X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বেপরোয়া বাঙালি কাকে বলে

আবদুল মান্নান
১৯ জুলাই ২০২১, ১৭:১১আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২১, ১৭:১১
আবদুল মান্নান অনেক কিছুতেই বাঙালির সুখ্যাতি আছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে বাঙালি জন্মগতভাবে বেপরোয়া। ইতিহাসে বাঙালির এই বেপরোয়া চরিত্রের অনেক উদাহরণ আছে। ১৭৮২ সালে ইংরেজ বাহিনীর আগ্রাসন ঠেকাতে গিয়েছিলেন তিতুমীর বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে। ইংরেজদের কামান বন্দুকের কাছে স্বাভাবিক কারণেই তিনি টিকতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান মুক্তিকামী বাঙালিকে জানিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু বিগত রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। পরদিন একই রেডিও থেকে ঘোষণা করা হলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য মানুষ যেন মরিচের গুঁড়া আর বাঁশের লাঠি নিয়ে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে জমায়েত হন। দুপুরের পর থেকে দলে দলে মানুষ মরিচের গুঁড়া আর বাঁশের লাঠি নিয়ে জমায়েত হওয়া শুরু করলো। পরে অবশ্য আর এক ঘোষণায় আগের ঘোষণা বাতিল করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ইরাক দখল করলো। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ও মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ঘোষণা করলেন, চট্টগ্রাম থেকেই ইরাক পুনরুদ্ধার যুদ্ধ শুরু হবে। একটি কমিটি গঠন করা হলো। তবে স্বাভাবিক কারণেই সেটা কার্যকর হয়নি।

বাঙালির বেপরোয়া স্বভাবের দু’একটি খারাপ নমুনাও আছে। সরকারি প্রকল্পের বালিশ কেনা হবে। শত টাকার বালিশ ছয় হাজার টাকা করে কেনা হলো। অ্যাপার্টমেন্টে উঠানোর মজুরি সাত শত ষাট টাকা। একজন পি কে হালদার আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিলো সবার চোখের সামনে। টাকাগুলো ছিল অন্য মানুষের। এমন উদাহরণ অসংখ্য আছে। কতটুকু বেপরোয়া হলে বাঙালি এমন সব অপকর্ম করতে পারে তা অনুমেয়।

তবে বাঙালির বেপরোয়া চরিত্র প্রদর্শনে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেলো এবার করোনাকালে একশ্রেণির মানুষের এই ভয়াবহ অতিমারির প্রতি তাচ্ছিল্য। তারা অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও হার মানিয়ে দিলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন গত বছর ট্রাম্প প্রশাসনকে এ বিষয়ে সতর্ক করলো, তখন ট্রাম্প জানিয়ে দিলেন ও কিছু না। ওটা চীনাদের সমস্যা। এই মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্র মৃত্যুর দিক থেকে প্রথম। করোনায় দেশটিতে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে  ছয় লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তারপরও সে দেশের অর্ধেক মানুষ বিশ্বাস করে না করোনা নামের কোনও মহামারি আছে। অনেক স্টেটে মানুষের টিকা নিতে কোনও আগ্রহ নেই। টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে কোনও কোনও শহরে টিকা নিলে বন্দুক উপহার দেওয়ার ঘোষণা করেছে (পশ্চিম ভার্জিনিয়া)।

ওহায়াও ঘোষণা করেছে প্রতিজন টিকা গ্রহণকারীকে লটারির টিকিট দেওয়া হবে। জিতলে কোটি ডলার। মাস্ক? ওটাতো মুসলমানদের। মুখে পরলে ‘জঙ্গি’ মনে হয়। এই ঘরানার বেশিরভাগই আবার ট্রাম্প সমর্থক।

চীন, যেখান থেকে বলা হয় এই অতিমারির উৎপত্তি। সেখানে সরকার হুকুম দিলেই মানতে হয়। না হয় কপালে খারাবি আছে। সেখানেও জনগণের মাঝে টিকা নিতে অনাগ্রহ। সুতরাং বলা হলো যারা টিকা নেবে তাদের জন্য পুরস্কার অপেক্ষা করছে। পুরস্কারের ধরনও বেশ মজার। ডিম আর টয়লেট টিস্যু পেপার কেনার কুপন। তাইওয়ান টিকা গ্রহণকারীদের দিচ্ছে চিকেন ফ্রাই আর স্যুপ।

বেপরোয়া বাংলাদেশিদের কথা বলতে গেলে প্রথমে কিছু আনন্দদানকারী স্বঘোষিত অর্ধশিক্ষিত মোল্লাদের কথা বলতেই হয়। তেমন একজন আমির হামজা। তার বিনোদনমূলক মাহফিলে ঘোষণা করলেন মুসলমানদের করোনা হবে না। যদি হয় পবিত্র কোরআন মিথ্যা হয়ে যাবে (নাউজুবিল্লাহ)। কিছু দিন পর তিনি জানালেন, দেশে যেহেতু করোনায় মানুষ মারা যাচ্ছে সেহেতু বেশি বেশি করে ‘মাহফিল‘ করেন (লাখ টাকা আগাম দিতে যেন ভুল না হয়)। এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি জাতিকে অবহিত করলেন, যেদিন পর্যন্ত মুসলমানরা টিকা আবিষ্কার না করবে ততদিন পর্যন্ত তিনি টিকা নেবেন না। তবে তিনি যে তরিকতে ইসলাম চর্চা করেন বা পড়েন সেই তরিকতে তো এটি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। হয়তো তিনি জানেন না ফাইজারের টিকা যারা আবিষ্কার করেছেন তাদের মধ্যে তুরস্কের বংশোদ্ভূত মুসলমান বিজ্ঞানীরাও ছিলেন। এই আমির হামজা আরও আবিষ্কার করলেন, এই টিকায় এক ধরনের চিপস আছে, যা শরীরে প্রবেশ করলে মানুষ টয়লেটে গেলেও তিনি সেখানে কী করছেন তা জানা যাবে। আর একজন প্রচার করলেন টিকা নিলে মানুষের লিঙ্গান্তর হয়ে যাবে। বাংলাদেশ এখন বিনোদনদানকারী ‘কাট মোল্লাদে’র ব্যবসা বেশ রমরমা। যাত্রাপালার বদলে মানুষকে তারা বেশ ভালো সেবা দিচ্ছে।

দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক সুশীল আছে। তাদের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ যাই করে না কেন তার মধ্যে নিশ্চয় কোনও খারাপ উদ্দেশ্য আছে। ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আসছে। ভারত থেকে? নিশ্চয় তাতে হয় ‘গো মূত্র’ থাকবে অথবা পানি। গত ঈদে সরকারের নিষেধাজ্ঞা বা অনুশাসনকে অবজ্ঞা করে লাখ লাখ মানুষ দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটলো, বেশিরভাগই স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি না মেনে। এর ফলে শহরের ভাইরাস সহজে গ্রামে গেলো। এখন বেপরোয়া বাঙালি তার খেসারত দিচ্ছে। শহরে আসছে বেশিরভাগই গ্রামের রোগী। হাসপাতালে জায়গা নেই, করুণভাবে মৃত্যু হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর। সরকার জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শ উপেক্ষা করে সবাই ঈদুল আজহার ছুটিতে চলাচল করার অনুমতি দিলো। আগে তো তথাকথিত ‘লকডাউন’ সীমাবদ্ধ ছিল শহরে। তাও বেপরোয়া বাঙালি মানবে কেন? তখনও বাঙালি নানা ফন্দি ফিকির বের করে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছে গেলো। মনে করা হয়েছিল সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে হয়তো বেপরোয়া বাঙালিকে দমন করা  যাবে। যে বাঙালি মরিচের গুঁড়া দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিয়েছিল, সেই বাঙালি নিজে দেশের ভাই ব্রাদার সেনাবাহিনীকে ভয় করার কোনও কারণ নেই। আর আমাদের জনগণের বন্ধু পুলিশকে ভয় পাওয়ার কী আছে? প্রশ্ন মাস্ক পরেন নাই কেন ? সোজা উত্তর মাস্ক পরলে দম বন্ধ হয়ে আসে, দয়া করে মাস্ক পরুন, না হলে দম স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বললেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। হায়াত মওত আল্লাহ’র হাতে। বেচারা পুলিশ কর্মকর্তা।  মাসের দশ তারিখ। ম্যাডাম কোথায় যাচ্ছেন? অফিসে আমার বেতন আনতে। অফিস তো বন্ধ। বেতন কে দেবে? বেশ কেতাদুরস্ত স্মার্ট মহিলা। কোনও জবাব নেই। আচ্ছা যান জনগণের বন্ধু পুলিশের জবাব।

গত এক সপ্তাহ ধরে দেশে গড়ে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা দুই শতের ওপর। রবিবার ২২৫ জন মারা গেলো। এটা সরকারি হিসাব। সংক্রমণ ত্রিশ শতাংশের বেশি। পরীক্ষা বেশি হলে তা কয়েকগুণ বেশি হতে পারতো। ভিন্ন চিত্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। একেবারে বাংলাদেশ লাগোয়া। কলকাতাসহ প্রায়  ১৯টি জেলায় মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। রবিবার পুরো রাজ্যে মাত্র আট জনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের দুটি বেশ কর্মঠ মন্ত্রণালয় রয়েছে। জনপ্রশাসন আর স্বাস্থ্য। মাঝে মধ্যে তারা বেশ হাস্যকর পরিপত্র জারি করে। গরুর হাটে এক পরিবারের দু’জনের বেশি যেতে পারবে না। কীভাবে তা নিশ্চিত করা যাবে? লা-জবাব । গরুর ব্যাপারীর মুখে কোনও মাস্ক নেই। কেন নেই ? সোজা উত্তর- মাস্ক একটা ছিল, কোথায় যে পড়ে গেলো। আর মাস্ক পরলে নিজেকেই ‘গরু’ মনে হয়। ভারতে এক কুম্ভমেলা সর্বনাশের অন্যতম কারণ। এই কোরবানি উপলক্ষে শহরে বন্দরে যে গরুর হাট বসেছে তা তো এক একটা মিনি কুম্ভমেলা। সরকার বললো ১৭ তারিখ হতে হাট বসবে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পরপরই তা বসিয়ে দিয়েছে  সপ্তাহ খানেক আগে। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে সাংবাদিকের প্রশ্ন- হাটতো ১৭ তারিখ থেকে বসার কথা। আপনারা এত আগে বসিয়ে দিলেন যে? সোজা উত্তর- আমরা ওপর থেকে অনুমতি নিয়েছি। মনে হলো সরকারের ভেতর আর এক ‘সরকার’।

এই ঈদের পর বাংলাদেশের সম্ভাব্য চিত্র জানার আগে বিশ্বে বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার অবস্থা একটু জেনে নিই। দু’দিন আগে বিবিসি ও অন্যান্য বিশ্ব মিডিয়াতে প্রকাশ হয়েছে। বিবিসি’র ইন্দোনেশিয়া সার্ভিসের সাংবাদিক ভালদিয়া বারাপুতরি লিখেছেন ‘এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া হয়ে উঠেছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের নতুন হটস্পট। গত দেড় বছরের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ২৬ লাখ মানুষ। প্রতিদিনই চল্লিশ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। ..অনেকে মারা গেছেন অক্সিজেন সংকটের কারণে। মৃত্যুর সময় তাদের পাশে কেউ ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেশীরা উদ্ধার কর্মীদের খবর দিয়েছেন আসার জন্য...করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে ইন্দোনেশিয়ায় এখন পর্যন্ত ৬৯ হাজার মানুষ মারা গেছে। এরমধ্যে গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গেছে। ধারণা করা হয় এই সংখ্যা আরও বেশি হবে’। দেশটিতেও গত ঈদের ছুটিতে সরকারের বিধিনিষেধ উপেক্ষিত হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ায় করোনা সংকট মোকাবিলা করার পরিস্থিতি কিছুটা বাংলাদেশের মতো। তবে দেশটিতে এবার কোনও কোরবানির হাট বসছে না। সব অনলাইনে বেচাবিক্রি হচ্ছে। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।  তাহলে এই ঈদের পর বাংলাদেশের অবস্থা কী তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার মতো হবে? সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী রাতের ঘুম হারাম করছেন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য। আর সবকিছুকে বানচাল করার জন্য আর একদল মানুষ তাদের রাতের ঘুম হারাম করছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ সতর্ক না হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আগের ঈদে শহরের মানুষ গ্রামে সঙ্গী করে নিয়ে গিয়েছিল করোনাভাইরাস। এবার তারা এই ভাইরাসের ডেল্টা ধরন গ্রামে রেখে আসবে। আল্লাহ মানুষের মনে শুভবুদ্ধি জাগ্রত করুক। সবাইকে ঈদ মোবারক।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ