X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবাদিক এবং ৫৭ ধারা

সারওয়ার-উল-ইসলাম
০৭ মে ২০১৭, ১৬:৪৩আপডেট : ০১ জুন ২০১৭, ১৩:৫৫

সারওয়ার-উল-ইসলাম  ‘সাংবাদিক’ শব্দটি লিখতে শুরুতে দন্ত্য ‘স’ আকার লাগে আর ‘সাতান্ন’ লিখতে দন্ত্য ‘স’ আকার লাগে। বলা যায়, সাংবাদিকদের সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার কোথায় যেন একটা মিল রয়েছে। এই মিলের বিষয়টি নিতান্তই রসিকতা, মনগড়া। কিন্তু বর্তমানে ৫৭ ধারার নামে সাংবাদিকদের মনে যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এর ফলে তো কিছুটা হলেও নিরপেক্ষ প্রতিবেদন তৈরিতে প্রভাব পড়বে। একটি দেশের সাংবাদিকেরা কি শুধু দেশের ক্ষমতাসীন দলের প্রশংসা করে যাবে? তাদের সমালোচনা করার সুযোগ না থাকলে সরকারের ভুলক্রটিগুলো কিভাবে তারা মেলে ধরবে প্রতিবেদনে?
মানুষের দুর্ভোগের কথা যদি প্রতিবেদনে তুলে না ধরা যায়, তা হলে কেন্দ্রে বসে সরকার প্রধান কিভাবে সেই সমস্যার সমাধান করবেন? সরকারে থাকা লোকজন যদি কোনও দুর্নীতির সঙ্গ জড়িয়ে যান আর সরকার প্রধান সেই তথ্য না জানেন, তা হলে ধীরে ধীরে ভাবমূর্তি তো সরকারেরই ক্ষুণ্ন হবে। সরকারের জনপ্রিয়তা একসময় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
আসল কথা হচ্ছে, ‘রাজনীতি’ শব্দটা এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে, সংবাদকর্মীরাও এর থেকে দূরে নেই। মুখে মুখে অনেক বড় কথা বলে থাকেন আমাদের অনেক সাংবাদিক। কিন্তু ক্ষমতা আর লোভের কাছে তাদের সেই নীতিকথা কখনও কখনও 'ক্ষমতাগীতি' হয়ে বাজে কানের কাছে। আর এই কারণে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় সাংবাদিক মহল। সরকারের লেজুড়বৃত্তি ছাড়া আর কিছু করতে পারে না তখন। বিষয়টি খুব পরিষ্কার বোঝা যায় বিভিন্ন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে। যেমন যে ব্যক্তি আজ এক সরকারের আমলে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে বলছেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এখন সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে; সেই ব্যক্তিই তার অপছন্দের সরকারের আমলে বলবেন, দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে।
এই হচ্ছে আমাদের সংবাদকর্মীদের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তাদের কথা শুনলেই বোঝা যায়, নামকরা সাংবাদিকেরা কিভাবে মত-দ্বিমতে আছেন। সেমিনারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও রিপোর্টার্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্সের সদ্য প্রকাশিত দু’টি প্রতিবেদনের কথা বার বার এসেছে। অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সাংবাদিকেরা প্রতিদিন সরকারি বাহিনী কিংবা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে হুমকি পাচ্ছেন। শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করার মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা থেকে বিরত থাকার বার্তা দেওয়া হচ্ছে।

আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা কী বুঝি? দেশের কলমযোদ্ধারা কখনও সত্যের বলয় ছেড়ে আলাদা হবে না। তারা তাদের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে সত্য বলে যাবে। কিন্তু আজ লোভের কাছে সেই বিবেকবানেরা বিভক্ত। যখন সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পাচ্ছেন তখন সেই সরকারের প্রশংসা করছেন।

আমাদের এই বিভক্তি যতদিন থাকবে, সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে সুবিধাভোগ করার মানসিকতা যতদিন থাকবে, ততদিন ‘প্রেস ফ্রিডম’, ‘প্রেস ফ্রিডম’ বলে গলা ফাটিয়ে কোনও লাভ হবে না। কারণ আজ আপনি ফ্রিডম নেই বলছেন, আগামীতে যখন আপনার পছন্দের দল ক্ষমতায় আসবে, তখন আবার এই আপনিই বলবেন দেশে ‘প্রেস ফ্রিডম’ আছে। আজ যারা বলছেন, ফ্রিডম আছে, তারা তখন বলবেন, নেই।

এই আছে আর নেই-এর দোলাচলে চলছে বাংলাদেশ। আমাকে যখন নানা রকম সুবিধা বা বিজ্ঞাপন দিতে বারণ করা হচ্ছে, তখন আমি সোচ্চার। যখন অন্য সরকারের আমলে আমার পত্রিকা বিজ্ঞাপনে সয়লাব হয়ে যায় তখন চুপচাপ। অন্যেরা চিৎকার করে মরলেও তাদের হয়ে একসঙ্গে কথা বলি না। এই কপটতা থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে সংবাদপত্র হুমকির মুখে, চাপের মুখে, ভয়ভীতির মুখে বলে যতই কান্নাকাটি করি, কোনও লাভ নেই। 

৫৭ ধারায় কাউকে গ্রেফতার করলে ক’জন সাংবাদিক এক হয়ে রাজপথে নামেন? শুধু পত্রিকার পাতায় একটু সংবাদ পরিবেশন করে দায় সারেন। যখন আপনার কাছে ওই ৫৭ ধারা এসে হাজির হবে, তখন আপনি বুঝবেন এর হয়রানির মাত্রাটা কেমন।

দেশের মঙ্গলের জন্য সরকারের ভুলকে ভুল আর সরকারের সাফল্যকে সাধুবাদ জানানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে আমাদের সংবাদকর্মীদেরই। কে কোন রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী, তার চেয়ে বড় হচ্ছে দেশ। যখন বিশ্ববাসী টের পায় বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাটি কিভাবে প্রয়োগ হচ্ছে, তখন লজ্জায় দেশের মাথা নুয়ে আসে। আমাদের ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া এই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার জন্য দ্রুত এই ধারাটি বিলুপ্ত হবে বলেই আশা রাখছি। না হলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র বলে যে নিভু নিভু বাতিটি এখনও জ্বলছে বলে মনে হয়, সেটি আর জ্বলবে না। আমরা কি সেই গণতন্ত্রকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিতে পারি না?

লেখক: ছড়াকার ও সাংবাদিক।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ