X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

প্রতিবাদের ঠোঁটে নিখুঁত সেলাই

তুষার আবদুল্লাহ
২৪ আগস্ট ২০১৯, ১৫:১৬আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০১৯, ১৫:১৭

তুষার আবদুল্লাহ ভোলেনি। ভুলে যাওয়া অসম্ভব। কারণ বিষয়টি এমন নয়, সমাজের অপরিচিত চরিত্র বা ঘটনা। প্রতিদিনই আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি। কিন্তু মুখ বুজে থাকি, ঠোঁট সেলাই করে রাখি। অনেকটাই আরও বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। আর কিছুটা, সমাজ যেন জানতে না পারে। সমাজ জানতে পারাও আরো বড় বিপদের। আঙুল তাক করে দেখাবে—ও-তো ওদের শিকার হয়েছিল? নিশ্চয়ই ওর দিক থেকেও উসকানি ছিল। চলাফেরায় ছিল না সংযত। তাই সমাজকে না জানানোই ভালো। এটি আমাদের অভিজ্ঞতাগত ধারণা। তাই অভ্যাসবশত চুপ করে যাই।
আমাদের ঠোঁটে সেলাই দেখে ওরা বলবান হয়, ক্ষিপ্র হয় হায়েনার মতো। ভয়ে আরও চুপসে যাই আমরা। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েও আড়াল নিলেন না রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক রাশেদুল ইসলাম। তার সামনেই স্ত্রীকে বখাটেদের হাতে উত্ত্যক্ত হতে হচ্ছিল। প্রতিবাদ করায় বখাটের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে শিক্ষক দম্পতিকে। ঘটনাটি সমাজের আড়ালে ঘটেনি। দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে ঘটেছে। প্রকাশ্যে ঘটলেও শিক্ষক দম্পতির সাহায্যে, বখাটেদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এগিয়ে আসেননি কেউ। সবাই ছিলেন বখাটেপনার মুগ্ধ দর্শক। লাঞ্ছিত দম্পতি অপমানে, লজ্জায়, ক্ষোভে গা ঢাকা দেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনাটি জানান শিক্ষক রাশেদুল ইসলাম নিজেই। ঘটনার বীভৎসতার কথা, মুগ্ধ দর্শকদের কথা জানিয়ে তিনি একথাও জানালেন—উচ্চ শিক্ষার পর দেশে  ফিরে আসার যে তার প্রবল ইচ্ছা ছিল, সেখানে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। এমনিতেই মূল্যায়ন ও যথাযথ সুযোগ না দেওয়ার কারণে আমাদের মেধাবী সন্তানরা দেশ ছাড়ছে। যার প্রভাবে সংকট বিদ্যায়তনে। সংকট সব পেশায়। এই বাস্তবতায় রাশেদুল ইসলামের অভিমান আমাকে শঙ্কিত করে তোলে।

রাশেদুল ইসলাম দম্পতিকে অভিনন্দন, তারা এই নিগ্রহের কথা বলতে পেরেছেন। আমরা অনেকেই বলতে পারিনি, পারছি না। ঘরের দুয়ার থেকে শুরু করে কাজের জায়গা, স্কুল-কলেজ, বাজার-হাট, অবকাশ কেন্দ্র, কোথায় আমরা বখাটেদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছি না। ঘরের ভেতরে থেকেও নিরাপদ আমরা, নিতে পারছি না নিশ্চিত নিশ্বাস। এই বখাটেরা নানা বয়সী। তবে সারাদেশেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর ও উঠতি তরুণরা। এরা লেখাপড়ার বাইরে তা নয়। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় নাম রয়েছে এমন কিশোর তরুণরাই যৌন নিপীড়নকারী বলে চিহ্নিত। মহল্লায় যৌন নিপীড়নের নানা কাজ করেও তারা কোনও শাসন ও বাধার মুখে পড়ছে না। বিদ্যায়তনে নয়, পথেও কেউ এদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেখাচ্ছে না। শুধু এদের সহিংস রূপের কারণে কেউ প্রতিরোধ করছে না, এমন নয়। এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করা, প্রতিবাদ করা সহজ। একটা সময় ছিল প্রতিবাদ বা শাসন করলে এরা ভয় পেতো। চুপ হয়ে যেতো। দ্বিতীয়বার এ ধরনের কাজে দেখা যেত না। তখন সমাজ ছিল ঐক্যবদ্ধ। পেশার মানুষেরা ছিলেন একজোট। ফলে একজন আক্রান্ত হলে, বাকিদের একই অনুভূতি হতো। এখন সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, পেশা বিভক্ত হয়েছে। নিপীড়ন এখন এককের। অন্যদের মধ্যে তা প্রবাহিত হয় না। বখাটেরা এই সুযোগটিই নিচ্ছে। তারা জানে সমাজে দর্শকের সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিবাদের ঠোঁটে নিখুঁত সেলাই দেওয়া। অতএব রাজ্য এখন  তাদের। সেই সঙ্গে তাদের আছে রাজনৈতিক ও আর্থিক ভগবান। সেই আশীর্বাদে বখাটেরা এখন গোত্র খুলে বসেছে। অসভ্যকালের গোত্র প্রথার রোগগুলো এখন সমাজে দৃশ্যমান। সেই দৃশ্য আমরা কেউ সয়ে যাচ্ছি। কেউ করছি উপভোগ। আমরা বুঝতে চাইছি না যে সহিংসতাকে আমরা উপভোগ করছি, সেই সহিংসতার শিকার আমিও হতে পারি আজ বা কাল। আমাদের দর্শক সারিতে বসে থাকার সময় মনে হয় শেষ। সময় এসেছে ঠোঁটের সেলাই খুলে নেওয়ারও।

না হলে কী হবে? আমাজন পুড়ছে। কেন পুড়ছে? ক্ষোভে। পৃথিবীকে ভালোবাসতে পারিনি আমরা। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যতটুকু যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, ততটুকু আমরা করতে পারিনি। মাটি-জলের দখল নিতে গিয়ে পৃথিবীকে উষ্ণ করে তুলেছি। সবাই যে কাজটা করেছে তা নয়। বাহুবল-অস্ত্রবল যাদের ছিল, তারাই শুষে নিয়েছে, লুটে নিয়েছে পৃথিবীর রূপ রস। বাকিরা পালন করেছে মৌনব্রত। পৃথিবী যে বিপন্ন হলো, টিকে থাকার সংকটে পড়লো, এজন্য মৌনব্রত পালনকারীরাও সমানভাবে দায়ী। কারণ মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে বাকিরা একজোট হতে পারেনি। যেমন আমরা দাঁড়াতে পারিনি, পারছি না বখাটে বা নষ্টদের বিরুদ্ধে। আজ আমাজনে যেমন ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি আমাদের সমাজের বেলায়ও তেমনটি হওয়ার আলামত দৃশ্যমান। রাষ্ট্রের পাশাপাশি নাগরিকদেরও তাই সরব হওয়ার সময় এসেছে। এবং অবশ্যই সেটি রাজনৈতিক বিভক্তিকে সিন্দুকে পুরে।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রহ্মপুত্রে নৌকাডুবি: এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার, নিখোঁজ ২
ব্রহ্মপুত্রে নৌকাডুবি: এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার, নিখোঁজ ২
জুলাই সনদ ঘোষণাসহ তিন দাবিতে ‘মার্চ ফর জুলাই রিভাইভস’ পদযাত্রা
জুলাই সনদ ঘোষণাসহ তিন দাবিতে ‘মার্চ ফর জুলাই রিভাইভস’ পদযাত্রা
পোশাক কারখানায় শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আরও একজন গ্রেফতার
পোশাক কারখানায় শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আরও একজন গ্রেফতার
ইউএসএআইডির অনুদান বাতিলের সিদ্ধান্তে মৃত্যুঝুঁকিতে দেড় কোটি মানুষ: গবেষণা
ইউএসএআইডির অনুদান বাতিলের সিদ্ধান্তে মৃত্যুঝুঁকিতে দেড় কোটি মানুষ: গবেষণা
সর্বশেষসর্বাধিক