X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

‘বেল পাকবে গাছে, তাতে কাকের কী?’

জোবাইদা নাসরীন
৩০ জুন ২০১৮, ১৬:৫৪আপডেট : ৩০ জুন ২০১৮, ১৬:৫৭

জোবাইদা নাসরীন বাজেট শব্দটা একবারেই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের ব্যবহৃত শব্দ এবং অনেকটাই অফিসিয়াল। ‘খেটে খাওয়া’ মানুষদের অভিধান অন্যরকম। তারা কামাই করে, খরচ করে। তাই বাজেটের অনুবাদও তাদের জীবনে ভিন্নভাবে আসে। ব্যাপক প্রত্যাশা নিয়ে সংসদে বাজেট পাস হয়েছে।  অথমন্ত্রী বলেছেন, এই বাজেট নির্বাচনি বাজেট, আর যেটি বলেননি, সেটি হলো এই এই বাজেট  অবশ্যই একটি রাজনৈতিক বাজেট, এই রাজনীতি অবশ্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়।  আমি অর্থনীতির মানুষ নই, তাই আমার বাজেটের বোঝাপড়া তাদের মতো হবে না বরং খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, দুঃস্বপ্নের সঙ্গে চলনসই সরল-জটিল কিংবা  তকমাবিহীন জীবনকেই বাজেটের প্রতিচ্ছবি মনে হয় আমার। কারণ এই মানুষদের কাছে বাজেট মানেই  প্রতিদিনের সঙ্গে থাকা পণ্যের দামের উত্থান-পতন।  তাই বাজেট মানে পণ্য দামের সেই ওঠা-নামা তার হিসাবের নিক্তিতে টানটান থাকা সংসারের দড়িতে বাড়তি টান পড়বে কিনা, সেই চিন্তায় মনোযোগী হয়ে ওঠা।  তাই পণ্যের শুল্ক কমা-বাড়া তাদের জীবনে কোনও ধরনের বাড়তি অর্থ তৈরি করে না।  আমলা, অর্থনীতিবিদরা যখন  বাজেট উচ্চাভিলাষী নাকি বাস্তবায়নযোগ্য–এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান, তখন এই শ্রমজীবী মানুষদের করের ও ভ্যাটের হিসাব কষতে তাদের একবারও মাথা ঘামাতে হয় না।  বাজেট আসছে, বাজেট আসবে–এই কথাগুলো শুনলেই তাদের সামনে ঘুরতে থাকে তার আয়-খরচ আর যদি দু’চার টাকা সঞ্চয় করতে পারে—সেই ভাবনা। এর বাইরে কোনও হিসাবের ধার ধারে না তারা, কারণ এই মানুষদের জীবন খুচরা, তাদের আয়ও সীমিত। তাদের শঙ্কা সীমিত আয়ে সংসারের চাকা কীভাবে ঘুরবে? বাজেট বাজেট বলে হৈচৈ করা পাবলিকদের দলে তারা নেই, তারা নিশ্চিত জানে, বাজেটের কোনও ভালো-মন্দই তাদের স্পর্শ করবে না।

এই মাসজুড়ে হয়েছে, সংসদে হবে বাজেটের ওপর দীর্ঘ আলোচনা।  সাধারণ মানুষেরা এই আলোচনা শোনে না। কারণ  কালো টাকা সাদা করার প্রয়োজন তাদের জীবনে নেই। গাড়ির  শুল্ক বাড়ানো-কমানোর ওপরও তাদের প্রতিদিনের মুচড়ে যাওয়া জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই। তাই অর্থমন্ত্রীর বিশাল অঙ্কের বাজেট, পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক সম্মেলন কিংবা এর ওপর আলোচনা—কোনোটিই এই মানুষদের স্পর্শ করে না। এবারের বাজেটের অঙ্কটি কত ডিজিটের, সেটি জানাও তাদের অনেকের জন্য হয়তো জরুরি হয়ে ওঠে না।

ঠিক তাদের মাথাব্যথা নেই বাৎসরিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, জিডিপি, ভ্যাট, উৎস কর, অভ্যন্তরীণ ঋণ, বৈদেশিক ঋণ, অনুদান কিংবা উন্নয়নশীল হিসেবে বাংলাদেশের সূচকের ঊর্ধ্বগতি নিয়েও।  তারা শুধু আশ্বস্ত হতে চায়—বাজারে চাল, ডাল, শাক-সবজি, তেল, চিনি; এইগুলোর দাম বাড়বে না। বাড়বে না বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাসের দামও। কারণ জুন মাসে বাজেট ঘোষণা হলেও তার আয় বৃদ্ধির কোনও ধরনের সম্ভাবনা  নেই। তার চিন্তা তাই সাকুল্য রোজগারের টাকা দিয়ে সারাটা মাস বাচ্চাদের নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবে কিনা। যে কারণে দেশের বাজেটটি তাদের নিজের হয়ে ওঠে না। শুধু শ্রমজীবী মানুষই নয়, এবার যদি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীসহ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে যে, এই বাজেট আসলে তাদেরও নয়।

এ বছরেই জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের মানদণ্ডে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় (টাকার মূল্য প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৪১৬ টাকা)। এই অর্থবছরে (২০১৭-১৮) জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। একদিকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এনে দিচ্ছে মর্যাদা অন্যদিকে  বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ যাত্রার দীঘদিনের সঙ্গী উন্নয়ন সহযোগীদের বাংলাদেশ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে বাধ্য করছে।

তবে লক্ষণীয় যে, এই  মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের ৩০ লক্ষাধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কয় জনের জাতীয় মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? ফলে নিজস্ব অর্থায়নে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সরকারের কাছে খুবই চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নিঃসন্দেহে। এবারের বাজেটে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ অনেক কম। বাজেটে পাহাড়ে বরাদ্দ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। পাহাড়ের বাঙালি ও পাহাড়ি উভয়ের জন্য এই বাজেট। সমতলের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৩০ কোটি টাকা। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতারা বলছেন, এই বাজেটে  তাদের সঙ্গে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য এই অর্থ রাখা হয়েছে, যা সত্যিই হতাশাজনক। এই বছর প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রাথমিক স্তরে ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় উপবৃত্তি প্রাথমিক স্তরে ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৪৫০ থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১০০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে।  এই বাজেটে  সুবিধাভোগীর মধ্যে থাকছে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচির আওতায় যোগ হচ্ছে ৫ লাখ মানুষ, বিধবা ভাতা কর্মসূচিতে আসছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ও অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ১ লাখ ৭৫ হাজার। পাশাপাশি আরও থাকছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ১০ হাজার, জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচিতে চা শ্রমিক ১০ হাজার, দারিদ্র্য মাতৃত্বকালীন মা ১ লাখ, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মা ৫০ হাজার ও ভিজিডির সুবিধাভোগী ৪০ হাজার। বলা হয়েছে  গত  ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৮টি খাতে ৭৫ লাখ জনগোষ্ঠীকে ভাতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু  এই  বাজেটে দেওয়া হবে প্রায় ৮৬ লাখ দরিদ্র মানুষকে। অর্থাৎ প্রায় ১১ লাখ মানুষ যোগ হবে এই কর্মসূচির আওতায়। এই কর্সূচিগুলো যে শুধু ভোটারদের সন্তুষ্ট করতে, সেটি  না বোঝার কিছুই নেই।

মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (এমডিজি)-এর অন্যতম একটি স্লোগান ছিল ‘কেউ পিছিয়ে পড়ে থাকবে না’– কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনে সরকার খুব বেশি সফল হয়নি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ‘হিজড়া লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও  এখনপর্যন্ত তাদের  কাজের  সংস্থান করে দিতে পারেনি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বা ভিশন ২০৩০ নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা উন্নয়নের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও এই পিছিয়ে পড়া  জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ। ২০২৪ সালের মধ্যে সবার জন্যই  বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে—এটাই হবে আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান  বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ক্রিকেটার নাসির-তামিমার মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানি ১৪ জুলাই
ক্রিকেটার নাসির-তামিমার মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানি ১৪ জুলাই
জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন করেই ছাড়বো: নাহিদ ইসলাম
জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন করেই ছাড়বো: নাহিদ ইসলাম
পদত্যাগ করে বৈষম্যবিরোধী নেতা লিখলেন ‘পদ ছেড়েছি প্রেম নয়’
পদত্যাগ করে বৈষম্যবিরোধী নেতা লিখলেন ‘পদ ছেড়েছি প্রেম নয়’
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
সর্বশেষসর্বাধিক