X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষায় ক্যাডার-নন ক্যাডার দ্বন্দ্ব কতটুকু ঠিক?

জিয়া আরেফিন আজাদ
০৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৭:২০আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২০, ১২:৫৪

জিয়া আরেফিন আজাদ আমাদের দেশে কোনও একটি সমস্যায় অচলাবস্থা সৃষ্টি না হলে সেটা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা কিছু বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি  ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুই দিন একযোগে দেশের ৩২৭টি সরকারি কলেজ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোয় কর্মবিরতি পালনের ফলে বিষয়টি গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীও প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। উপজেলা-পর্যায়ে জাতীয়করণের তালিকাভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষকদের মর্যাদা ক্যাডার বহির্ভূত রাখার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন, এমনটাই তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। বিদ্যমান সমস্যাকে অনেকেই সরকারি কলেজে দুই ধরনের শিক্ষকের মধ্যে দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখছেন। কেউ কেউ সরলার্থে ক্যাডার-নন ক্যাডার দ্বন্দ্ব হিসেবে শিরোনাম করেছেন। আসলেই কি বিষয়টি তাই? বেসরকারি কলেজ রাষ্ট্রায়ত্ত করার পর তার জনবলের অবস্থান কী হবে, সেটা নিয়ে গত চার দশক ধরে আলোচনা চলছে। ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন সব শিক্ষা খাতকে ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা’ নামের আওতায় ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগকৃত কর্মকর্তাদের আপত্তির পরও গত ৩৭ বছর জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকগণ বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণ হয়ে আসছেন। এতদিনের চর্চাটিতে সমস্যা কোথায়–সঙ্গত কারণেই কেউ কেউ সেই প্রশ্নও তুলছেন। সংকট নিরসনে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের ঔদার্য দেখাতেও পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি জোড়াতালির সমাধানকে ইঙ্গিত করে, যা বিদ্যমান সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলবে।

প্রকৃতপক্ষে এই সমস্যা বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ দেওয়া এবং জাতীয়করণ করা শিক্ষকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়। এটি রোগের উপসর্গ মাত্র। আসল রোগটি নিহিত আছে রাষ্ট্রের ২৯টি (বর্তমানে ২৮) ক্যাডার সার্ভিসের আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে। আমরা সবাই জানি, সচিবালয়ে প্রজাতন্ত্রের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৭৫% কোটা সংরক্ষণ করা আছে। এই সংরক্ষণের বিষয়ে বাকি ২৬ টি ক্যাডারে অসন্তোষ রয়েছে। তারা মনে করেন, এর ফলে প্রায়ই রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণে জনস্বার্থের চেয়ে নির্দিষ্ট একটি সার্ভিসের কর্তৃত্বের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে যায়। এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার গঠিত হয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও সাধারণ শিক্ষায় চলমান তিনটি সার্ভিস এবং শিক্ষা সংক্রান্ত সব প্রথম শ্রেণির শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মকর্তাকে একত্রিত করে। সরকারি কলেজের শিক্ষকরা এই সার্ভিসের প্রধান স্রোতধারা হলেও প্রবেশ পর্যায়ে আরও সাতটি ভিন্ন পদের কর্মকর্তাকেও এই সার্ভিসের শিডিউলভুক্ত করা হয়। উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিদর্শক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রাথমিক শিক্ষা ইনস্টিটিউটের সুপার ইত্যাদি পদগুলো সেই তালিকায় রয়েছে। মূলধারা শিক্ষায় রাষ্ট্রের নিজস্ব একটি এককেন্দ্রিক এজেন্সি তৈরিই ছিল এই উদ্যোগের লক্ষ্য। পরিতাপের বিষয় হলো, বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি কলেজ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের প্রভাষক ছাড়া অন্য কোনও পদে এ পর্যন্ত  নিয়োগ দেওয়া হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভেঙে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। জনশিক্ষা পরিচালকের দফতরকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে উন্নীত করা হলেও এর মহাপরিচালকের কর্মপরিধি সংকুচিত হতে থাকে। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর পৃথক হয়েছে, বিদ্যালয় শাখাকেও পৃথক করার কথা মাঝে মাঝেই শোনা যায়।

শিক্ষার বিভিন্ন শাখাগুলোর পৃথক ব্যবস্থাপনা ভালো, নাকি অভিন্ন ব্যবস্থাপনা ভালো,  আমরা কখনও এ ধরনের একাডেমিক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হতে দেখিনি। বিভিন্ন শাখাগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব কার হাতে কতটুকু থাকবে, সে বিষয়টিও জাতীয় বিতর্কের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়নি। একরকম অ্যাডহক ব্যবস্থাই চলছে। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা এবং সরকারি কলেজে উচ্চ শিক্ষার প্রসার একটি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। প্রশাসনিক কর্তৃত্ব না থাকলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি কলেজগুলোর প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভর্তি, ফরম পূরণ ও পরীক্ষা গ্রহণের বিশাল কর্মযজ্ঞ পালন করতে হচ্ছে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের। শুরুতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিসিএস ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হলেও এখন আর তা করা হচ্ছে না। এখানে একটি সমন্বয়হীনতা রয়ে গেছে। শিক্ষা ক্যাডারের গঠনের সময় কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য গঠিত প্রতিষ্ঠান এডুকেশন এক্সটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে ক্যাডার শিডিউলভুক্ত করা হয়। প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি নামে উন্নীত করার সময় এটিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিডিউলভুক্ত না করে বিষয়টি অসম্পূর্ণ রেখে দেওয়া হয়।

এ রকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। সেদিকে যাব না।  বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে যেটা বোঝা যায়, তা হলো, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ভূমিকাকে সংকুচিত করার একটা প্রচেষ্টা আছে। শিক্ষা বিভাগ যখন ক্যাডারভুক্ত ছিল না তখনও এর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ শ্রেণিকক্ষ শিক্ষক ও অন্যান্য বিভাগীয় কর্মকর্তাদের হাতেই ন্যস্ত ছিল।

শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন দফতর ও প্রকল্প থেকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পরিবর্তে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি, একটি বক্তব্য সামনে আসছে, শিক্ষকরা প্রশাসক হতে চান। এটি কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বের একটি দুঃখজনক পরিণতি ছাড়া কিছুই না। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে পদ-পদবির লড়াই কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরাই শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চতর পদে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। এই ব্যবস্থাতেই শিক্ষার বিকাশ ত্বরান্বিত হবে বলে যেকোনও বিবেচক ব্যক্তি মত দেবেন। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেই ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিয়েছেন। জাতীয় শিক্ষানীতির নানা অধ্যায়ে এই বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, শিক্ষানীতির খসড়ায় শিক্ষকদের মধ্যে থেকে শিক্ষা সচিব নিযুক্ত হবেন, এমন নির্দেশনা থাকলেও চূড়ান্ত প্রস্তাবনায় সেটি বাদ পড়ে।

২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেলে ঘোষিত হলে ২৬ টি ক্যাডার সার্ভিস ও অন্য সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাদের অভিযোগ ছিল, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের মাধ্যমে সচিবালয়ের বাইরে অন্যান্য পেশাকে দুর্বল করা হয়েছে। তারা সরকারের কাছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করার দাবি জানান। ২৬ টি ক্যাডারের বঞ্চনা দূর করতে প্রধানমন্ত্রী একটি কমিটি গঠন করে দেন এবং সেই কমিটিকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে সময় বেঁধে দেন। সেই ঘটনার পর দুই বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। সমস্যার সমাধান হয়নি। নতুনভাবে বৈষম্য বেড়েছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা মনে করেন, পেশাগতভাবে তারাই সবচেয়ে বঞ্চিত। অন্যান্য ক্যাডারে ছয় থেকে নয় ধাপ পর্যন্ত পদসোপান থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারে পদসোপান চারটি। মহাপরিচালকের একটি পদ বাদে ১, ২ ও ৩ নং গ্রেডে কোনও পদ নেই। সর্বোচ্চ পর্যায়ের অধ্যাপক পদটি বেতন স্কেলে চতুর্থ গ্রেডে। মহাপরিচালকের পদটিতে পদোন্নতি না দিয়ে অধিকাংশ সময় চলতি দায়িত্ব দিয়ে কাজ চালান হয়। অধিদফতরে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি হয়নি। শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পদগুলোয় তাদের অবস্থানকে নিরাপদ করা হয়নি। পাবলিক পরীক্ষা চলার সময় তারা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। এমন একটি পেশায়, গত চল্লিশ বছরের আত্তীকরণের ফলে অসামঞ্জস্য আরও বেড়েছে। নিচের দিকে পদ সৃষ্টি হলেও অন্যদিকে পদ সৃজন সেভাবে হয়নি। আত্তীকৃত শিক্ষকরা মামলা ও তদ্বিরের মাধ্যমে চাকরির বিধি-বিধানকে পাশ কাটিয়ে পদোন্নতির পরীক্ষায় সুবিধা নিয়েছেন। তদ্বিরের জোরে সরকারি কলেজ ও শিক্ষা সংক্রান্ত দফতরগুলোর নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন। তাদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা যে, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারকে দুর্বল করার জন্যই তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান না করে সময়ে সময়ে আরও জটিল করা হয়।

উপজেলা পর্যায়ে ২৮৩ টি কলেজের জাতীয়করণকে দেখতে হবে সেই বৃহত্তর ক্যানভাস থেকে। জাতীয়কৃত শিক্ষকদের ক্যাডার বহির্ভূত রাখার দাবিটিকে সংকীর্ণ মনে হতেই পারে। কিন্তু প্রতিটি সার্ভিসেরই অধিকার আছে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার। একটি ক্যাডার সার্ভিস একটি একক ইউনিট। পিরামিড কাঠামোতে নেতৃত্বের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সেই পিরামিডের ওপরের দিকে মজবুত না করে নিচের দিকে অনাবশ্যক বিস্তার ঘটানো হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে কলেজ জাতীয়করণের বিষয়টি এসেছে জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে। শিক্ষানীতিতেই আছে কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা। সেই বিকল্পটি মোটেই ভাবা হয়নি। জাতীয়করণের জন্য নীতিমালা ও নীতিমালা অনুযায়ী বিধি প্রস্তুতের কথাও শিক্ষানীতিতেই আছে। অথচ ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো করে কলেজ বাছাই, জরিপ, সম্পত্তি হস্তান্তর ইত্যাদি কাজগুলো আগে করা হয়েছে। বিধি করার জন্য সাত বছর অনেক দীর্ঘ সময়। কলেজের তালিকা প্রস্তুতির আগে বিধি তৈরি করে ফেললে কোনও ধরনের জটিলতাই সৃষ্টি হতো না। যে সব কলেজ অন্তর্ভুক্ত হতো তারা জেনেশুনেই প্রক্রিয়াতে সংযুক্ত হতেন। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বেসরকারি কলেজের উন্নয়নের জন্য অনেকগুলো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা উদ্ধৃত করছি:

অধ্যায়: শিক্ষা প্রশাসন

শিক্ষানীতির আওতাধীন ও এমপিওভুক্ত সব ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষন, বদলি ও পদোন্নতি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ, নিয়োগকৃত শিক্ষকদের মানোন্নয়ন এবং সীমিত জাতীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কতিপয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে:

  • সরকারি অনুমোদন ও আর্থিক সহায়তাপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইবতেদায়ি মাদ্রাসা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা ও কলেজের জন্য মেধাভিত্তিক ও উপযুক্ত শিক্ষক নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারি কর্মকমিশনের অনুরূপ একটি বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে;
  • বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশনের  মাধ্যমে দ্রুত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নির্বাচন করে এলাকাভিত্তিক ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে;
  • বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরকে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার নিরিখে (উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন, মৌলিক গবেষণা কর্ম, শিক্ষাদান পদ্ধতি উন্নয়ন ইত্যাদি) প্রতিযোগিতামূলকভাবে উচ্চতর পদে নিয়োগ দেওয়া হবে, যেমন প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত বিধিমালার আওতায় এ ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হবে। বেতনবৃদ্ধি সফল প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর যোগ্যতা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। বৃহত্তর পরিসরে শিক্ষকদের মৌলিক সুবিধাদি নিশ্চিত করে অন্যান্য সুবিধাদি অর্জিত যোগ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত করা হবে;
  • বেসরকারি মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক নিবন্ধনের জন্য বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষ (NTRCA) নামক একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা রয়েছে। পৃথক বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে NTRCA–এর আবশ্যকতা থাকবে না ফলে একে বিলুপ্ত করা হবে;
  • সব পর্যায়ের সব ধারার সব স্তরের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চাকরি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় বদলিযোগ্য হবে। সরকারি প্রয়োজনে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমধারার সমস্তরের প্রতিষ্ঠানে সমপর্যায়ের পদে বদলি করা হবে;
  • সব পর্যায়ে সব ধারার শিক্ষকদের নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক হবে। এ লক্ষ্যে বিদ্যমান প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হবে।

দেশে বেসরকারি কলেজ আছে পাঁচ হাজারের ওপরে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ২৮৩ টি কলেজ সরকারি হলে আরও ৯৫% শতাংশ কলেজ বেসরকারি রয়ে যাচ্ছে। শিক্ষানীতিতে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এই ৯৫% শতাংশ কলেজগুলোর উন্নয়ন না করে পাঁচ শতাংশ কলেজের শিক্ষকদের ভাগ্যোন্নয়ন কেন এত গুরুত্ব পেলো? সেটিও হচ্ছে পেশাগত-প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, এর আগে ২০১২ সালে শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামোর ও পৃথক শিক্ষা কমিশনের ফাইলটি অগ্রসর হতে। সেই প্রস্তাবনায় অনাবশ্যকভাবে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের নিয়োগ ও বেতন কাঠামোর প্রসঙ্গটি সংযুক্ত করা হয়। বিসিএস সাধারণ শিক্ষার সদস্যরা সরকারি চাকরি করেন। তাদের বেতন কাঠামো জাতীয় বেতন স্কেলে সুনির্দিষ্টকৃত। পদোন্নতি, পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের সমস্যাগুলোর সঙ্গে তাদের যুক্ত করার কোনও কারণই থাকতে পারে না। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা দেখা করে এই বিচ্যুতির বিষয়টি তার নজরে আনেন। যার ফলে সেই প্রচেষ্টাটি স্থগিত হয়। আমরা আরও দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী কিছু অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের স্লোগানকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছেন। এবং সেই ব্যবস্থায় বিসিএস ক্যাডারভুক্ত এবং অন্যান্য ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই নিয়োগ পদ্ধতির সুপারিশ করছেন। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের যোগ্যতার সঙ্গে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের যোগ্যতার বিষয়টি তুলনা করে পরোক্ষভাবে তাদেরকে আত্তীকরণের বিষয়ে তার ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করছেন। অর্থাৎ, শিক্ষা খাতে সরকারের যেকোনও সংস্কার উদ্যোগকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কাঠামোয় জবরদস্তি ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এতে করে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের পেশাগত উন্নয়ন এবং বেসরকারি কলেজের উন্নয়ন—দু’টোই উপেক্ষিত হচ্ছে। সরকারের উচিত, বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা। কেননা, বিষয়গুলোয় পেশাগত ঈর্ষা ও দুর্নীতির বহু প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই যখন অবস্থা, তখন, ক্যাডার শিক্ষকদের সঙ্গে জাতীয়করণের তালিকাভুক্তদের যে দ্বন্দ্ব; সেটাকে কেউ কৃত্রিম বললে তাকে দোষ দেওয়া যাবে কি?

যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বর্তমান সমস্যাটিকে আরও জটিল হতে না দিতে চাইলে জাতীয়করণের তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের চাকরি পরিচালনার জন্য অবিলম্বে বিধি প্রস্তুত করতে হবে। পারস্পরিক জ্যেষ্ঠতা, মর্যাদার তুলনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গত কয়েক দশকে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এসব পরীক্ষা জাতীয় শিক্ষার অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। প্রতিটি পেশাকে তার নিজ জায়গায় রেখে বিকাশের ব্যবস্থা করা যায়। কলেজ জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ ও পৃথক ব্যবস্থাপনায় তাদের যেকোনও সুযোগ-সুবিধা দিলে বিতর্কের কোনও সুযোগ থাকে না। বেসরকারি কলেজের জন্য সরকার বিশাল উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তাদের নিজেদের মধ্যে বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদির সুস্পষ্ট নির্দেশনা শিক্ষানীতিতেই আছে। এ সব উন্নয়নের জন্য বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার পুরো কাঠামোটাকেই বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণ করার পরামর্শ কেউ দেবে না। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করা হয়েছে, সেই পথে সেটিকে প্রবাহিত করা প্রয়োজন। শিক্ষা ক্যাডারের মধ্যেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আন্তঃসম্পর্কের বিষয়গুলো অসম্পূর্ণ আছে। সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের পদে শিক্ষা খাতের প্রতিনিধিত্বকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যাতে করে এই পেশার সদস্যগণ জাতীয় নীতির গঠনে আরও নিবিড়ভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন। মৌলিক জায়গায় অংশিদারিত্বের বিষয়কে পাশ কাটিয়ে গৌণ একটি বিষয়কে এত প্রাধান্য দেওয়ার ফলেই সরকারের প্রতিটি উদ্যোগ মাঝপথে হোঁচট খাচ্ছে। সব শ্রেণির শিক্ষককে অবশ্যই এক ছাতার নিচে আনতে হবে। তার জন্য সার্ভিস একীভূতকরণ জরুরি নয়। শিক্ষানীতির নির্দেশনা অনুযায়ী স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হলে সেই প্রতিষ্ঠান এসব বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, প্রস্তাবিত ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ জাতীয় শিক্ষানীতির সময়োপযোগী পরিমার্জন ও প্রয়োজনে পরিবর্তন করারও দায়িত্বপ্রাপ্ত (জাতীয় শিক্ষানীতি, পৃ ৬২)। তাই যত দ্রুত আমরা কথিত ক্যাডার-নন ক্যাডার দ্বন্দ্বের এই কৃত্রিম সংকট থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে শিক্ষা খাতের প্রকৃত সমস্যাগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে পারব, ততই মঙ্গল।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি, বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ।

ইমেইল:  [email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ