X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

করোনা ভাইরাস এবং বিশ্বায়নের উল্টোযাত্রা

মো. সামসুল ইসলাম
১৩ মার্চ ২০২০, ১৩:৫৯আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২০, ১৭:০৬

মো. সামসুল ইসলাম গত কয়েক দশক থেকে বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বহুল উচ্চারিত শব্দ। বিশ্বায়ন ধারণার প্রবক্তারা এতদিন বলেছেন যে যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অভাবনীয় বৃদ্ধি, গণতন্ত্রায়ন ইত্যাদির কারণে রাষ্ট্রীয় সীমানা অপসৃয়মাণ হবে এবং আমরা একটি উন্নত বিশ্বের দিকে ক্রমান্বয়ে ধাবিত হবো।  

কিন্তু করোনা ভাইরাসজনিত বা এই ধরনের বিশ্বব্যাপী সংক্রামক রোগ অথবা আঞ্চলিক বিভিন্ন দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ ইত্যাদির কারণে রাষ্ট্রসমূহের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার তথা বিশ্বায়নের ধারণা কতটুকু ভালো বা মন্দ সেই প্রশ্ন এখন উঠছে।

ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে। অতিমাত্রায় ভ্রমণ বা যোগাযোগের কারণে এক অঞ্চলের রোগ দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ বা যুদ্ধের প্রতিক্রিয়াও হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ব্যবসা বাণিজ্যে পড়ছে বিশাল প্রভাব।

আমরা আমাদের পোশাক শিল্পে বা ওষুধসহ বিভিন্ন রফতানি শিল্পে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা নিয়ে গর্বিত হলেও আসলে এগুলোর কাঁচামাল আসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। যেমনটি আমরা সবাই জানি মার্সিডিজ গাড়ি তৈরি হয় জার্মানে। কিন্তু এর যন্ত্রপাতির এক-চতুর্থাংশ মাত্র জার্মান। বাকিটা আসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। করোনা ভাইরাসের মতো সংক্রামক রোগ বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। শিল্প কারখানা বন্ধ হচ্ছে, এয়ারলাইন ব্যবসায় ধস নামছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ তো এরইমধ্যে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া তো আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিশ্বায়নের প্রভাব মানব জাতিকে বেশ ভালোভাবেই দিতে হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বা যুদ্ধের কারণে সৈন্যদের চলাচলের ফলে দেশে দেশে মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোমান সৈন্যরা মেসোপোটামিয়া থেকে ভয়াবহ প্লেগ নিয়ে আসে, যে মহামারি পৃথিবীতে রোমক সাম্রাজ্যের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করে। আধুনিক যুগে দেখা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সৈন্যদের ভ্রমণের কারণে দেশে দেশে স্প্যানিশ ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।  

চীনে করনো ভাইরাসের বিস্তার চীন তো বটেই, পুরো বিশ্বকে এক অভাবনীয় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। চীনা পণ্য বা যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভরশীলতা বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রকেই থমকে দিয়েছে। একদিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ, অন্যদিকে পরবর্তীতে চীনে করোনা ভাইরাসের প্রভাব বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। 

চীন কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয় তার ওপর নির্ভর করছে বিশ্বায়নের অনেক কিছু। তবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রতি নির্ভরশীলতা কমানোর এ সুযোগ তো নিতে চাইবে। বিশিষ্ট সাংবাদিক পিটার গুডম্যান নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় রাখঢাক না করেই লিখছেন, করোনা ভাইরাস ইতোমধ্যে ‘prompted a re-examination of the world’s central reliance on China as ground zero for manufacturing.’  

করনো ভাইরাস নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রগুলোকে তাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নিয়ে গভীর চিন্তায় ফেলবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং কোম্পানি অবশ্যই স্থানীয়ভাবেই পণ্য উৎপাদনের ওপর জোর দেবে। চাইবে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা কমাতে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বব্যাপী তাদের পরিকল্পনার পুনর্বিন্যাস ঘটাবে।

তবে বিশ্বায়নের ধারণা যে শুধু করোনা ভাইরাসের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তা নয়। আমরা দেখছি বিগত কয়েক বছর থেকেই টাকা পাচার, উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহ, চাকরি স্থানান্তর,অভিবাসন ইত্যাদির কারণে দেশে দেশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে।বিশ্বায়নের সুযোগ নিয়ে অর্থপাচার ও অন্য দেশে বসতি গড়া আমাদের দেশেই এক ব্যাপক আলোচিত প্রসঙ্গ। সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর এসেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকেই পাচার হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। উন্নত দেশগুলোতে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে উঠছে। টাকা ফিরিয়ে আনতে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। যেমন বাংলাদেশি টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কানাডাতেই এখন হৈ চৈ হচ্ছে। এগুলো তো বিশ্বায়নের কুফলই বলা যায়।   

এসবের ফলে দেশে দেশে আমরা বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদ, কঠোর অভিবাসন আইন, রফতানি সংকোচন ইত্যাদির মাধ্যমে যে ‘রাষ্ট্রই প্রধান’ এ ধরনের একটি আন্দোলন দেখছি। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা যুক্তরাজ্যের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ বা ব্রেক্সিট এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থীদের আরও উত্থান দেখতে হবে যারা হয়তো অভিবাসীদের ক্ষেত্রে কঠোর সীমানা নীতি মেনে চলবে। ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনের চরম দক্ষিণপন্থী নেতারা ইতোমধ্যে কঠোর সীমানা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা শুরু করেছেন। জনতুষ্টিবাদী নীতি বিভিন্ন দেশে হালে পানি পাবে। 

তবে এটা ঠিক যে করোনো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিশ্বায়নকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে। ২০০৩ সালে যখন সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল তখন থেকে এখন বিমান ভ্রমণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা মেশিন লার্নিংয়ের ওপর নির্ভরতা বাড়াবে, কলকারখানায় অটোমেশন বৃদ্ধি পাবে, কর্মচারী ছাঁটাই হবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। 

যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য সবাই বিশ্বায়নের নতুন এক কাঠামোর কথা বলছেন তখন করোনা ভাইরাস সবাইকে বিশ্বায়নের ঝুঁকির কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। মজার ব্যাপার, করোনা ভাইরাস আমাদের এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছে যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রযুক্তি কীভাবে মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করতে পারে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে করোনা ভাইরাসকে মোকাবিলা করা হচ্ছে। যেমন, রোবোটিক ক্লিনার দিয়ে বিচ্ছিন্ন ওয়ার্ডকে ডিসইনফেক্ট করা হচ্ছে, ভয়েস এসিস্ট্যান্ট দিয়ে বাসায় যারা কোয়ারেন্টাইনে আছে তাদের সাহায্য করা হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে, ইনফ্রারেড সেন্সর দিয়ে যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা দেখা হচ্ছে। সুতরাং একদিকে প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন এবং যোগাযোগ প্রক্রিয়ার ব্যাপক উন্নয়ন, অন্যদিকে রাষ্ট্র কর্তৃক নিজেদের সংরক্ষিত ও নিরাপদ রাখার প্রচেষ্টা নতুন এক ধরনের বিশ্বব্যবস্থার উন্মেষ ঘটাবে, যা হয়তো আমাদের সনাতন বিশ্বায়নের ধারণা থেকে ভিন্ন হবে। 

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিশ্বব্যাপী অফিসে সশরীরে উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা সীমিত করা হবে। যেমন, বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক অ্যানালিটিকস অপারেটর কেনটিকের মতে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর নর্থ আমেরিকা ও এশিয়ায় ভিডিও কনফারেন্সের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ফেসবুক এবং টুইটারের ব্যবহার বেড়েছে যেহেতু বাসায় অফিস করতে হচ্ছে। এর নতুন ধরনের ব্যবসায়িক প্রশাসনের ধারণার উদ্ভব হবে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মুখোমুখি মিটিংয়ের সংখ্যা যে অজানা আশঙ্কায় ভবিষ্যতে সীমিত করে ফেলবেন তা বিশেষজ্ঞরা বলা শুরু করেছেন। 

সবকিছু বিবেচনায় নিলে এটা বলা যায় যে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ডিগ্লোবালাইজেশনের ধারণাকে জনপ্রিয় করে তুলবে। বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের ঝুঁকিসমূহ নিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র,আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আরও সতর্ক হবে এবং আমরা হয়তো অচিরেই এক নতুন ধরনের বিশ্ব দেখবো।

লেখক: কলামিস্ট

ইমেইলঃ [email protected] 

 

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কলার চেয়েও বেশি পটাশিয়াম মেলে এই ৪ খাবারে
কলার চেয়েও বেশি পটাশিয়াম মেলে এই ৪ খাবারে
ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা রয়ে গেছে: নাহিদ ইসলাম
ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা রয়ে গেছে: নাহিদ ইসলাম
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে সাংবিধানিক কমিটি হবে: ডা. তাহের
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে সাংবিধানিক কমিটি হবে: ডা. তাহের
দিনের ভোট রাতে হওয়ার কথা স্বীকার করলেন সাবেক সিইসি নূরুল হুদা
দিনের ভোট রাতে হওয়ার কথা স্বীকার করলেন সাবেক সিইসি নূরুল হুদা
সর্বশেষসর্বাধিক