X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষ শুধু ছুটছে কেন?

উমর ফারুক
১১ জুন ২০২০, ১৬:০৫আপডেট : ১১ জুন ২০২০, ১৮:২৪

উমর ফারুক গতিই জীবন, জীবনই গতি। সেই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে মানুষ গতির মাঝে প্রাণ খুঁজেছে। পেয়েছেও। স্থিরতাকে মানুষ তাই জড়তা মনে করে। জীর্ণতা ও পৌঢ়তা মনে করে। সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি মানুষ শুধু এগিয়ে চলেছে। সেই এগিয়ে চলা জীবনের জন্য, জীবিকার জন্য। তাইতো, আমাদের ছুটে চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিদিন সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন সভ্যতা, নতুন নতুন জীবন। আমাদের ছুটে চলা প্রায় অধিকাংশ সময়ই প্রাণময় ও সৃষ্টিশীল। যদিও উদাসীন ও আবেগময় গতিশীলতা কখনও কখনও কেড়ে নিচ্ছে আমাদের জীবন ও জীবিকা।
প্রতিদিন আমরা ছুটছি, বিশ্ব ছুটছে। আমাদের অর্থনীতির চাকা ছুটছে। আমাদের সভ্যতা ছুটছে। যখন আমরা পায়ে পায়ে ছুটতে ক্লান্তি অনুভব করেছি তখন চাকা আবিষ্কার করেছি। পাখা আবিষ্কার করেছি। সেই পাখা দিয়ে আমরা পানিতে ভেসে বেড়াই। আকাশে উড়ে বেড়াই। সেই চাকা দিয়ে আমরা দুর্বার গতিতে ঘুরে বেড়াই পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। মানুষ ছুটলে সমাজ, রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকাও সমৃদ্ধ হয়, ছোটে। তাইতো, আমরা অবরোধ ভয় পাই, হরতাল ভয় পাই, লকডাউনকেও ভয় পাই।

মার্চের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ বাংলাদেশের মানুষ ছুটতে শুরু করলো। যে যেদিকে পারলো সেদিকে ছুটলো। রেলগাড়ি, ফেরি, ট্রাক সব জায়গায় মানুষের উপচেপড়া ভিড়। মানুষ ছুটে চলেছে! কোথায় চলেছে মানুষ? উত্তর খুব সহজ। সাধারণ ছুটি ঘোষণা হওয়ায় মানুষ গ্রামে ছুটে চলেছে। মায়ের কাছে, মাসীর কাছে, নাড়ির কাছে ছুটে চলেছে। সম্পর্কের কাছে ছুটে চলেছে। তার  ক’দিন পর পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেওয়া হলো। আমারও মানুষ ছুটলো। এবার ছুটলো ঢাকা শহরের দিকে, যার যার কর্মমস্থলের দিকে। শত মাইল হেঁটে, কাঁধে সন্তান নিয়ে, হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে মানুষ আবারও ছুটতে ছুটতে ফিরে এলো ঢাকায়। ট্রাকে উঠে, মাছের গাড়িতে উঠে, মাছে ড্রামে উঠে যে যেভাবে পারলো সেভাবে ফিরে এলো। এসে জানলো পোশাক কারখানাগুলো খুলছে না। ছুটি বাড়ানো হয়েছে। আবারও ছুটলো মানুষ। উল্টো পথে। তার ক’দিন পর যখন পোশাক কারখানাগুলো সীমিত আকারে খুললো তখন মানুষ আবারও ঢাকার উদ্দেশ্যে ছুটলো।

সরকারি ছুটি বাড়তে বাড়তে যখন ঈদ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকলো তখন মানুষ আবারও ছুটতে শুরু করলো। যে যার মতো করে আবারও ঢাকা শহর ছাড়তে শুরু করলো। গণপরিবহন বন্ধ, রেল বন্ধ, আকাশপথ বন্ধ, তবু মানুষের ছোটায় যেন কোনও ক্লান্তি নেই! বাধ্য হয়ে সরকার ফেরি চলাচল বন্ধ করে দিলো। তবুও মানুষ ছুটে চললো। ব্যক্তিগত পরিবহনে করে, ভাড়া পরিবহনকে ব্যক্তিগত পরিবহন বানিয়ে আমরা যে যার মতো প্রিয়জনের কাছে ছুটলাম। ঈদের ছুটি শেষে, সাধারণ ছুটি শেষে, আমরা আবার ছুটে এসেছি কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা কেন ছুটছি? কেন বারবার দিকবিদিক ছুটে চলেছি। করোনাকালীন এই সময়ে আমরা ঘরে বন্দি না থেকে ছুটছি কেন? কেন সরকারকে জোর করে, বাধ্য করে, আমাদের ঘরে রাখতে হয়েছে? কেন ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ববোধ আমাদের বন্দি করতে পারছে না? যদি একটু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করি তবে সারাবিশ্বের মানুষও এখন উল্টোপথে ছুটছে। তাতে হয়তো বিপদ আরও বাড়ছে, তবুও ছুটছে। ছুটেই চলেছে। হেঁটে গন্তব্যে ছুটতে গিয়ে ভারতে ইতোমধ্যে প্রাণ গেছে বহু মানুষের। ক’দিন আগে আমেরিকার নাগরিক, ব্রিটিশ নাগরিকরাও বাংলাদেশ ছেড়ে তাদের দেশে ছুটেছে। ওরা কেউ নৌপথে যায়নি, হেঁটে নয়, বাসেও নয়। গেছে বিমানে। তাই আমাদের অনেকের নজর হয়তো এড়িয়ে গেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক মানুষ সরকারের নির্দেশনা মানছে না। যখন সারা দেশ ‘লকডাউন’ ছিল, তখনও কিছু মানুষ কোনও না কোনও উদ্দেশে দিনে অন্তত দু’বার বাইরে গেছে। দোকানে দাঁড়িয়ে পান চিবিয়েছে। মুখে বলেছে, বিড়ি খেলে করোনা ঝুঁকি কমে। ‘ঘরে ভালো লাগছে না’ বলে, গায়ে হাওয়া লাগাতে মোটরবাইক নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে কিছু মানুষ। এসব বাইরে যাওয়া, অকারণ ছুটে বেড়ানো হাস্যকর ও অতিঅগ্রহণযোগ্য। কিন্তু এই খারাপ সময়ে খাবারের খোঁজেও বাইরে ছুটেছে কিছু মানুষ। সন্তানের দুধ কিনতে, মায়ের ওষুধ কিনতেও বাইরে ছুটেছে কিছু মানুষ। কিন্তু গণঅবাধ্যতার মাঝে আমরা এসব বাইরে যাওয়াকেও ক্রমাগত হাস্যকর করে তুলেছি। চাকরি বাঁচাতে বাইরে ছুটেছে মানুষ। আমরা তাদের গালমন্দ করি। তাদের আক্কেল, জ্ঞান নিয়ে তুচ্ছ কথা বলি। খাবারের সন্ধানে বাইরে ছুটছে মানুষ। গরম ভাতে ফুঁ দিতে দিতে আমরা তাদের গালমন্দ করি।

আমরা ভুলে যাচ্ছি, ঢাকা শহরে অসংখ্য মানুষ ছোট্ট একটি ঘরে গাদাগাদি করে বসবাস করে। কাজ ছাড়া, খাবার ছাড়া, চব্বিশ ঘণ্টা সেই ঘরে বন্দি থাকা একেবারেই অসম্ভব। ফলে লম্বা ছুটিতে তারা গ্রামে ফেরার জন্য ছুটেছে। আমরা আড়াই হাজার স্কয়ার ফুট বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের গালমন্দ করেছি। কটুকথা বলেছি। বলবো না কেন? বৃহত্তর জীবনের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য, সংকটকে যে কখনও কখনও মেনে নিতে হয়! ওরা কেন বোঝে না সেটা!

বাঙালি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার নিজের জীবনকে। আর তার চেয়েও বেশি ভালোবাসে প্রিয়জনকে, প্রিয়জনের প্রাণকে। সন্তানকে, মাকে, বাবাকে বাঙালি সবসময় নিজের জীবনের চেয়েও অধিক মূল্যবান জ্ঞান করে। সম্পর্কের একটা আলাদা দাম আছে বাঙালির কাছে। দুয়েকটি খারাপ উদাহরণ ছাড়া, বাঙালি সবসময় সম্পর্ক অত্যন্ত চড়া দাম দিয়ে কেনে। তাই তো প্রিয়জনের সঙ্গে উৎসবে দেখা না হওয়া তারা মানতে পারে না। তাই তো, প্রাণ বিপদগ্রস্ত হোক তবু প্রিয়জনের জন্য উপহার কিনতে না পারা তারা মানতে পারে না। সেজন্যই মানুষ উৎসবে প্রিয়জনের কাছে ছুটেছিল। তার জন্য উপহার কিনতে বাজারে ছুটেছিল। তাকে ভালো রাখার জন্য কর্মস্থলে ছুটেছে। যদিও এসবটাই এখন সামাজিক অপরাধ, এবং একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণও বটে। আমরা যেমন সম্পর্ককে ভালোবেসে এসব কাজ করি ও করছি, তেমনি সম্পর্ককে আরও একটু বেশি ভালোবেসে এসব কাজ করা অর্থাৎ ছুটে চলা আপাতত পরিহার করা আবশ্যক ও উত্তম।

ছুটে চলা যেহেতু মানুষের ধর্ম, সেহেতু মানুষ ছুটবেই। প্রয়োজনে ছুটবে, অপ্রয়োজনেও ছুটবে। আর রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজযন্ত্রেরও দায়িত্ব সেই ছুটে চলার লাগামটা টেনে ধরা। যে সম্পর্কের প্রয়োজনে মানুষ ছুটে চলছে সেই সম্পর্কের প্রয়োজনেই তার উচিত স্থির হওয়া। প্রিয়জনকে, পরিবারকে বিপদগ্রস্ত করার কোনও অধিকার মানুষের কোনও কালে ছিল না, এখনও নেই, সম্ভবত ভবিষ্যতেও থাকবে না। তবে সবার আগে রাষ্ট্রের উচিত যে যেখানে আছে সেখানেই তার জন্য ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। আমাদের সামনে এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র কী সেটা করতে পারছে? যদি না পেরে থাকে তবে এই দায় বৃহত্তর অর্থে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর বর্তায়। আর যদি পূরণ করার পরও সখ করে মানুষ কারণে-অকারণে দশ দিগন্ত ছুটে বেড়ায়, তবে সে দায় আপনাকে আমাকেই নিতে হবে। শক্ত হাতে সেসব ছুটে চলা বন্ধ করতে হবে, এবং তা এখনই। অন্যথায় সমগ্র রাষ্ট্র বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট কাল
ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট কাল
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
কান উৎসব ২০২৪কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ