X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

এই দেশটাই আমাদের

রোকেয়া চৌধুরী
২৮ মে ২০১৭, ১৩:৩১আপডেট : ২৮ মে ২০১৭, ১৩:৩৫

   রোকেয়া চৌধুরী ১৯২৭ সাল। অবিভক্ত ভারত। 'রঙ্গিলা রাসুল' নামে ১৯২৪ সালের একটি প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক তিক্ত রূপ নিয়েছে । বিচার বিভাগ-শাসন বিভাগের ঢিল ছোড়াছুড়ি চলছে। দণ্ডবিধিতে 'বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানো'র জন্য শাস্তির যে বিধান আছে, তার অধীনে লেখকের বিচার হতে পারে এমন বিবেচনায় সন্তুষ্ট হতে পারছেন না আদালত। সে কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও লেখা, বক্তব্য বা উপস্থাপনার মাধ্যমে কোনও সম্প্রদায়ের ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত ঠেকাতে নতুন আইনের কথা ভাবা হচ্ছিলো। বৃটিশ শাসনাধীন হলেও, আইনসভায় তখন কিছু নির্বাচিত ভারতীয় সদস্যও আছেন। ব্রিটিশরাজের সঙ্গে ধর্মাবমাননার দুই বছরের সাজার বিধান করতে তারাও যুক্ত হলেন। তবে বিপক্ষেও মতামত এলো অনেক। বিরোধিতাকারীরা আশঙ্কা প্রকাশ করলেন, এই আইনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ না কমে বরং সংখ্যালঘু পীড়ন বাড়বে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর ইতিহাস চর্চায় বাঁধা আসবে। সেদিনের আইনসভারই একজন সদস্য ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতো মন্তব্য করেছিলেন, এই আইন শিল্পী, সাহিত্যিক ও নন্দনতাত্ত্বিকদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। কেউ কেউ বললেন, নাগরিকরা মারামারি করে শান্তি বিঘ্ন করলে তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ হবে, ধর্মের বিরুদ্ধে না। কে. সি. নিয়োগী (তৎকালীন ঢাকা বিভাগের) বলেছিলেন, "একটি দেশের ফৌজদারি আইন সেই দেশের সভ্যতার মাপকাঠি। এই আইন পুরো বিশ্বের কাছে আমাদের দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিরুদ্ধ সম্পর্ক ঘোষণা করবে।” কিন্তু এতসব যুক্তি-তর্ক উপেক্ষা করে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে সংশোধনীটা পাস হলো। দণ্ডবিধির নতুন ধারা হলো ২৯৫ক।

সেদিন এই বিধানের যারা বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের প্রত্যেকটি আশঙ্কা স্বাধীন ভারতে বাস্তবে মূর্ত হয়েছে। পাকিস্তান তার দণ্ডবিধিতে জুড়ে নিয়েছে ২৯৫খ আর ২৯৫গ। এই দুই বিধানে কোরআন অবমাননার জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড আর মহানবী(স:) কে অবমাননার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে পাকিস্তানের অনুরূপ সংশোধনীর প্রস্তাব করেন জামায়াতে ইসলামের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান নিজামী। এরপর ২০০৪ সালে একজন স্বতন্ত্র সাংসদ 'যে কোন শব্দ, ভঙ্গিমা, বক্তৃতা, ছবি, চলচ্চিত্র, শিল্পকর্ম অথবা কোনও আচরণের' মাধ্যমে কোরআন বা নবীর অবমাননার জন্য শাস্তির প্রস্তাব আনেন। যদিও এই প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপিত হয়নি। এরপর কোনও শোরগোল ছাড়াই অনলাইনে 'ধর্মীয় অনুভূতিতে' আঘাতের জন্য শাস্তির বিধান রেখে ২০০৬ সালে করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন। ২০১০ সালে বিটিআরসির নির্দেশনায় ফেসবুক বন্ধ হওয়ার আগে এই আইনটির নামই উচ্চারিত হয় নি কোথাও। ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ব্লগারদের নাস্তিক-কাফের আখ্যা দিয়ে হেফাজতে ইসলাম ফাঁসির দাবি তোলে| তাদেরকে 'শান্ত' করতে ৫৭ ধারায় ধর্মীয় অবমাননার শাস্তি বাড়িয়ে সর্বোচ্চ চৌদ্দ বছর করা হয়। এছাড়াও ৫৭ ধারার অধীনে মামলাকে অজামিনযোগ্য করা হয়। ব্লগারদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যা চলতে থাকলেও ব্লগারদেরই বারবার সীমা অতিক্রম না করতে হুঁশিয়ার করেছে প্রশাসন। গুটিকয়েক আলোচিত মামলার বাইরে এই 'ধর্মরক্ষার আইন' যে বিভীষিকা তৈরি করেছে, তার অনেকটাই আড়ালে থেকে গেছে। ধর্মাবমাননার মামলায় খালাস পেয়েও চাপাতির আঘাতে মারা গেছেন শিক্ষক এবং দর্জি। ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে নাসিরনগরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে| তার বিচার হয়নি। অথচ যার নাম ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হয়েছে, সেই নিরপরাধ রসরাজ জেল খেটেছেন।

২০১৫ সালে, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট নিরীহ মানুষদের হয়রানির প্রেক্ষিতে ''তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৬৬ক  ধারাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। ভারতের আইনে ধর্ম অবমাননার কথা সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও সেটিও আলোচনায় এসেছে। আদালত রায়ে বলেছেন, যে কোনও বিষয়ে কারও মতামত অন্যদের জন্য বিরক্তিকর, অসুবিধাজনক বা অবমাননাকর হতে পারে। তাই এসব কারণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকে না। বাংলাদেশের আদালতকে অবশ্য ৫৭ ধারার আইনী সন্ত্রাস নিয়ে খুব বেশি ভাবিত বা বিচলিত মনে হয় না। এই ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা কয়েকটি মামলা খারিজ হয়েছে। দুটি মামলা ঝুলে আছে অনেকদিন ধরে। ইদানিং তথ্যমন্ত্রী বলতে শুরু করেছেন, ৫৭ ধারা থাকছে না। অথচ খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্ম অবমাননার বিধানটি প্রায় হুবহু আছে, কেবল শাস্তির মাত্রা কমেছে।

আমাদের আইন প্রণেতারা শাস্তি-বাড়ানো কমানোকেই আইনের উৎকর্ষের মানদণ্ড ভাবছেন না নিশ্চয়ই। আইন ধর্ম বা কোনও মতাদর্শকে সুরক্ষা দেয় না, সুরক্ষা দেয় ব্যক্তিকে। ব্যক্তি শুধুমাত্র তার ধর্মবিশ্বাসের কারণে আক্রান্ত কি না, ব্যক্তি ধর্ম পালনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন কি না, আইন শুধু সেটুকু সুরক্ষাই দিতে পারে। কারও অনুভূতি বা মূল্যবোধের সুরক্ষা দেওয়া আইন বা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। আমাদের সংবিধানে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্ৰণ আরোপের যতগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি নেই। 'তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন' হোক আর 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' হোক, কোন 'ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষা আইন' এর সংবিধানিকতাই প্রশ্নাতীত নয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি আহত হয়েছে, এই অজুহাতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়েছে। আমরা অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছি, 'এই দেশ আমার নয়'। কিন্তু, এই দেশটাই তো আমাদের! এখানে পাঠ্যক্রম পাল্টে যায়, ভাস্কর্য সরে যায়। তবু কেউ দায়ভার নিতে নারাজ। সবই করা হচ্ছে 'পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে' রাখার জন্য। পরিস্থিতি তৈরির সহায়ক ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন কারা? কেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, অভিজিৎ রায়ের হত্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি কথা বলতে পারবেন না। কেন প্রধানমন্ত্রী বলেন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, তাই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে থাকবে। ২০০৫ এর আইন কমিশনের রিপোর্টে কোনও তথ্য উপাত্ত ছাড়া মন্তব্য করা হয়েছিল, দেশের সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন করলে মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানার অভিযোগে বিদ্রোহ করবেন। অথচ ২০১৩ সালে জরিপের ফল নিয়ে করা আইন কমিশনের রিপোর্টে দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিকরা বিয়ে-ভরণপোষণ-অভিভাবকত্ব নিয়ন্ত্রণে শরীয়া আইনের সংস্কার চান। শান্তিভঙ্গের এই অমূলক জুজুর ভয় দেখিয়ে আজ জনবিরোধী সব কাজ বৈধতা পায়, এবং পাচ্ছে।

 হেফাজতের ১৩ দফা দাবির কথা মনে পড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে 'যৌক্তিক দাবি' বিবেচনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তারপর পাঠ্যক্রম পাল্টেছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করার বিধান রেখে সম্প্রচার নীতিমালা হয়েছে, বিয়ের ন্যূনতম বয়সের ব্যতিক্রম করা হয়েছে, কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তরের সমমানের করা হয়েছে, পহেলা বৈশাখ উদযাপন গত দু’বছর ধরে বিকেল পাঁচটার সময়সীমায় বাঁধা পড়েছে। এবার ভাস্কর্য অপসারণ শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কওমী মাদ্রাসার ওলামাদের বলেছিলেন, ভরসা রাখতে, ভাস্কর্য বিষয়ে যা যা করা দরকার তিনি করবেন। হেফাজত উল্লসিত হয়েছে। অনুমান করি, ধীরে ধীরে ১৩ দফার সব দাবিই পূরণ হবে। 

রাষ্ট্র যখন সরাসরি ধর্মীয় মৌলবাদের পক্ষ নিলেন, তখন ভয় হয়, অনাস্থা কি থেকে যাবে বিচার না পেয়ে আত্মহননে বাধ্য হওয়া হজরত আলী ও আয়েশার জন্য যারা বিচার চাইছেন তাদের মনে? অনাস্থা কি থেকে যাবে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে যারা পথে নেমেছেন তাদের উচ্চকিত কণ্ঠে? হাওরের প্লাবনে যাদের চোখের জল মিশেছে তাদের অনিশ্চিত দিনযাপনে? অনাস্থা কি থেকে যাবে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ও তার পরিবারের দুঃসহ অপমানে? অনাস্থা কি থেকেই যাবে সংবিধানের পাতায়? যেখানে লেখা আছে রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য "সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার" নিশ্চিত করা!

লেখকঃ আইন গবেষক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 ই-মেইলঃ [email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যশোরে তাপমাত্রা কিছুটা কমেছে, সড়কে শরবত বিতরণ
যশোরে তাপমাত্রা কিছুটা কমেছে, সড়কে শরবত বিতরণ
অগ্রসর বাংলাদেশে পাকিস্তানের হিংসা
অগ্রসর বাংলাদেশে পাকিস্তানের হিংসা
সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থায় যার জমি তারই থাকবে
সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থায় যার জমি তারই থাকবে
শাহজাদপুরে ট্রাকের ধাক্কার রিকশাচালক নিহত
শাহজাদপুরে ট্রাকের ধাক্কার রিকশাচালক নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ