X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: করোনা কি বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছে?

মাকসুদুল হক
২৯ আগস্ট ২০২১, ১৫:৫০আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২১, ১৯:৫২
মাকসুদুল হক ‘সত্য বল, সুপথে চল,
ওরে আমার মন’–  ফকির লালন শাহ

১. মনস্তাত্ত্বিক সন্ত্রাসবাদের লেজ গুটিয়ে পলায়ন তত্ত্ব:

১১ আগস্ট ২০২১ বাংলাদেশ সরকার লকডাউন তুলে নেওয়ার আগে উদ্ভূত পরিস্থিতি আমরা লক্ষ করছিলাম যে, দৈনিক মৃত্যু ২৫০-এর ঊর্ধ্বে উঠেছিল; এবং মনে হচ্ছিল একটা স্বাভাবিক ফেনোমেনা হতে চলেছে, হয়তো তা ৩০০ অতিক্রম করে যাবে।

মহামারির এত বাজে অবস্থা আমরা বিগত দিনগুলোতে দেখিনি বিধায় হঠাৎ করেই এই মৃত্যুর মিছিলের মাঝে যখন লকডাউন তুলে দেওয়ার ঘোষণা এলো, জনমনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটলো– ‘এটা একটা সময় হলো?’

সরকারকে তার যথারীতি ‘দায়িত্বহীনতা ও কাণ্ডজ্ঞানের অভাব’ নিয়ে কম সমালোচনা ও গালমন্দ শুনতে হয়নি। তবে অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করলাম ঠিক উল্টোটা ঘটছে।

আজ শেষ দুই  সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে ১০০-এর নিচে কেবল নামেনি, প্রতিদিনকার হাসপাতালে আইসিইউ ও অক্সিজেন সংকট, অসুস্থ রোগীদের আহাজারি, দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে মিডিয়ার চিত্র– তাও কমতে শুরু করেছে। হাসপাতালগুলো এখন মোটামুটি প্রায় সবই খালি। ভ্যাকসিন দেওয়ার সরকারি কর্মসূচি বারবার হোঁচট খাওয়া সত্ত্বেও এখনও চলছে ও বহু দেশ থেকে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সহায়তা পাওয়া গেছে।

অপরদিকে করোনা নিয়ে ফেসবুকে দিবানিশি সুউচ্চ ডেসিবেলের হাউকাউ, কান্নাকাটি ও মৃত্যু আতঙ্ক ইত্যাদি, তাও ক্রমশ অনেক কমে গেছে ও পাশাপাশি মাস্ক পরাসহ অপমানজনক ‘সামাজিক দূরত্বের’ ফতোয়া এখন কদাচিৎ দেখা ও শোনা যায়।

আমাদের আজকের উপস্থাপনার মূল জায়গাটা হলো:

সমগ্র বিশ্বে বিভিন্ন দেশে লকডাউন দেওয়া হয় কেবল করোনাভাইরাস রোধ করার জন্য– অথচ বাংলাদেশে লকডাউন তুলে দেওয়ার পর করোনা ‘পালাতে শুরু করলো’– এ কী করে সম্ভব? এর অর্থ কি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বিশেষজ্ঞ মত, মিডিয়া, রাষ্ট্র, সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ১৭ মাস ভুল করেছে, বা আমাদের ভুল বুঝিয়েছে? নাকি এখনও নিষ্ঠুর মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে?

সমস্যা হচ্ছে, এ অব্দি আমরা কেউ হলফ করে কিছুই বলতে পারছি না। আরেকটা করোনা ঢেউ কি আসন্ন? আসতেও পারে, আবার নাও আসতে পারে। কিন্তু সরকার বা জনগণের উল্লসিত হওয়ার মতো সময় এখনও আসেনি। চলমান যুদ্ধে বলা যেতে পারে এক ধরনের অঘোষিত ‘সিজ ফায়ার’ চলছে।

করোনা পরিস্থিতি থেকে আজকের এই অভাবনীয় উত্তরণের মূল চালিকাশক্তি ছিল বাংলাদেশের জনগণ। তার ৯০ ভাগ হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ মহামারির প্রথম দিনগুলো থেকেই করোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উপহাস করা শুরু করেছিল, যার ট্রাকশন দেরিতে হলেও আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারছি। বস্তুত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সেক্টরের অযাচিত জ্ঞানদাতাগণ যেসব ‘আদেশ’ দিয়েছিল, তার ঠিক বিপরীতটাই যে জনগণ করেছে তা ছিল অভূতপূর্ব ও লক্ষণীয়।

আমাদের তথাকথিত ‘শিক্ষিত সমাজ’ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে যতই ‘মূর্খ’ ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক– মোদ্দা কথা হচ্ছে জনগণের ভেতরে একটি সন্দেহ সব সময় ছিল– করোনা কোনও রোগ বা ভাইরাস নয়।

তার সরল যুক্তি ও বিশ্বাসের জায়গায় করোনা এক বিশাল ‘থাপ্পড়’, কারণ ঘুরেফিরে তাকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে তার দয়াময় প্রদত্ত জীবন, জীবিকা তথা ‘রিজিক’ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে– তার কর্ম সংস্থানের জায়গা ধ্বংস করে তাকে ভিক্ষাবৃত্তিতে ঠেলে দিয়েছে। তাদের  বুঝতে অসুবিধা হয়নি এই দুঃসময়ে, এই দুর্দিনে তাদের সঙ্গে কেউ নেই।

তাই রাষ্ট্র প্রদত্ত আদেশ লঙ্ঘন করা ছিল তার চূড়ান্ত প্রতিবাদ, যার সুফল এখন আমরা সবাই উপভোগ করছি। জাতিগতভাবে আমাদের করোনা আরোপিত বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে তারাই সব চেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, আমরা দূর থেকে শুধু অশুভ চিৎকারই করেছি।

এটা বাংলাদেশের নিজস্ব সমস্যা যেহেতু নয়,  জনগণের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় কোনোভাবে তাকে ভিনদেশিদের ‘সম্ভাব্য সমাধান’ জানতে, মানতে বা বিশ্বাস করতে বাধ্য করে না। তাদের ভাষায় ‘করোনা দাহা শহরের বড়লোকের রুগ, আমগো গরিবের কিসসুই  হইবো না। আমগো আল্লাহ আছে।’

একি কোনও ‘ঐতিহাসিক ঘটনা’ নাকি তা কাকতালীয়ভাবে ঘটেছে?
সে যাই হোক, সময় নিশ্চিত বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে রায় দেবে যে আমরা, হয়তো বা আমাদের অজান্তেই মহামারির সময় এমন কিছু একটা করেছিলাম; যা নিন্দুকেরা যা বলে বলুক, তা ছিল ‘ভয়াবহ সঠিক’?

কেন জানি মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এই করোনাবিরোধী যুদ্ধে তার প্রতিরোধ, প্রতিহত করা, ও সম্ভাব্য ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার প্রাকৃতিক ক্ষমতা ও বাস্তবিক স্ট্র্যাটেজি আগামীতে গবেষণার বিষয় ও উপাদান হতে যাচ্ছে।

২. ‘ভবে মানুষ গুরুর নিষ্ঠা যার’: গুরুগৃহে দু’বছর পর যাত্রা

গেলো ১৫ থেকে ১৯ আগস্ট ২০২১ আমি গুরুগৃহ চুয়াডাঙ্গার, সোনাগারি, হরিনাথপুর মূলত আমার সাধুগুরু দরবেশ হোসেন আলী সাঁই-এর সাধুসঙ্গে গিয়েছিলাম; পাশাপাশি মেহেরপুর আর কুষ্টিয়া ঘুরে এলাম।

যাওয়ার আগে অনেকেই আমাকে সাবধান করেছিল– ‘প্লিজ বি ভেরি কেয়ারফুল, ওটা রেড জোন, ওদিককার অবস্থা খুবই ভয়াবহ’। ভাবলাম দুই ডোজ ভ্যাকসিন তো নেওয়াই আছে– মাস্ক পরা যদি করি এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলেই তো আমি নিরাপদ থাকতে বাধ্য।

অবান্তরতা: যারা নিয়মিত আমার কলাম পড়ছেন তারা ভালোই জানেন, আমি করোনাকে আগাগোড়া খুব বেশি পাত্তা না দিলেও একটা ‘কশাশ অপটিমিজম’ বা পরিণামদর্শী আশাবাদ নিয়েই হ্যান্ডেল করে এসেছি। করোনা যে আদৌ কোনও ভাইরাস বা রোগ– তা আমি বিশ্বাসও করিনি, আবার অবিশ্বাসও করিনি।

যেকোনও ক্রাইসিসে মধ্যমপন্থা অনুসরণ করা যে বুদ্ধিমানের কাজ,সেই ‘বুদ্ধির সাধনা’ করেছি। কারণ, করোনা বিশ্বের সবকিছুর মতোই ‘প্রশ্ন বা সন্দেহ অতীত’ ভাবে ‘অনুসন্ধানমুক্ত’ হতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো অকুতোভয়ে সব সময় করেছি ও আমার চিন্তাগুলো পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করেছি। কারণ, এটাকে আমি আমার দেশপ্রেমিক দায়িত্ব বলে মনে করি।

কোনও পণ্ডিত বিশেষজ্ঞ, কোনও বিদেশি এক্সপার্ট, কোনও আমলা, মন্ত্রী মিনিস্টার, কোন টকশো’র তর্কবাগীশ, কোনও মিডিয়ার সর্দার কোথায় কী বললো,  এসব কোনও কিছুই গায়ে মাখিনি।

বিগত ১৭ মাসে আমি শুধু তাই বিশ্বাস করেছি যা আমি স্বচক্ষে দেখেছি, বুঝেছি ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এর বাইরে সবই মিথ্যা, সবই বানোয়াট, সবকিছুই আমার কাছে দৃঢ়ভাবে পরিত্যাজ্য।

ফিরে আসি যাত্রার গল্পে: কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে মাস্ক পরা করে ঠিকই গেলাম কিন্তু বোকা বোনে গেলাম যে রাত এগারোটাতেই হাজারো যাত্রীর ভিড়ে খুব বেশি হলে দু’একজন লোকের মুখে মাস্ক!

বাস রওনা করার পর আমি মাস্ক খুলে ফেললাম এবং যাত্রা বিরতির জন্য যখন সিরাজগঞ্জ পৌঁছালাম, দেখি আরেক এলাহী কাণ্ড!

অন্তত ৫০টা বাসের যাত্রীদের সমাগম, সবাই ঘোরাফেরা করছে, খাওয়া-দাওয়া করছে অথচ কারও মুখে কোনও মাস্ক নেই। আমি এরপর পকেটে ওই যে মাস্ক ঢুকালাম, সমগ্র জার্নিতে আর তা বের করলাম না।

মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গায় ওই একই চিত্র। সাধুসঙ্গে আগত শত ফকিরানি, ফকির, সাধু, গুরু, বৈষ্ণব, সাধুগুরু কাউকে মাস্ক ব্যবহার করতে দেখলাম না। সামাজিক দূরত্ব নিয়ে কোনও চিন্তা কারও মনে একবারও আসেনি, বরং এই ‘তামাশা’ নিয়ে প্রচুর হাস্যরস সাধুসঙ্গ মুখরিত করে তোলে।

কুষ্টিয়া ও ছেউড়িয়াতে যারা মাস্ক পরেছে, তাদের সঙ্গে আলাপ করে বুঝলাম, করোনার ভয়ে নয়– ‘পুলিশি ঝামেলা’ এড়ানোর জন্য তারা তা ব্যবহার করছে, কিন্তু বিভিন্ন স্থানে টহলরত পুলিশ সদস্যদেরও সবাই যে মাস্ক পরে ছিল, তা বললেও বিশাল ভুল হবে।

তথাপি আমার কৌতূহলী মনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন যখন করলাম:

‘সাধুগণ বলেন দেখি, এযাবৎকালে আমাদের বাউল পরম্পরায় করোনা রোগে ক’জন মারা গেছেন?’

উত্তরটা শুনে সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে গেলাম:

 ‘আমাদের জানা মতে একজনও না!’

৩. আফগানিস্তান: সামরিক যুদ্ধ কি করোনামুক্ত?

বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ কেন্দ্রিক ইদানীংকার কিছু অদ্ভুত তথ্য আমাদের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

আফগানিস্তান প্রসঙ্গে আসা যাক:

উল্লেখ্য ২০২০ থেকেই তালেবান যোদ্ধারা করোনাবিরোধী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ও শক্ত ভ্যাকসিন বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৩ আগস্ট তালেবান পাকতিয়া প্রদেশ দখলে নেওয়ার পর প্রকাশ্যে করোনা ভ্যাকসিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তাতে এ নিয়ে কোথাও উচ্চবাচ্য হয়েছে তেমনটা দেখা যায়নি। বাংলাদেশের মিডিয়া এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকা অবলম্বন করলো ও বাকি সবাই অদ্ভুতভাবে চেপে গেলো।

১৫ আগস্ট তালেবান কাবুল দখলে নেওয়ার পর পুরো বিষয়টা নিয়ে আর কোনও আপডেট নেই– এমনকি তালেবানদের কাছ থেকেও না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার গৎবাঁধা ‘কত মানুষ মারা যাবে’ মার্কা হুঁশিয়ারি বাণী দেওয়াই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলো। তবে কাবুল দখল নেওয়ার পরপর তালেবানরা বেশ কয়েকটা সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করলেও তারা এ বিষয়ে না বাড়তি কিছু জানিয়েছে, না তাদের আন্তর্জাতিক মিডিয়া কোনও প্রশ্ন করেছে।

কাবুল এয়ারপোর্টে, এই লেখা যখন শেষ করছি (২৭ আগস্ট ২০২১) ১,০০,০০০-এর ঊর্ধ্বে মানুষকে মার্কিন, ন্যাটো ও পশ্চিমা সেনারা উদ্ধার করে জার্মানি, বেলজিয়াম, কাতার ও বাহরাইন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছে।

এখানে বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা অতি নগণ্য, ৯৫ ভাগ যাত্রী আফগান যারা মার্কিনি ও পশ্চিমা ঘেঁষা প্রশাসনের অধীনে চাকরি করেছে বা বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছিল। তালেবানের হাতে প্রাণ হারানোর ভয়ে তারা পালাচ্ছে।

ইতোমধ্যে ২৬ আগস্ট ২০২১-এ কাবুল এয়ারপোর্টে পর পর দুটি আত্মঘাতী বোমা হামলা ও গোলাগুলির ঘটনায় ১৩ জন মার্কিন সেনাসহ ১০০ জনের বেশি লোক মারা গেছে ও ১৪০ জন আহত হয়েছে। ইতোমধ্যে আইসিস-খোরাসান নামক জঙ্গি সংগঠন এই হামলা চালিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। পাকিস্তান সৃষ্ট এই জঙ্গিদের বলা হচ্ছে ‘মার্কিন ও তালেবান উভয়ের শত্রু’।

কাবুল এয়ারপোর্টের চিত্র যা আমরা এখন টিভি পর্দায় প্রতিদিন দেখছি তা ভয়াবহ তো বটে, তার চেয়েও বেশি খুবই সঙ্গতিহীনভাবে আশ্চর্যজনক। বিশ্বজুড়ে করোনা যুদ্ধের সব আলামত এখানে অনুপস্থিত ও আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মার্কিনিদের মতো কোভিড-১৯ ভাইরাসও আফগানিস্তান ছেড়ে পলায়নের জন্য ‘মহাব্যস্ত’।

পশ্চিমা শক্তিগুলো হিমশিম খাচ্ছে। কারণ, তালেবান কঠোর অবস্থান নিয়ে বিশ্বকে জানান দিয়েছে যে ৩১ আগস্ট ২০২১ সৈন্য ও সাধারণ নাগরিকদের প্রত্যাহার করার শেষ দিন তারা আর প্রসারিত করবে না। তা না হলে (সূক্ষ্ম হুমকি) ‘ফের যুদ্ধ’। এই মুহূর্তে কাবুল এয়ারপোর্টের গেটের মুখে লাখের ওপরে মানুষ অপেক্ষা করছেন ও প্রতিদিন আরও কয়েক হাজার এসে যোগ দিচ্ছেন।

৪. করোনা ‘সচেতনতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে’ কিছু প্রশ্ন: উত্তর নিষ্প্রয়োজন

‘মানুষের এই গাদাগাদি ভিড়ে ক’জনকে মাস্ক পরতে বা ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখতে দেখেছেন?

‘একইভাবে ক’জন মার্কিনি, ন্যাটো বা অন্যান্য বিদেশি সেনাকে মাস্ক পরতে দেখেছেন?

‘যেসব বিশাল সামরিক বিমানগুলোর ভেতরে মানুষকে সিটসহ মেঝেতে বসিয়ে গরুর পালের মতো  ‘উদ্ধার’ করা হচ্ছে, সেগুলো কি মাস্ক আর সামাজিক দূরত্বের আওতামুক্ত?

‘বিমানের মেঝেতে যাত্রী পরিবহন যে ঝুঁকিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক বিমান চালনা আইনের চরম লঙ্ঘন; তা নিয়ে কেউ কি কোনও প্রশ্ন করেছেন?

‘ট্রানজিটের অন্যতম করোনা সচেতন দেশ, যথা- জার্মানি, বেলজিয়াম, কাতার ও বাহরাইনে যাত্রীদের কোভিড-১৯ টেস্ট করা হয়েছে, বা হচ্ছে, তেমন তথ্য কি কেউ পেয়েছেন?

‘যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর আফগানিস্তানের নাগরিকদের দীর্ঘ কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে বা হচ্ছে, তেমন কোনও খবর কি নজরে এসেছে?

‘শেষমেশ যদি ২ লাখ আফগান নাগরিক উদ্ধার করা হয়, তাতে যদি ১০ হাজার জনও কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে থাকেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ, বাকি চারটা ট্রানজিট দেশে কি পরিমাণ সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে, তা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনও পর্যালোচনা কি আছে?

৫. সাইকোলজিক্যাল টেরোরিজম-এর পশ্চাদপসরণ: ‘সু-সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে ‘কু-সন্ত্রাস’?

আমরা একটা বিষয়ে অন্তত স্পষ্ট হতে পারি যে করোনা মানব জাতির শত্রু যদি হয়েও থাকে- তার বিশেষ কিছু দুর্বলতা আছে, যেমন- সে বৈশিষ্ট্য ও গুণগতভাবে ‘সাইকোলজিক্যাল টেরোরিস্ট’ ছাড়া আর অন্য কিছুই না।

 শুধু এই দুটি বিষয় নিয়ে যদি একটু ভাবা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে তালেবান তথা আফগান জাতি হলো সেই জাতি, যে গেলো ২০ বছরের ঊর্ধ্বে যুদ্ধ করেছে, মৃত্যু যার প্রতিদিনের সঙ্গী, যার প্রায় ৩ লাখ নাগরিক এই যুদ্ধে মারা গেছে এবং নির্বিচারে মার্কিনি বিমান ও ড্রোনের বোমা-ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় নিরীহ মানুষ খুন হয়েছে, সেই জাতিকে কি করোনা মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ আছে?  

না, লাভ নেই। কারণ, যেখানে আফগানিস্তানের ‘দৃশ্য শত্রু’ আজ লেজুড় গুটিয়ে পালাচ্ছে– তার জন্য ‘অদৃশ্য শত্রু’ ওই আরকি ‘অদৃশ্য’– সবই ফালতু, সবই ‘ভুয়া’, সবই কাল্পনিক!

যে জাতিকে শত্রুর নির্মম মিথ্যার ওপরে ভর করে, যুগ যুগ ধরে জুলুম করা হয়েছে, যে জাতি কোনও দিনও বিদেশিদের কাছে মাথানত করেনি, যে জাতির ইতিহাস বলে ‘বিদেশি শত্রুর জন্য আফগানিস্তান সব সময় হয়েছে কবরস্থান’- সেই জাতির যদি বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান বোধটুকু থেকে থাকে, সে কখনোই সেই শত্রুকে ক্ষমা করতে পারে না, করে না।

এমন অবস্থায় করোনার দুটি পথ খোলা, হয় সে নিজেই মারা যাবে বা প্রাণ রক্ষার জন্য পালাবে। সম্ভবত, দ্বিতীয় ঘটনাটাই এখন ঘটছে। কারণ, এই মুহূর্তে পশ্চিমা শক্তিগুলো পৃথিবীতে কাউকে যদি আসলেই ‘ভয়’ পেয়ে থাকে তা হলো তালেবান।

তাদের এই লজ্জাহীন ভয় আমাদের টিভি পর্দায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় ‘লাইভ’ দেখছি। মার্কিনি বাহাদুরি হলিউডের মুভিগুলোতে দারুণ দেখালেও বাস্তব চিত্রের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই, থাকার কথাও না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনও যুদ্ধেই জিততে পারেনি। তার লাগামহীন যুদ্ধের নেশায় প্রতিটা দেশে সে অবর্ণনীয় যুদ্ধ অপরাধ করা সত্ত্বেও তাদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি।

৬. তাহলে বাংলাদেশ বা বাঙালি জাতির কী হবে?

গেলো ১৭ মাসে আমরা যা ভালো বুঝেছি তাতে এখন খুবই পরিষ্কার যে হতদরিদ্র মানুষ, যার দুটো অন্নের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়, তাকেও আফগানদের মতো মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ নেই, দেখালেও তা হবে ‘গবেটে’র কাজ।

এক কারণ হচ্ছে আমাদের ভয়াবহ এক সাংস্কৃতিক সংকট ও অপ্রাচুর্য। গরিবের দুঃখের কথা আমরা সুযোগ পেলেই আওড়াতে থাকি, কিন্তু গরিবের প্রকৃত দুঃখ-দুর্দশা আমরা আসলেই কি উপলব্ধি করি?

আমরা ক’জনই বা বস্তিতে গিয়ে এক রাত থেকেছি, ‘নোংরা পরিবেশে’ বসে তাদের আহার গ্রহণ করেছি, কতটা সময় তাদের দুর্দশায় কাছে থেকে, পাশে থেকে একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি বা সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি? না, করিনি। কারণ, আমরা যাদের ‘গরিব’ বলি তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষই মনে করি না।

তার ওপর রয়েছে আমাদের ইতিহাস। একাত্তরে যে জাতি তার মুক্তির জন্য, তার স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ প্রাণের আত্মাহুতি দিয়েছিল, তাকে স্থূল ‘সচেতনতার’ কথা বলে নয়, মৃত্যুর হুমকি বা ভয় দিয়ে নয়, কেবল ভালোবাসা, সম্মানজনক শ্রম ও অন্ন নিশ্চিত করে, ‘মানুষের সম্মান’ দিয়ে জয় করা সম্ভব।

এখন দেখার অপেক্ষায় থাকলাম নতুন তালেবান সরকার করোনা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত দেয়। যদি ভ্যাকসিন নিষিদ্ধ রাখার বিষয়ে সে অনড় থাকে ও দেখাদেখি বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাকে অনুসরণ করে, তাহলে বিপদ কমবে না, তা নিশ্চিত বেড়ে যাবে।

অস্ত্রের যুদ্ধ না করে যে কত ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের এই করোনার কাল্পনিক ‘শান্তিপূর্ণ যুদ্ধের’ ধান্দা সে অনায়াসে কামাচ্ছে বা কামাবে, তা তারা ও তাদের দেশীয় মধ্যস্থতা ভোগীরা কি অত সহজে ছেড়ে দেবে?

আমরা যেন ভুলে না যাই যে এই তথাকথিত মহামারিতে সমগ্র বিশ্বে ৪০ লাখ মানুষ ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। এই ভয়াল আন্তর্জাতিক ‘মাস্তানি’র যুগে শত্রু তার শেষ ছোবলটা বাংলাদেশকে যেন না মারে, তা দয়ালের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া, আমাদের কি আর কোনও উপায় আছে?
 
লেখক: সঙ্গীতশিল্পী
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ