X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছাত্র রাজনীতি ‘হ্যাঁ’, ছাত্র রাজনীতি ‘না’

বিভুরঞ্জন সরকার
১৪ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:৫৬আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ২০:২৪

বিভুরঞ্জন সরকার বুয়েটছাত্র আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশে প্রবল আলোড়ন তৈরি হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস-হানাহানি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। এর আগে, ছাত্র সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে কিংবা প্রতিপক্ষের আক্রমণে অকালে অনেক শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে। মা-বাবা-স্বজন-পরিজনের কান্না-হাহাকার বহুবার আমাদের শুনতে হয়েছে। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদ হয়েছে, নিন্দা হয়েছে, কিন্তু নিষ্ঠুরতা বন্ধ হয়নি। মা-বাবার বুক খালি হওয়াও থেমে নেই। আবরার হত্যাকাণ্ড এক্ষেত্রে নতুন ক্ষত যোগ করেছে। নানা কারণে এই হত্যাকাণ্ডটি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। দেশের সবচেয়ে নামকরা সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এ ধরনের বর্বরতা মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে প্রবলভাবে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, মেধাবী ছাত্ররাই বুয়েটে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। আমাদের মেধাবী সন্তানরা আলোকিত মানুষ হবে, নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তায় নিজেরা সমৃদ্ধ হবে, মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে, মুখ উজ্জ্বল করবে, তাদের সৃজনশীলতা দেশের জন্যও গৌরব বয়ে আনবে—এটাই হলো সাধারণ প্রত্যাশা।
কিন্তু আবরারকে দীর্ঘসময় ধরে পিটিয়ে যেভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, সেটা মানুষের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাহলে কী শিখছে, কোন পথে হাঁটছে? প্রশ্ন উঠেছে, আমরা কি শুধু ভালো ছাত্র চাই, নাকি ভালো মানুষও চাই? বুয়েটের মতো একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানবিকবোধসম্পন্ন শিক্ষা না পেয়ে কীভাবে অমানবিক দানব তৈরি হচ্ছে? এই যে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অসুস্থ ও বিকৃত মানসিকতা নিয়ে নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, তার দায় কার? এককভাবে কারও দিকে অভিযোগের আঙুল না তুলে আমাদের সবারই নিজের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা উচিত। পরিবার, মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক—সবার ভূমিকা, দায়-দায়িত্বই আলোচনায় আসা উচিত, কোন ফাঁকফোকর দিয়ে সর্বনাশের পথযাত্রা চলছে, তা খুঁজে দেখা দরকার। নিরাময়ের পথ সন্ধান করা দরকার। আমাদের সম্মিলিত স্খলন আমাদের ভয়াবহ পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই পতন রোধে এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আমরা অন্যের খুঁত আবিষ্কারে যতটা উৎসাহী ও পটু, নিজেদের গলদ দূর করতে ততটাই নিরুৎসাহী ও উদ্যমহীন। আবরারের করুণ মৃত্যু যেন আমাদের চেতনা জাগাতে সাহায্য করে। আমরা যেন ক’দিন মাতামাতি করে আরেকটি এমন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করি। এমন মৃত্যু আর একটিও নয়—এই অঙ্গীকার থেকে আমরা যেন বিচ্যুত না হই।

দুই.  

আবরারের মৃত্যু হয়েছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর হাতে। যেহেতু শাসক দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নাম এই খুনের সঙ্গে জড়িত, তাই এর প্রতিক্রিয়ার মাত্রাটা প্রবল হয়েছে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা। এটা ভালো না খারাপ, সেটা নিয়ে বিতর্কে না গিয়ে বলার কথা এটা যে, সব ছাত্রহত্যায় আমাদের প্রতিক্রিয়া একরকম হয় না। ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোনও ছাত্র সংগঠন ‘দুর্বৃত্ত’ তৈরি করেনি বা করছে না, ব্যাপারটা তেমনও নয়। ক্ষমতাসীনদের সমর্থিতরা বেশি বেপরোয়া হয়, এটা সত্য। যেমন—বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে মারকুটে সংগঠন হয়েছিল ছাত্রদল। এখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ, এখন লাগামহীন হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় ছাত্রলীগ বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। তারা নিজেদের অপরাজেয় মনে করছে। এমনকি ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোরতার বার্তাও সঠিকভাবে পাঠ করতে পারছে না। তাই ‘নিজের ঘর থেকে’ শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পরও ছাত্রলীগ বুয়েট শাখা এতবড় একটি অপরাধে জড়ানোর দুঃসাহস দেখালো।

আশার কথা এটাই, আবরার হত্যার সঙ্গে যে ছাত্রলীগ জড়িত, এটা সরকার অস্বীকার করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংগঠনিক পরিচয় না দেখে অপরাধীদের গ্রেফতার এবং কঠোর শাস্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অভিযুক্ত প্রায় সবাই গ্রেফতার হয়েছে। আইনানুগ শাস্তি তারা কেউ এড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। এর আগে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় থাকতে ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত খুনের ঘটনা ঘটেছিল। ছাত্রলীগের সেসময়ের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান, সাংগঠনিক সম্পাদক তাজুল ইসলামসহ অভিযুক্ত সবাই গ্রেফতার হয়েছিল এবং তাদের শাস্তিও হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ‘খুনি’ শফিউল আলম প্রধানসহ অন্যদের শাস্তি মওকুফ করে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন। ছাত্র সংগঠনগুলোকে সরাসরি রাজনৈতিক দলের লেজুড় বানানোর অপকর্মটিও জিয়াউর রহমানই করেছিলেন রাজনৈতিক দলবিধির (পিপিআর) মাধ্যমে।

আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বাইরেও কিছু ছাত্র সংগঠনও যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছে, সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংগঠনের গলাকাটা, হাতকাটা, রগকাটার ভয়াবহ সব স্মৃতি কি আমরা ভুলে গেছি? ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর থেকেই প্রকৃতপক্ষে দেশের ছাত্র আন্দোলনের চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। মূল রাজনীতি যতই দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে, ছাত্র সংগঠনগুলোও ততই ছাত্র স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে মনোযোগ হারিয়ে রাজনৈতিক দলের ডাণ্ডা বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। কারণ, এতে তাদের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয়েছে। একসময়ের ছাত্রনেতারা মধুর ক্যান্টিনে বাকি খেতো, আর এখনকার ছাত্রনেতারা গাড়ি-বাড়ির মালিক বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত।

মানুষ আগে ছাত্র রাজনীতির সমর্থক ছিল, ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের প্রতি সাধারণ মানুষের সম্মানবোধ ছিল। ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনীতি শুরু করায় তাদের প্রতি মানুষের অনুরাগ নেই, বরং বিরাগ বেড়েছে। ছাত্র সংগঠনগুলো এখন আর ভবিষ্যৎ নেতা তৈরির কারখানা নয়, উল্টো তারা তৈরি করছে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, মাস্তান, এমনকি খুনি পর্যন্ত।

তিন.

আবরার হত্যার পর দেশে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিটি আবার জোরালোভাবেই সামনে এসেছে। অবশ্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধ না করার পক্ষেও মত আছে। তবে যারা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ না করার যুক্তি দিচ্ছেন, তাদের চেয়ে নিষিদ্ধ করার পক্ষের যুক্তির জোর বেশি বলেই আমার মনে হয়। কেউ কেউ আবার দলীয় বৃত্ত থেকে ছাত্র রাজনীতিকে মুক্ত করার পক্ষে।

ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াত-শিবির তথা মৌলবাদীরা সুযোগ নেবে বলেও কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। প্রশ্ন হলো, ছাত্র রাজনীতি চালু আছে বলে কি দেশে জামায়াত-শিবির বা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রচার-প্রসারে কোনও সমস্যা হচ্ছে? ছাত্র রাজনীতি না থাকলে গণতন্ত্রের সর্বনাশ হবে বলে যারা মনে করেন, তারা কিন্তু প্রমাণ করতে পারবেন না, ছাত্র রাজনীতি অব্যাহত থাকায় গণতন্ত্রের কীভাবে শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে।

বলা হচ্ছে, ছাত্র রাজনীতি নয়, বন্ধ করতে হবে অপরাজনীতি, নষ্ট রাজনীতি, দুর্বৃত্ত তৈরির রাজনীতি। খুব ভালো কথা। তাহলে যতদিন রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরে না আসে, ততদিন অন্তত ছাত্র রাজনীতির ওপর বিধিনিষেধ থাক। তবে সমিতি-সংগঠন করা অর্থাৎ সংগঠিত হওয়ার যে অধিকার সংবিধান নাগরিকদের দিয়েছে, সেটা কেবল দলীয় ছাত্র সংগঠনের মধ্য দিয়েই কেন করতে হবে? আমরা কথায় কথায় ভিন দেশের উদাহরণ দেই। প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর কয়টা দেশে রাজনৈতিক দলের লেজুড় ছাত্র সংগঠন আছে? বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়ে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে সৃজনধর্মী কাজেও পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে। ছাত্ররা তাদের স্বার্থে সংগঠিত হোক, এমনকি অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীও হোক, কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থের লাঠিয়াল হিসেবে তাদের ব্যবহার বন্ধ হোক। ছাত্রদের নিয়ে, ছাত্রদের দিয়ে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি আর নয়। পৃথিবীর কোন দেশে কোন সেরা নেতা বা রাষ্ট্রনায়ক ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছেন? আবেগ ও স্মৃতিকাতরতা অনেক সময় যুক্তিকে আচ্ছন্ন করে। আমরা ভাবাবেগ দিয়ে চালিত হওয়ার অভ্যাস দূর করতে না পারলে আবরারের মতো আরও কারও জীবন দেওয়ার যন্ত্রণা ভোগের অপেক্ষায়ই থাকতে হবে।

লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়

 

/এসএএস/এমএনএইচ/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ