বিভাগ চালু করে। কিন্তু সাংবাদিকতার সোনালি সেসব দিন বোধহয় গত হয়েছে। সাংবাদিকতা শিক্ষা তার ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে।

এ বিভাগগুলোতে পড়তে খুব বেশি শিক্ষার্থী আর আগ্রহ প্রকাশ করছে না। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, বিশ্বায়ন আর যোগাযোগ বিপ্লবের যুগে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে গণমাধ্যম নিয়ে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ বাড়লেও  আমাদের দেশে তা কমছে!

অথচ কোভিডকালের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে দেশের গণমাধ্যম খাত এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। ইংরেজি, বাংলা অনেক নতুন পত্রিকা বাজারে আসছে, টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বাড়ছে। গণমাধ্যমে আমি অনেক চাকরির বিজ্ঞাপন দেখছি।  সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের চাকরির ক্ষেত্র তো বিস্তৃত। আমাদের দেশে যেভাবে সাংবাদিকতা, যোগাযোগ আর গণমাধ্যম অধ্যয়নকে মোটামুটি একত্রিত করে পড়ানো হয় তাতে শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যম ছাড়াও অন্যান্য জায়গাতেও চাকরি করতে পারেন। যেমন, রোহিঙ্গা শরণার্থী আসার পরে  বিভিন্ন দাতা সংস্থা এ দেশে এসেছে। কমিউনিকেশন অফিসারের চাকরির প্রচুর সার্কুলার দেখছি আমি সম্প্রতি।

এছাড়া সরকারি চাকরি ছাড়াও তো ব্যাংক, বিমা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ মোটামুটি সব ক্ষেত্রেই সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরা চাকরি করতে পারেন। অনেকে সাংবাদিকতা পড়তে না চাওয়ার কারণ হিসেবে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কথা বলেন। কিন্তু আগেই বলেছি, গণমাধ্যম তো যোগাযোগ ও  সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের চাকরির একটি মাত্র ক্ষেত্র। যারা সাংবাদিকতা করতে চান না তারা অন্যান্য জায়গায় চাকরি করতে পারেন। কিন্তু তারপরেও শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অনীহা দেখছি।  
   
এটা অনস্বীকার্য যে ১৭ কোটি মানুষের দেশে আমাদের প্রচুর  গণমাধ্যম পেশাজীবী, স্টোরিটেলার, লেখক, বিশ্লেষক, কলামিস্ট, অনুষ্ঠান নির্মাতা, মুভি বা ডকুমেন্টারি নির্মাতা, ভিডিও এডিটর প্রয়োজন। মেধাবী এবং সৃজনশীল শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যম নিয়ে পড়াশোনায় অনাগ্রহী হলে দেশের জন্য তা অশনি সংকেত হবে। জনগণ বিদেশি সংবাদমাধ্যম, বিদেশি কন্টেন্টের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, যার আলামত আমরা সম্প্রতি দেখছি। আমার মনে হয় এ বিষয়টা নিয়ে সাংবাদিক, গণমাধ্যম পেশাজীবী, শিক্ষক সবারই খোলাখুলি কথা বলা উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে বা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা বুঝতে পারি যে সাংবাদিকতা পেশা বা মিডিয়ার ব্যাপারে জনগণের মনোভাব সাম্প্রতিককালে বেশ নেতিবাচক। প্রথমত জনগণ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনগত অবস্থা না বুঝে তাদের পছন্দ মতো সংবাদের সঠিক কাভারেজ না পাওয়ার জন্য শুধু সাংবাদিকদের দায়ী করেন। দ্বিতীয়ত, সাহেদ, সাবরিনা, হেলেনা জাহাঙ্গীর ইত্যাদি বিতর্কিত রাজনীতিবিদদের টকশোর বক্তা, আইপিটিভির মালিক ইত্যাদি বনে গিয়ে জনগণকে ব্ল্যাকমেইল করা, পরীমণিকে নিয়ে বিতর্ক ইত্যাদি জনগণ পছন্দ করছে না। তৃতীয়ত, করপোরেট ইমেজ রক্ষায় সাংবাদিকদের প্রচেষ্টা জনগণ ভালোভাবে নেন না, যেটা নিয়ে আমি সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনে লিখেছি।

গণমাধ্যম জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার মতামত তুলে ধরবে। কিন্তু সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ বা নীতিমালা সম্পর্কে জ্ঞানহীন মানুষদের যখন আমাদের গণমাধ্যম টকশো বক্তা, সাংবাদিক বা কলাম লেখক, বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করে তখন জনগণের সঙ্গে গণমাধ্যমের দূরত্ব বৃদ্ধি ছাড়া কিছুই ঘটে না। আমার মনে পড়ছে, গত বছর আমি ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনে আমার একটি লেখায় বেশ কয়েকটি সমসাময়িক ইস্যু বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলাম যে অনেক টকশো বক্তা তাদের বিশ্লেষণের মাধ্যমে জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন মাত্র!  
   
এ প্রবণতা এখনও চলছে। যেমন, আফগানিস্তান এবং তালেবানের কথাই বলি। আফগানিস্তানের কৌশলগত অবস্থান,  ভূ-রাজনীতিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সরকারি থিংক ট্যাংকে দীর্ঘদিন চাকরির সুবাদে জানি আফগানিস্তান বিষয়ে মন্তব্য করা আসলে কতটাই কঠিন। তেমনি কঠিন সে দেশের ব্যাপারে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ।

ফেসবুকের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু মূলধারার বিভিন্ন পত্রিকায় বা টিভি চ্যানেলে আফগানিস্তান নিয়ে যেসব বিশ্লেষণ প্রকাশিত বা আলোচিত হচ্ছে, দুই একটি বাদে, তার বেশিরভাগই বিভ্রান্তিমূলক এবং ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর। আমরা যদি আমাদের এই অঞ্চল ভালোভাবে না বুঝি, সঠিক নীতি প্রণয়ন না করতে পারি, তাহলে যে ব্যাপক মূল্য দিতে হবে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা।

আমাদের মিডিয়া, থিংক ট্যাংক বা অ্যাকাডেমিয়ার কাছে মিয়ানমার কখনও তেমন গুরুত্ব পায়নি, নীতিনির্ধারকদের তারা মিয়ানমারের ব্যাপারে খুব কমই সতর্ক করেছে,  সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত একটি জাতিকে তাই বইতে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার ভার!
   
এসব বিষয় যে সাংবাদিকতার মর্যাদার হানি ঘটাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। যেখানে সেখানে নিউজপোর্টাল, আইপিটিভি, ইউটিউব চ্যানেল, ওয়েবিনার ইত্যাদির মাধ্যমে সংবাদ প্রচার, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার ইত্যাদির প্রচারের ফলে সাংবাদিক, অসাংবাদিক আর অপসাংবাদিকের পার্থক্য নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে পড়ছে।  আর সাংবাদিকতা পেশার অনিশ্চয়তা তো বহুল আলোচিত একটি বিষয়। বেতন, ভাতা বা বিভিন্ন সুবিধাদির অনিশ্চয়তা দূর না করতে পারলে এই পেশার ব্যাপারে মেধাবীরা আগ্রহ দেখাবে না।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অ্যাকাডেমিয়া-ইন্ডাস্ট্রি কোলাবরেশন বা সহযোগিতা। সাংবাদিকতা, জনসংযোগসহ যোগাযোগ ও গণমাধ্যম সম্পর্কিত বিভিন্ন পেশায় যারা আছেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এ পেশায় নিয়োজিত অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংবাদিকতা বিভাগে পার্টটাইম শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাদান করেন। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়।

গবেষণা, পারস্পরিক আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদির মাধ্যমে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিষয়ে মেধাবীদের এ বিষয়ে শিক্ষায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। দেশের মানুষের তথ্যের বা বিনোদনের চাহিদা কিন্তু কমবে না। দেশে যেভাবে গণমাধ্যম এবং এ সম্পর্কিত পেশার বিকাশ হচ্ছে, ভবিষ্যতে যে আমাদের আরও দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পেশাজীবীর প্রয়োজন হবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।  

লেখক: কলামিস্ট; বিভাগীয় প্রধান, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন ও মিডিয়া স্টাডিজ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
ইমেইলঃ [email protected]
 
  
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শুধু চাকরির পেছনে ছুটবে না, উদ্যোক্তা হবে:  স্বাস্থ্যমন্ত্রী
শুধু চাকরির পেছনে ছুটবে না, উদ্যোক্তা হবে:  স্বাস্থ্যমন্ত্রী
প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক এমডিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক এমডিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বঙ্গোপসাগরে ডুবলো জাহাজ, ভাসছেন ১২ নাবিক
বঙ্গোপসাগরে ডুবলো জাহাজ, ভাসছেন ১২ নাবিক
মাঠ প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ ইসির
মাঠ প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ ইসির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ