X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

কেন বিশ্ববিদ্যালয় এতটা অরক্ষিত?

জোবাইদা নাসরীন
২৫ মে ২০২১, ১৫:১৮আপডেট : ২৫ মে ২০২১, ১৫:১৮

জোবাইদা নাসরীন খবরটি খুবই হৃদয়বিদারক। শিক্ষার্থীদের মৃত্যু প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে কাঁদায়, কাঁপায়, স্তব্ধ করে। কয়দিন আগেই ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের নিখোঁজের খবর পড়েছিলাম। কিন্তু কখনই মনে হয়নি ছেলেটি মারা যেতে পারে। গতকালই আট দিন নিখোঁজ থাকার পর তার সংবাদ জানতে পেরেছি। অতি মন খারাপ করা সংবাদটি হলো–নিখোঁজ হওয়া ছাত্রটির খোঁজ মিলেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। আট দিনের ব্যবধান অনেক কিছুর পার্থক্য করে দিয়েছে। সেই ব্যবধানে হাফিজের নাম মুছে গিয়ে এখন তার পরিচয় লাশ। হাফিজ আর জীবিত নেই।

হাফিজুরের এই মৃত্যু এবং আটদিন পর তার লাশের সন্ধান বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে শিক্ষার্থীদের। আমি নিশ্চিত লকডাউন না থাকলে হয়তো এটি নিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয় স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত থাকতো, প্রতিবাদে ফেটে পড়তো। বেশ কয়েকজন শিক্ষকও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, মানববন্ধন করেছে ছাত্রলীগও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো?

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার পরিবারই মৃত হাফিজকে শনাক্ত করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে হাফিজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫-২০১৬ সেশনের গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিল। এছাড়া তিনি টিএসসি কেন্দ্রিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং মুখাভিনেতা ছিলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারকে জানানো হয়েছে– হাফিজ ‘আত্মহত্যা’ করেছে। কোনও কোনও পত্রিকায় এই ‘আত্মহত্যার প্রচেষ্টা’র একটা ছোটখাটো বর্ণনাও পেলাম, এবং সেখানে প্রত্যক্ষদর্শীরও বিবরণ আছে। যদি সেই বিবরণ সত্যিই হয় তাহলে প্রথম প্রশ্নটিই হলো, একজন যুবক ছেলের সবার সামনে ‘আত্মহত্যা’র চেষ্টা এবং পরবর্তীতে তার মৃত্যু কীভাবে আটদিন অনেকটা গোপনই থাকলো? এটিতো স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানোর কথা। কেন এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জানতে আটদিন লাগলো? কিংবা তাদের জানানো হলো না? বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিন-রাত ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই কম-বেশি প্রক্টোরিয়াল টিম জানে বা তাদের জানানো হয়। এটা কেন জানতে পারলো না?

শহীদ মিনার এলাকাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে যা ঘটবে তা নিশ্চিতভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তাবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে পুলিশ যখন জানেত পারলো, ছেলেটি ‘আত্মহত্যা’ করেছে, তাহলে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানালো না কেন? কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার কোনও স্থানে এই ধরনের ‘আত্মহত্যা’র ঘটনা ঘটলে সেটিতো বিশ্ববিদ্যালয়কেই প্রথম জানতে হবে, এমনকী তিনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাও হোন। আর এখানে তো এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ঘটনা। এমনকি যদি তিনি ‘আত্মহত্যা’ও করে থাকেন তাহলেও এটি বিশ্ববিদ্যালয় জানার জন্য আটদিন সময় আসলেই বড্ড বেশি সময়।

শুধু ফেসবুকই নয়, হাফিজ নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ দুয়েকটি অনলাইনেও আমি পড়েছি। তার মানে হলো এটি অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু পুলিশ কেন তাহলে যোগাযোগ করলো না সাংবাদিকদের সঙ্গে? পুলিশের কাছে যখন তার ছবি ছিল সেই ছবি মিলিয়ে দেখলে অনেক আগেই জানা যেত সে কোথায় আছে। কিন্তু কেন হয়নি সেটিই আসলে প্রধান প্রশ্ন এখানে।

যে কারও মনে হওয়ার কথা যে ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পারে কারণ হাফিজুরের গায়ে ডাকসুর লোগো লাগানো টি-শার্ট ছিল।  জানা যায় ছেলেটি বাড়ি থেকেই সেদিনই ঢাকায় ফিরেছিল। সেদিন রাত থেকেই পরিবার ছেলেটির খোঁজ পাচ্ছিলো না। তখন তার পরিবারের পক্ষ থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানায় নিখোঁজের জিডি করা হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে আরও জানা যায়, শাহবাগ থানাকে অবহিত করা হয়েছিল জিডি বিষয়ে। যখন পুলিশ জেনেছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই এরকম একটি ছেলে মারা গেছে, তখন কেন সেই বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হলো না? এ বিষয়ে কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থানার কাছে জবাবদিহিতা চাইবে?

গত দুই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এমনিতেই নানা কারণে শিক্ষার্ক্ষীদের মধ্যে নানা ধরনের হতাশা আছে। এই বিষয়ে কোনও ধরনের দ্বিমতের সুযোগ নেই যে করোনার ছোবল শিক্ষার্থীদের বিরাজমান হতাশাকে আরও অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। ছেলেটি আত্মহত্যাও করতে পারে, কিংবা এটি হত্যাকাণ্ডও হতে পারে। তদন্ত ছাড়া কী হয়েছে সেটি বলা খুবই কঠিন। যেই হোক না কেন গত আটদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই ঘটে যাওয়া এই ঘটনা কেউই জানতে পারেনি।

কেন বিশ্ববিদ্যালয় এতটা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে? বিশ্ববিদ্যালয় যে অরক্ষিত সেটি কিন্তু কয়েক মাস আগেও বোঝা গেছে। কেননা কয়েকমাস আগেই শহীদ মিনারের পেছনে রাতের বেলা ফুল বিক্রেতা একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, তারপর তাকে হত্যাও করা হয়েছিল। সবই হয়েছিল এই শহীদ মিনার এলাকাতেই। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নিরাপত্তার অভাব বিষয়টি তখনও সামনে এসেছিল। ধারণা করি সেটি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনও ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করেনি। কিংবা ভেবেছে হত্যা তো করা হয়েছে ফুল বিক্রেতা মেয়েকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউতো মারা যায়নি। তাই্ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়তি কোনও ধরনের সতর্কতাও গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু হাফিজের মৃত্যু আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে আসলে বিশ্ববিদ্যালয় অরক্ষিত। এখানে যে কোনও সময়েই যেকোনও ঘটনা ঘটতে পারে। তাই কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি হাফিজের মৃত্যু ঘটনা তদন্ত করানোর ব্যবস্থা করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা।

শিক্ষক হিসেবে একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু মানা কঠিন, অসহ্যতো বটেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও পুলিশের কাছে তদন্ত দাবি করেছে। আর আমি দাবি করছি দুটোই, হাফিজের মৃত্যুর তদন্তের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কারণ আলো ছড়ানো শহীদ মিনার অঞ্চল কেন এত অন্ধকার নিয়ে আসবে?

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাছ কাটা ও লাগানোর বিষয়ে আইন-বিধি চেয়ে আইনি নোটিশ
গাছ কাটা ও লাগানোর বিষয়ে আইন-বিধি চেয়ে আইনি নোটিশ
জোরে সালাম শুনেই ঘাড় ফিরিয়ে উত্তর দেন খালেদা জিয়া
জোরে সালাম শুনেই ঘাড় ফিরিয়ে উত্তর দেন খালেদা জিয়া
বজ্রাঘাতে প্রাণ গেলো ১০ জনের
বজ্রাঘাতে প্রাণ গেলো ১০ জনের
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ