X
রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫
১ আষাঢ় ১৪৩২

মেয়েদের পোশাক: যৌনতা এবং নিপীড়ন

ড. সীনা আক্তার
০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৪:৩৭আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৭:২৩

ড. সীনা আক্তার অনেক গবেষণায় দেখা গেছে নারীর তুলনায় পুরুষ যৌনতা নিয়ে বেশি চিন্তা-ভাবনা করে। টেলিগ্রাফ পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, জার্নাল অব সেক্স রিসার্চ-এ প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী পুরুষ প্রতিদিন ৩৪ বার এবং নারী ১৯ বার যৌন চিন্তা করে। বিবর্তনবাদী মনস্তাত্ত্বিক (evolutionary psychologist) ডা. ডায়েনা ফ্লিশ্চম্যান বলেন, ‘পুরুষ অতিরিক্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবনায় (যৌন) থাকে, তাদের পক্ষে যৌনচিন্তা উপেক্ষা করা খুব কঠিন। ‘(Men have more intrusive thoughts, too – it’s harder for them to ignore thoughts about sex)’। আমার পরিচিত কিছু পুরুষের মন্তব্যেও এ উক্তির সত্যতা দেখেছি। যেমন, নিজ কানে শোনা কম বিচ্ছিরি একটা উদাহরণ: এক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি তার ভিনদেশি নারী সহকর্মী সম্পর্কে বলেন, ‘মেয়েটা দেখতে খুব সেক্সি কিন্তু দাঁতগুলো এমন বিচ্ছিরি যে চুমো দিতে ইচ্ছে করে না।’ মোটকথা, মেয়েদের দেখলে অনেক পুরুষের (সবাই না) মনে বাসনা জাগ্রত হয়।
সারাবিশ্বেই মেয়েদের পোশাক আলোচনা-সমালোচনার একটা বিষয়। সংস্কৃতির প্রবহমানতায় আমাদের দেশে খুব অল্প সংখ্যক শহুরে মেয়েকে জনসমক্ষে অতি খোলামেলা, সংক্ষিপ্ত, আঁটসাঁটো পোশাকে দেখা যায়। এ ধরনের পোশাকের পক্ষে কট্টর নারীবাদীদের যুক্তি হচ্ছে, এটা নারী স্বাধীনতা এবং প্রগতির বিষয়। কারও যুক্তি এতে নারীকে আকর্ষণীয় দেখায়। প্রশ্ন হচ্ছে কারও দৃষ্টিতে ওই পোশাকে নারীকে আকর্ষণীয় দেখায়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই প্রশংসাটা আসে পুরুষের (স্বামী/প্রেমিক ছাড়া) কাছ থেকে, মৌখিক অথবা অভিব্যক্তিতে। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং প্রগতির নামে অনেক পুরুষ ও নারীর খোলামেলা-স্বল্প-আঁটসাঁটো পোশাকের পক্ষে উচ্চকিত! এর কারণ, যৌনকাতর পুরুষের কূটকৌশল, দৃষ্টি দিয়ে নারীর শরীর উপভোগের চাতুরতা। পুরুষ শাসিত চলচ্চিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপন, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় নারীকে এ ধরনের পোশাকে উপস্থাপনে এই কূটচাল লক্ষণীয়। স্পষ্টই সেখানে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্বে নারীর পোশাক নিয়ন্ত্রিত এবং সেইসব পোশাকের অনুকরণ বাস্তবেও দেখা যায়। 

পোশাক নির্বাচন অবশ্যই ব্যক্তির পছন্দ-অধিকারের বিষয়, তবে দায়িত্বশীলতার মাধ্যমেই অধিকার আসে। জুনিয়র রকাফেলার উক্তিটি এখানে প্রাসঙ্গিক, তিনি বলেছেন, Every right implies a responsibility; Every opportunity, an obligation, Every possession, a duty (John D. Rockefeller, Jr.)। আমাদের দেশে, মেয়েদের পোশাকের ক্ষেত্রে দায়িত্বটি হচ্ছে আত্ম-সুরক্ষার দায়িত্ব, অন্য মেয়েদের প্রতি দায়িত্ব এবং সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি দায়িত্ব। দায়িত্বহীন স্বাধীনতা ভোগ মানে স্বার্থপরতা, যা সমাজ-সংস্কৃতিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। যেমন, মেয়েদের পোশাকের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এই সংঘাতে সৃষ্ট অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ভুক্তভোগী আমাদের মেয়েরা। যেমন, জনসমক্ষে নারীর প্রতি কটূক্তি, নিপীড়ন, সহিংসতা এবং এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া। অন্যদিকে, নারী স্বাধিনতার বিরুদ্ধে কট্টর ধর্মীয় বলপ্রয়োগবাদীদের তৎপরতা। কূটকৌশলে কট্টর নারীবাদী মতাদর্শকে ইস্যু করে কট্টর ধর্মীয় মতাদর্শের বিস্তারকে বেগবান করা। কট্টর ধর্মীয় পন্থীদের কাছে একমাত্র সমাধান নারীকে প্যাকেট করা, ঘরে বন্দি করা এবং বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা। যেমন, ইতোমধ্যে মেয়েদের পোশাকে আমূল পরিবর্তন দৃশ্যমান, বিপুল সংখ্যক মেয়ে হিজাব-বোরকা পরে, এমনকি শিশু-কিশোরীদের হিজাব পরানো হয়। হিজাব-বোরকা প্রচারকদের ভাষ্য হিজাব মানে শালীনতা, পুরুষের নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা কিন্তু এই গৎবাঁধা দাবির কোনও ভিত্তি নেই। কারণ গবেষণায় দেখা যায় নারী ও মেয়ে শিশু সর্বাধিক নিপীড়নের শিকার হয় নিজ পরিবারে, বিবাহিত নারী নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয় স্বামী দ্বারা। হিজাব-বোরকা প্রচার, প্রসারের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে রাজনৈতিক, দল ভারী করার ও দেখানোর ধর্মীয় রাজনীতি। বলাই বাহুল্য, এই রাজনীতির নিয়ন্ত্রক পুরুষ। মেয়েরা মূলত হিজাব পরে ধর্মের নামে স্বজনদের হুমকি ও ভয়ে এবং নিজ গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে। ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে, নিয়ন্ত্রণ করে কাউকে কিছু করানো মানেই হচ্ছে নিপীড়ন।


সারা বিশ্বেই পোশাক-সৌন্দর্য-শালীনতার নামে নারীর শরীরকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যার নিয়ন্ত্রক মূলত কর্তৃত্ববাদী পুরুষ। এর ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও একদিকে পাশ্চাত্যের কট্টর নারীবাদ এবং অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে কট্টর রক্ষণশীলতায় নিয়ন্ত্রিত মেয়েদের পোশাক। পরিণামে, সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের সংঘাত, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একদিকে নারীর পোশাক সংশ্লিষ্ট অপরাধ বৃদ্ধি, অন্যদিকে ঘরে-বাইরে নারীর স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে যেমনটা হয়েছে ইরান, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে। অথচ এই অতি খোলামেলা, আঁটসাঁটো, সংক্ষিপ্ত পোশাক এবং হিজাব-নিকাব-বোরকা, এগুলোর কোনওটাই আমাদের সংস্কৃতির অংশ না।
উল্লেখ্য, পশ্চিমা পোশাক মানেই অতি খোলামেলা-আঁটসাঁটো, সংক্ষিপ্ত পোশাক না। অন্যদিকে হিজাব-নিকাব মানেই শালীনতা না। সুরক্ষা, শালীনতা ও সৌন্দর্যের নীতিতে আমাদের বাঙালি-বাংলাদেশি পোশাক সমৃদ্ধ, যেমন: শাড়ি, সেলোয়ার কামিজ-পাজামা-পাঞ্জাবি। ভিনদেশি পোশাক আমরা পরতেই পারি, সেক্ষেত্রে আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বজায় থাকাটা অত্যাবশ্যক। চলমান সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রতিরোধে আমাদের সমৃদ্ধ পোশাক সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা জরুরি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কট্টর নারীবাদী আদর্শিক পোশাক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের হিজাব-নিকাব-বোরকার আধিপত্যকে মোকাবিলা করা সম্ভব না। বরং আমাদের মূল্যবোধকে ধারণ করে এমন পোশাকই কেবল এই আগ্রাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ, তবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব আছে।


লেখক: প্যারেন্টিং পেশাজীবী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে জরুরি নির্দেশনা
এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে জরুরি নির্দেশনা
এবছর ঈদযাত্রা-কোরবানি যেকোনও বছরের তুলনায় স্বস্তিদায়ক ছিল: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
এবছর ঈদযাত্রা-কোরবানি যেকোনও বছরের তুলনায় স্বস্তিদায়ক ছিল: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
ঘেরের পাড়ে পড়ে ছিল প্রবাসী যুবকের মরদেহ
ঘেরের পাড়ে পড়ে ছিল প্রবাসী যুবকের মরদেহ
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ৫ জন হাসপাতালে ভর্তি
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ৫ জন হাসপাতালে ভর্তি
সর্বশেষসর্বাধিক