X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোয় সাধারণ মানুষের ক্ষতি কতটুকু?

আমীন আল রশীদ
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৪৯আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৪৯
আমীন আল রশীদ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমার ফুপা সরকারি চাকরি করতেন। অবসরে যাওয়ার বছর কয়েক আগে তিনি মারা যান। তার কোনও সন্তান নেই। ফলে স্বামীর মৃত্যুর পরে ফুপু অনেকটা অকূলপাথারে পড়েন। চাকরি বা ব্যবসা করার মতো অবস্থা নেই। কারণ, তিনি নিজেও একটা জটিল রোগে আক্রান্ত। দ্রুততম সময়ে পেনশনের টাকাটা পাওয়া যায় এবং সেই টাকা দিয়ে পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। এখন ফুপু ওই টাকা দিয়ে চলছেন। এ রকম সঞ্চয়পত্র-নির্ভর মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠও আছে এবং সঞ্চয়পত্রের মুনাফার নামে রাষ্ট্রের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, সেই আলোচনাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সামগ্রিক বিষয়ের একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ দেওয়ার চেষ্টা করা হবে এই লেখায়। তার আগে দেখা যাক, এই ইস্যুতে সরকার সম্প্রতি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে?  

গত ২১ সেপ্টেম্বর সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানো সংক্রান্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বর্তমানে তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ হলেও সেটি ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কমিয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। যাদের বিনিয়োগ ৩০ লাখ টাকার বেশি, তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ৯ শতাংশ হারে।

অবসরভোগীদের জন্য নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে এত দিন ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যেত। এখন এই সঞ্চয়পত্রে যাদের বিনিয়োগ ১৫ লাখ টাকার বেশি তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে এই হার হবে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় যে পরিবার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি এই সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার বর্তমানে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এখন এই সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার কমিয়ে করা হয়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই হার সাড়ে ৯ শতাংশ। তবে যারা নতুন করে সঞ্চয়পত্র কিনবেন, শুধু তাদের জন্য পরিবর্তিত এই হার কার্যকর হবে।

এখন পরিবার সঞ্চয়পত্রে কর কেটে নেওয়ার পরে প্রতি লাখে পাওয়া যায় ৮৬৪ টাকা। যার ২০ লাখ টাকা আছে তিনি মাসে পান ১৭ হাজার ২৮০ টাকা। কিন্তু নতুন নিয়মে কেউ ১৫ লাখ টাকার বেশি পরিবার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে বা চলমান সঞ্চয়পত্র মেয়াদান্তে পুনঃবিনিয়োগ করলে তিনি কর কেটে নেওয়ার পরে প্রতি লাখে পাবেন ৭৮৭.৫০ টাকা। তার মানে ২০ লাখ টাকায় পাবেন ১৫ হাজার ৭৫০ টাকা। অর্থাৎ বর্তমানে যা পান তার চেয়ে ১৫৩০ টাকা কম। যিনি শুধু এই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপরেই নির্ভরশীল, তার জন্য দেড় হাজার টাকাও কম নয়।

তবে এই মুনাফা কমবে নতুনদের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ এ বছরও যারা ৫ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, আগামী ৫ বছর পর্যন্ত তারা আগের নিয়মেই, অর্থাৎ লাখে ৮৬৪ টাকাই পাবেন। কিন্তু এটার মেয়াদান্তে পুনঃবিনিয়োগ করলে পাবেন ৭৮৭.৫০ টাকা। আবার এখন কেউ যদি ১৫ লাখ টাকার কম মূল্যের সঞ্চয়পত্র কেনেন তাহলে তিনি লাখে ৮৬৪ টাকাই পাবেন। কিন্তু কেউ যদি ১৫ লাখ টাকার বেশি মূল্যের সঞ্চয়পত্র কেনেন, তাহলে লাখে পাবেন ৭৮৭.৫০ টাকা। অর্থাৎ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের মুনাফা কমছে না।

তবে নতুন নিয়মে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন যাদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেশি। এটিও বাস্তবতা যে, সঞ্চয়পত্রে যাদের নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের নামে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা আছে, তারা সাধারণ মানুষ নন। তারা উচ্চমধ্যবিত্ত ও ধনী। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, বরং কম লাভবান হবেন।

সরকার বলছে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দিতে গিয়ে সরকারের সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এতে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদদেরও অনেকে সঞ্চয় কর্মসূচিতে অতিমাত্রায় বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি রোধ করার তাগিদ দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, নতুন সিদ্ধান্তে মধ্যবিত্ত বিশেষ করে অবসরভোগীদের আয় কমে গেলেও দেশের সুষ্ঠু অর্থনীতি বজায় রাখার স্বার্থে মুনাফা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সঞ্চয়পত্রে যারা বিনিয়োগ করেন, সেখানে বিরাট অংশ সাধারণ মানুষ এবং প্রকৃত অর্থেই তারা সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দিয়ে সংসার চালান এটি যেমন ঠিক, তেমনি বিপুল অঙ্কের অবৈধ ও কালো টাকা, অসৎ পথে উপার্জিত টাকা অথবা বৈধ পথে উপার্জিত সচ্ছল ব্যক্তিদের টাকাও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা আছে। তারা কোনও না কোনোভাবে আয়ের উৎস দেখিয়েই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র কেন এই লোকগুলোকে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ দিয়ে মাসে মাসে তাদের মোটা অংকের মুনাফা দেবে? যে লোক ভালো চাকরি   করেন, যার ব্যবসা আছে, যার উপার্জনের আরও একাধিক পথ আছে, রাষ্ট্র কেন তাকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে আরও বেশি পয়সা আয়ের সুযোগ দেবে?

বরং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী এবং যাদের সংসারে উপার্জনকারী নেই; যাদের আয় কম কিন্তু জমিজমা বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করেছেন এবং সেই টাকা ব্যাংকে রাখলে যেহেতু ওই অর্থে কোনও লাভ হয় না, তাই তাদের সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ দিতে হবে। অনেক নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বৈধ পথেই কিছু কিছু টাকা সঞ্চয় করে একটা সময় সেই টাকা কোথাও রেখে মাসে মাসে একটা ফিক্সড আয়ের ব্যবস্থা করতে চান। সেসব মানুষকেও সঞ্চয়পত্রের সুবিধা দিতে হবে। কিন্তু সচ্ছল ও ধনী লোকেরা কেন সঞ্চয়পত্র কিনবেন এবং রাষ্ট্র কেন তাদের সেই সুযোগ দেবে?

অনেক সচ্ছল মানুষও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন বছর শেষে কর সুবিধা পাওয়ার জন্য। কারণ, চাকরিজীবীদের (যেকোনও পেশায়) মধ্যে এটা খুব সাধারণ প্রবণতা যে, আয়ের বিপরীতে তাদের ওপরে যে কর ধার্য হয়, তারা সেটি পুরোপুরি দেন না বা দিতে চান না। অর্থাৎ কোনও না কোনোভাবে সেই টাকা তারা কমাতে চান। সেই কমানোর যেসব আইনি তরিকা আছে, তার অন্যতম এই সঞ্চয়পত্র। অর্থাৎ নির্দিষ্ট অংকের টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা থাকলে কর মওকুফ পাওয়া যায়। এখানে প্রশ্ন অন্য। যেমন মানুষ কেন তার ওপর নির্ধারিত করের পুরো টাকাটা রাষ্ট্রকে দিতে চায় না? কারণ, সে মনে করে তার করের টাকা সঠিক পথে খরচ হচ্ছে না। কারণ, সে মনে করে তার করের টাকা সরকারি কর্মকর্তারা লুটপাট করে নিয়ে যায়। সে মনে করে কর দেওয়ার পরেও রাষ্ট্র থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা ও সুবিধা পাচ্ছে না। কর দেওয়ার পরেও সে সরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিনা হয়রানিতে বা বিনা ঘুষে সেবা পায় না। সুতরাং সে কেন কর দেবে?

যেহেতু কর না দিয়ে তার উপায় নেই, অতএব সে কর কমানোর জন্য নানা ফন্দিফিকির করে। তার মানে মানুষের এই যে করভীতি বা করবিরক্তি—তার পেছনে দায়ী রাষ্ট্রের সামগ্রিক সিস্টেম। এসব জায়গা সংস্কার করতে হবে। না হলে শুধু সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমিয়ে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না।

মানুষ কেন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তার আরেকটি বড় কারণ প্রচলিত ব্যাংকিং সিস্টেমে মুনাফা অনেক কম। কিন্তু যাদের বাড়তি টাকা আছে তারা কী করবেন? কোথায় সঞ্চয় করবেন? রাষ্ট্র চায় মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে অন্য খাতে বিনিয়োগ করুক। কিন্তু সেই জায়গাগুলো কী? শেয়ার বাজার বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ। এটা জুয়ার মতো। সবার পক্ষে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ সম্ভব নয়। দ্বিতীয় উপায় ব্যবসা। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র-মাঝারিসহ যেকোনও ব্যবসা করতে গেলে যে কত ধরনের হয়রানি ও বিপত্তির মধ্যে পড়তে হয়—তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে আন্দাজ করাও সম্ভব নয়। সুতরাং মানুষ কী করবে? বিনা পরিশ্রমে বেশি মুনাফার আশায় ডেসটিনি, ইউনিপে, যুবক এবং সবশেষ এহসান গ্রুপের মতো ফটকা প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে অসংখ্য মানুষ প্রতারিত হয়েছে।

তার মানে একদিকে প্রচলিত ব্যাংকে মুনাফা কম, শেয়ার বাজারে ঝুঁকি, ফটকাবাজ প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য বাদ দিলে বাকি থাকে সঞ্চয়পত্র। ফলে মানুষ সেখানেই যায়। প্রতিবছর বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে যে পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, বছর শেষে তার চেয়ে অনেক বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। তাতে সুদ পরিশোধ বাবদ সরকারের খরচ অনেক বেড়ে যায়—এ কথাও ঠিক। কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠ হলো সঞ্চয়পত্রের সুদ বেশি হওয়ায় ধনীদের একটি বড় অংশ নামে–বেনামে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে রেখেছেন। ফলে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকারের দেওয়া উচ্চ মুনাফার সুবিধা প্রকৃত অর্থে যাদের কাছে যাওয়া উচিত, তার বদলে ধনীদের পকেটে চলে যাচ্ছে।

সুতরাং সঞ্চয়পত্র কারা কিনতে পারবেন, সেটি সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার এবং এখানে শতভাগ স্বচ্ছতা বজায় রেখে যারা প্রকৃতই সঞ্চয়পত্রনির্ভর, তাদের জন্য মুনাফার পরিমাণ বাড়ানো দরকার। প্রতি লাখে তারা যাতে হাজার দেড়েক টাকা পান, সেই ব্যবস্থা করা দরকার। এটা হলে একটা ইনসাফভিত্তিক অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। না হলে আমাদের অর্থনীতিতে যে বিশাল দুষ্টুচক্র ভর করেছে, লুটেরা-অসৎ-অবৈধ পথে উপার্জনকারী এবং বৈধ-অবৈধ উভয় পথে উপার্জনকারী ধনী লোকেরা যেভাবে আমাদের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন, সেটির কোনও পরিবর্তন হবে না। সবাই যাতে সঞ্চয়পত্র কিনতে না পারে এবং যাতে প্রকৃত চাহিদাসম্পন্ন মানুষেরাই এই সুবিধা পান, রাষ্ট্রকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ