X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

উগ্রচিন্তা, নারী ও ইসলাম

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
০৮ মার্চ ২০২০, ১৬:৫৮আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২০, ১৭:৫৭

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার বাংলাদেশের ওলামাদের একটি অংশ বরাবরই নারীর কর্মে নিযুক্ত থাকার বিরোধিতা করে আসছেন। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফীর মতো অনেক আলেমই পিতামাতাকে তার কন্যাসন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে নিরুৎসাহিত করেন। কোনোরকম হিসাবপত্র রাখার মতো জ্ঞান অর্জন করলেই তাদের বিয়ে দেওয়া উচিত। সেটাই পিতামাতার কর্তব্য। উগ্র ইসলামপন্থীরাও একই মতবাদে বিশ্বাসী।  বলা যায়, এ দেশে একটি পক্ষ সব সময় নারীর ঘরের বাইরে কর্মে নিযুক্ত থাকার বিরোধিতা করে আসছে। তাদের ওই বিরোধিতা যে অজ্ঞতাপ্রসূত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাই সাধারণত ইসলাম ধর্মের অনুশাসন পালনকারী মুসলিমরা কখনও নারীদের কর্মে নিযুক্ত হওয়ার বিরুদ্ধাচরণ করে না। বরং যুগে যুগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশে পারিবারিক উৎসাহেই নারীরা ঘরের বাইরে নানাক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছেন নির্বিঘ্নে। শহুরে মুসলিম পরিবারে এখন নারী ও পুরুষের কর্মে নিযুক্ত হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক ঘটনা। বরং অনেক ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই যুগে সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহ করার জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীর কর্মে নিযুক্ত হওয়ার বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। তবে এখনও বিশ্বের জঙ্গিবাদী তৎপরতায় নিযুক্ত কথিত মুসলিম নামধারী একটি গোষ্ঠী ও গোঁড়াপন্থী আলেমরা বিশ্বাস করে যে, নারীরা কেবল ঘরের শোভাবর্ধন করবে, তাদের দায়িত্ব হবে কেবল সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালন করা। তারা নারীদের বাইরে কর্মে নিযুক্ত হওয়ার ঘোর বিরোধী। বর্তমানে আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতায় লিপ্ত গোষ্ঠীগুলোই প্রধানত এ ধরনের তত্ত্ব প্রচার করে। তাই বাংলাদেশে ওই ধরনের তত্ত্ব প্রচারকারীরা প্রকাশ্য জঙ্গিবাদী তৎপরতায় নিযুক্ত না হলেও তাদের নারীর কর্মে নিযুক্ত হওয়ার বিরোধিতা করা জঙ্গিদের চিন্তার পক্ষে যাচ্ছে। উভয়পক্ষের চিন্তাই উগ্র। বর্বর। অসভ্য।

দুই.

আল কোরআন অথবা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষার কোথাও এই বিষয়টি উল্লেখ নেই যে নারীদের বাইরে কাজ করা ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বরং নবী মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধের ময়দানে তাঁর পত্মীদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। বিবি আয়েশা বর্ণিত বহু হাদিসে সেই বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। ওহুদের যুদ্ধে মক্কার বাহিনী যখন খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়ে মদিনার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আশপাশে মাত্র কয়েকজন সাহাবী উপস্থিত ছিলেন। খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে ওই অপ্রত্যাশিত আক্রমণে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সৈন্যরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় শত্রুর তীরের আঘাতে নবী (সা.)-এর প্রাণ সংহারের উপক্রম হয় ঠিক তখন উম্মে আম্মারা নামে এক নারী ঢালের মতো দাঁড়িয়ে শত্রুপক্ষের ছোড়া তীর থেকে নবী (সা.)-কে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলে ওই নারী (উম্মে আম্মারা) তীর ও তলোয়ার দিয়ে তা প্রতিহত করেন।

অন্যদিকে নবী মুহাম্মদ (সা.) পত্নী বিবি আয়েশা (রা.) নিজেই উষ্টের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ওই যুদ্ধে বিবি আয়েশার নেতৃত্ব ইসলামি আইন ও অনুশাসনে পাণ্ডিত্য অর্জনকারী নবী মুহাম্মদের বহু ঘনিষ্ঠ সাহাবী অংশগ্রহণ করেন, যে ইতিহাস প্রায় সবার জানা। যেখানে নারীদের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি ইসলামে রয়েছে সেখানে ঘরের বাইরে কাজ করা যাবে না এমন মত অগ্রহণযোগ্য।

ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনে স্পষ্টত নারীর কর্মে নিযুক্ত থাকার অনুমতি রয়েছে। আল কোরআনে বলা হয়েছে: ‘পুরুষ যা কিছু অর্জন করে তা পুরুষের জন্যেই নির্দিষ্ট আর নারীদের অর্জন নারীদেরই জন্যে।... (৪: ৩২)।’ আল কোরআনের ওই নির্দেশ মেনে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায়ও নারীরা জীবিকা উপার্জনের জন্য ঘরের বাইরে কাজে নিযুক্ত হতেন এমন অসংখ্য উদাহরণ আল হাদিস ও সিরাতগ্রন্থে পাওয়া যাবে। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম প্রিয় সাহাবী হজরত আবু বকরের কন্যা ও নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রিয়তমা স্ত্রী হাদিসবেত্তা হজরত আয়েশার বোন হজরত আসমার ৯ মাইল হেঁটে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া এবং আবার বোঝা মাথায় নিয়ে ৯ মাইল পথ হেঁটে বাড়িতে আসার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। আর মুসলিম শরিফে বর্ণিত অন্য এক ঘটনাও এক্ষেত্রে বড় প্রমাণ। সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ মুসলিম শরিফে উল্লেখ করা হয়েছে, খবির ইবনে আব্দুল্লাহর চাচি বিক্রির উদ্দেশ্যে তার বাগানের খেজুর ভাঙতে চাইলেন। কিন্তু এক ব্যক্তি তাকে এমন কাজে বাইরে যাওয়ার জন্য গালমন্দ করেন। তখন তিনি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে যান। নবী মুহাম্মদ (সা.) সব শুনে ওই মহিলাকে বলেন, তুমি নিশ্চয়ই যেতে পারো এবং তোমার বাগানের খেজুর সংগ্রহ করতে পারো। সম্ভবত বিক্রির অর্থ থেকে তুমি সদকা এবং সৎকাজ করতে পারবে।

নবী মুহাম্মদ (সা.) উপরোক্ত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, নারীরা যদি তাদের অর্থনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে পারে তাহলে সে সৎকাজ করতে সক্ষম হবে। নবী মুহাম্মদ (সা.) যেখানে নারীদের বাইরে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন এবং উৎসাহিত করেছেন সেখানে একশ্রেণির কথিত আলেমের নারীদের বাইরে কাজ করতে যাওয়ার বিরোধিতা করা গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের ওই দাবি আর যাই হোক ইসলামি জীবন বিধানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয় সেই বিষয়টি স্পষ্ট।

উগ্রপন্থী নারী বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মোকাবিলায় এ দেশের আলেম ওলামাদের উচিত ইসলাম ধর্মে নারীর কর্মে নিযুক্ত হওয়া দোষের নয় তা বেশি বেশি প্রচার করা। ওয়াজ মাহফিলসহ বিভিন্ন আলোচনায় এই বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা। আল কোরআনে জাহেলিয়া যুগে প্রচলিত বৈষম্যমূলক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে নারী ও পুরুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে সেই বিষয়টি তুলে ধরা। নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় আল কোরআন প্রদত্ত নারীদের ন্যায্য অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা করেছেন তা প্রচার করা। গোঁড়াপন্থীদের নারীর কর্মে নিযুক্ত হওয়ার বিরোধিতার বক্তব্যের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের মৌলিক অনুশাসন ও বিধিবিধানের কোনও মিল নেই, সেই বিষয়েই রাষ্ট্রীয় প্রচার-প্রচারণাও দরকার। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমই এগিয়ে আসতে পারে। তারা ইসলামি আইন, নীতি-নৈতিকতা ও অনুশাসনের প্রধান ও একমাত্র উৎস আল কোরআনের কোথাও ওই ধরনের বক্তব্য নেই অথবা নারীদের কাজে নিযুক্ত হওয়া ইসলামে শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়- সেই বিষয়টি তুলে ধরতে পারে।

পরিশেষে, উন্নয়শীল দেশের কাছে নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মডেল রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। গত এক দশকে শিক্ষা, প্রযুক্তি, গবেষণা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সামরিক বাহিনীতে অংশগ্রহণ অথবা এভারেস্ট জয় তথা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর ঈর্ষণীয় অগ্রযাত্রা সাধিত হয়েছে। নারীর এই অগ্রযাত্রাকে ধর্মান্ধ শ্রেণি কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। তারা নিজেদের স্বার্থে নারীকে সব সময় ঘরে বন্দি করে রাখতে চেয়েছে। আর তাদের ওই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তারা ধর্মকে ব্যবহার করেছে। যদিও অনেকের নারীকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর পর বিয়ে দেওয়ার তত্ত্ব এ দেশের সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেননি। কিন্তু তাদের সেই তৎপরতা যে বন্ধ হয়ে যায়নি তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তাদের নারীবিদ্বেষী হুংকার আমাদের সেই অভাসই দেয়। তাই এ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন তথা নারী অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার স্বার্থে সরকার ও গণমাধ্যমের উচিত হবে গোঁড়াপন্থী আলেমদের বিরুদ্ধে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার প্রচার জারি রাখা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
‘স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচতে প্রত্যেককে গাছ রোপণ করতে হবে’
‘স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচতে প্রত্যেককে গাছ রোপণ করতে হবে’
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হামাস, অগ্রহণযোগ্য বলছে ইসরায়েল
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হামাস, অগ্রহণযোগ্য বলছে ইসরায়েল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ