X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

সাংবাদিক নির্যাতন কি চলবেই?

এরশাদুল আলম প্রিন্স
০৮ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৫৪আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৫৪
এরশাদুল আলম প্রিন্স গত ১ অক্টোবর বাংলা ট্রিবিউনের ‘নয় মাসে ১৫৪ সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার, ‘ক্রসফায়ার’ ৪৮’- শিরোনামের সংবাদটি অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এড়িয়ে গেছে বলছি এ কারণে যে বর্তমানে সাংবাদিক নির্যাতন বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের রুটিন প্রতিবেদনের সংবাদ-মূল্য থাকলেও পাঠক হৃদয়ে তা আর সাড়া ফেলে না। সাংবাদিক নির্যাতন যেমন রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে তেমনি সাংবাদিক নির্যাতনের সাময়িক প্রতিবেদন তৈরি ও তা প্রকাশ করাও যেন রুটিন কাজ। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রও (আসক) তার রুটিন কাজটিই করেছে। তারা চলতি বছরের প্রথম নয় মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২১) মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা পর্যালোচনা করে সাংবাদিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। দেশি-বিদেশি একাধিক সংস্থা বা সংগঠন এ জাতীয় প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে।

একসময় এসব মানবাধিকার প্রতিবেদন নিয়ে বেশ হইচই পড়ে যেত। গণমাধ্যমে তর্কবিতর্ক হতো। প্রিন্ট অনলাইন মাধ্যমে সপ্তাহজুড়ে কলাম চলতো। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব প্রতিবেদনকে অতিরঞ্জিত ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতেই পছন্দ করতো। আর এখন এসব প্রতিবেদন সহসাই হারিয়ে যায় অসংখ্য ইস্যুর ভিড়ে।

যাহোক, আসক বলছে, গত নয় মাসে ১৫৪ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এক সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাও গেছেন। হামলা-মামলা-হুমকি তো আছেই। এছাড়া আসক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুসহ নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্রও তুলে ধরেছে তাদের প্রতিবেদনে, যা নিয়ে এ কলামের কলেবর বৃদ্ধি না করে শুধু সাংবাদিক নির্যাতন নিয়ে দুয়েকটি কথা বলি।

আসক দেশের ১০টি জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ ও তাদের নিজস্ব সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে, যা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পোর্টাল প্রকাশও করেছে।

সাংবাদিক নির্যাতন এ দেশে নতুন কিছু নয়। বরং বলা যেতে পারে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই এ দেশের সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, গুম হয়েছে, শহীদ হয়েছেন। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, শহীদ সাবের, আবুল বাশার, শিবসাধন চক্রবর্তী, চিশতী শাহ্ হেলালুর রহমান, মুহাম্মদ আখতার, সেলিনা পারভীন- এরা সবাই দেশের জন্য নির্যাতন ভোগ করেছেন, গুম হয়েছেন, নিখোঁজ হয়েছেন, শহীদ হয়েছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর। সাংবাদিক নির্যাতন কি বন্ধ হয়েছে? নাকি নতুন নতুন কায়দায় ও কানুনে (আইনে) তা আজও বহাল আছে?

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ক’জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার কি হিসাব আছে? বিভিন্ন মেয়াদের বিচ্ছিন্ন কিছু হিসাব হয়তো আমাদের হাতে আছে। ২০০১ সাল থেকে ২০১৬- এই ক’বছরে দেশে ২৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। বিএনপির ২০০১-২০০৬ সালের মধ্যেই নিহত হন ১৪ জন সাংবাদিক, আর আহত হন ৫৬১ জন। আর ২০০৭ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে নয় বছরে খুন হন নয় জন সাংবাদিক। আরেক পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। মনে রাখতে হবে, নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ডের এই খতিয়ান কখনোই পূর্ণাঙ্গ নয়। অনেক ঘটনাই রয়ে যায় চোখের আড়ালে।

সময় যতো গড়াচ্ছে নির্যাতনের সংখ্যা ও মাত্রা যেন বেড়েই চলছে। যেকোনও সমাজে অপরাধ ঘটতেই পারে। অপরাধমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র কেতাবেও নেই, বাস্তবে তো অনেক পরের কথা। কিন্তু অপরাধ হলে তার বিচার করতে হবে- এখানেই রাষ্ট্র ও মগের মুল্লুকের মধ্যে পার্থক্য। আমাদের দেশে অপরাধের সংখ্যা যতই হোক না কেন, সবচেয়ে বড় সংকট ন্যায়বিচারের। অপরাধীর শাস্তি হলে, ভিকটিম বা সংক্ষুব্ধরা ন্যায়বিচার পেলে সেখানে অপরাধ হলেও অপরাধীরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। তার বিপরীত হলে অপরাধীরাই সমাজে দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় আর ভিকটিম হয় আরও প্রান্তিক, কোণঠাসা। আর এরকম একজন প্রান্তিক ভিকটিম যদি হন সাংবাদিক তবে ওই ব্যক্তি-সাংবাদিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রে সাংবাদিকতাও হয়ে পড়ে একটি প্রান্তিক পেশা (Marginalized)। এবং দেশের সাংবাদিকতা যেন ক্রমেই সে অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করছে। সাংবাদিকতা এখানে ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।  

সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই সাংবাদিকের কাজ। সে সংবাদে যাদের আঁতে ঘা লাগে তারাই সাংবাদিক নির্যাতন করে। তবে সাংবাদিক নির্যাতনের তালিকায় সাধারণত আমজনতা থাকে না। খুঁটির জোর থাকলেই সাংবাদিক হয়রানি ও নির্যাতন করা যায়। এই খুঁটি হতে পারে রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক ক্ষমতা, হতে পারে রাজনৈতিক প্রভাব, লোকবলের দাপট ইত্যাদি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের দ্বারা সাংবাদিক নির্যাতন যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক খুঁটির জোরই সবচেয় বড় জোর। এছাড়া রাজনৈতিক ঘটনা অথবা কর্মসূচির জেরে অথবা জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও সাংবাদিক নির্যাতন হয়।

রাজনৈতিক কারণে স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। স্থানীয় কিছু সাংবাদিকদের স্থানীয় সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ‘ম্যানেজ’ করেই চলতে হয়, যেটা হয়তো ঢাকার একজন সাংবাদিককে করতে হয় না। মফস্বল সাংবাদিকদের স্থানীয় প্রভাবশালী মহল, সন্ত্রাসী ও বড়ভাইদের সমীহ করে চলতে হয়। জান বাঁচিয়ে মা-বোন-স্ত্রী সংসার নিয়ে এলাকায় থাকতে হলে চারদিকে চোখ কান খোলা রেখে সাংবাদিকতা করতে হয়।  জান বাঁচিয়ে তবেই জবানের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হয় সাংবাদিকদের। তা না হলে সাংবাদিক মুজাক্কিরের (বুরহান) মতো ভাগ্য বরণ করতে হয়। রাজনৈতিক দলের দুই নেতার অনুসারীদের গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে নিহত হয়েছেন বুরহান মুজাক্কির। মামলা মোকদ্দমা হয়েছে। বিচার কি পেয়েছে? বুরহানের পরিবার যদি বিচার পেয়েও থাকে, বুরহানকে কি তারা ফিরে পাবে?

অনেকে জান বাঁচিয়ে সাংবাদিকতা করতে পারলেও গুম অথবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ভয় তাদের তাড়া করে। নিখোঁজ হওয়ার পর ভাগ্য ভালো হলে বাপ-মার কোলে ফিরে আসা যাবে। না হলে সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্নের মতোই হারিয়ে যাবে অজানা কোথাও। এ ভয়ও তো আছে। যাদের ভাগ্য ভালো তারা হয়তো ঢাকার সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের মতো ৫০/৬০ দিনের মাথায় বাড়ি ফিরে আসতে পারেন।

হামলা-মামলা-হয়রানি আগে ছিল খুচরা হিসেবে আর এখন হচ্ছে পাইকারি হারে। গণহারে মামলা হচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। রাজধানী, বিভাগ, জেলা ও থানা পর্যায়ে এখন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে দেদার। ডিজিটাল নিরাপত্তার চাদরে ছেয়ে গেছে পুরো দেশ। এই নিরাপত্তার প্রধান প্রতিপক্ষ সাংবাদিক।

পিছিয়ে নেই দুদকও। তারা এতদিন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ অথবা কোনও না কোনও কারণে মিডিয়ায় ঝড় তোলা ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাবই তলব করতো। গত মাসে তারাও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদকসহ ৪ সংগঠনের ১১ সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাব তলব করেছে। বলা হচ্ছে, আইনের চোখে সবাই সমান। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকরা ‘গুপ্তচরে’র ‘মর্যাদা’ লাভ করেছে। আগের জমানায় সঠিক খবর জানতে গুপ্তচরের পেছনেও গুপ্তচর লাগানো হতো। এখন সাংবাদিকরা হয়েছেন ‘গুপ্তচর’ আর তাদের পেছনে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।  

একসময় সাংবাদিকদের ভয়ভীতি-হুমকি-ধমকি দিয়েই অনেকে ক্ষান্ত হতো। বড় জোর রাতের আঁধারে পেছন থেকে হামলা করতো। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। হামলার চেয়ে মামলার শক্তি বেশি। হামলা করলে উল্টো নিউজ হয়। তার চেয়ে ডিজিটাল আইনে মামলা করলে ওই মামলার ঠেলা সামলাতেই সাংবাদিক দফারফা। একবার মামলা হলে গ্রেফতার-থানা-মুচলেকা-হাজত-হাতকড়া-আদালত-হাজিরা-জামিন-এজাহার-শুনানি-ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব সামলাতে সামলাতে নিউজ করার কথা আর মনেও আসবে না।

শুধু তা-ই নয়। সাংবাদিকদের জন্য বাস্তবতাটা আরও কঠিন। নিউজ করার আগে সবার আগে সর্বশেষ নিউজ চায় অফিস। কিন্তু সে নিউজ করতে গিয়ে মামলা-হামলা হলে অনেক প্রতিষ্ঠানকে পাশে পাওয়া যায় না। সেসব প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ তখন হয়- ‘ভাই আগে জান বাঁচান, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে’। সাংবাদিকতা যে কঠিন, সেই কঠিনেরে ভালোবেসে টিকে থাকা যে আরও কঠিন।  

এসব হামলা-মামলা-নির্যাতন-হত্যা সাংবাদিকতা পেশাকে দিনকে দিন আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের ফোর্থ স্টেট বা চতুর্থ স্তম্ভ। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি যুগের বিশ্ব নাগরিক। গণমাধ্যম কর্মীদের নির্যাতন করে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা যাবে না। তথ্যের অবাধ প্রবাহ না হলে সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও  খর্ব হবে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা-মামলা-নির্যাতন করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার খোয়াবনামা রচনা হতে পারে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কাজেই সাংবাদিক নির্যাতনের বিচার করে সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পক্ষে দাঁড়াতে হবে আমাদের। নির্যাতনকারীদের জন্য কোনও দায়মুক্তি নয়।

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা রয়ে গেছে: নাহিদ ইসলাম
ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা রয়ে গেছে: নাহিদ ইসলাম
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে সাংবিধানিক কমিটি হবে: আব্দুল্লাহ তাহের
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে সাংবিধানিক কমিটি হবে: আব্দুল্লাহ তাহের
দিনের ভোট রাতে হওয়ার কথা স্বীকার করলেন সাবেক সিইসি নূরুল হুদা
দিনের ভোট রাতে হওয়ার কথা স্বীকার করলেন সাবেক সিইসি নূরুল হুদা
বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয় ৪৮ বিলিয়ন ডলার
বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয় ৪৮ বিলিয়ন ডলার
সর্বশেষসর্বাধিক