X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচন কমিশন: বড় হোক সাংবিধানিক ক্যানভাস

এস এম মাসুম বিল্লাহ
১৪ অক্টোবর ২০২১, ২০:০৩আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২১, ২০:০৩

এস এম মাসুম বিল্লাহ  প্রতিবার নির্বাচন আসে আর আমাদের নির্বাচন কীভাবে হবে এই আলাপ বাড়ে। পঞ্চাশ বছর কেটে গেলো। একটা ঘাতসহ নির্বাচন ব্যবস্থা দাঁড়ালো না! এমনকি একটা নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে তা নিয়ে আমাদের বাহাসের শেষ নেই। অনুমান করি এ আলাপ অব্যাহত থাকবে।

নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। একজন থাকেন প্রধান, বাকিরা সদস্য। সাবেক নির্বাচন কমিশনার প্রয়াত বিচারপতি নাঈমুদ্দীন আহমেদকে একবার একটা অনুষ্ঠানে বলতে শুনেছিলাম, বাংলাদেশে ভালো নির্বাচন করার জন্য চার জন সৎ ও দৃঢ়চেতা মানুষই যথেষ্ট।

অতিরঞ্জিত শোনালেও কথাটার স্পন্দন ধরা যায়। আমাদের সংবিধান নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারকে (এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গকে) নির্বাচন কমিশনের খেদমতে পেশ করেছে। যেমন, ১২৬নং অনুচ্ছেদে বলা আছে: ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ সংবিধান থেকে শক্তি নিয়ে প্রশাসনকে হুকুম তামিল করানোর মতো মানুষ দরকার।

সে রকম মানুষ নেই আমাদের? থাকতেও পারে। দরকার খুঁজে বের করা। সার্চ!

৫৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়ে নির্বাচন কমিশন বানানোর একটা লিখিত আইন তৈরি করতে সরকারকে আহ্বান করেছেন। বিবরণে প্রকাশ, তারা আসলে ৫৪ জন। আমি ধরে নিলাম তিপ্পান্ন– ‘যাহা বাহান্ন, তাহা তিপ্পান্ন!’ তবে ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ তকমা খটকার জন্ম দেয়। আমরা সব নাগরিকই তো সমান।

ধরুন, ভিন্ন কোনও গোষ্ঠী বা সংগঠন বিবৃতি দিয়ে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন করতে বললেন। তাহলে কি তাদের কথা গুরুত্ব পাবে না?

রাষ্ট্রপতি (জিল্লুর রহমান ও আব্দুল হামিদ) সার্চ কমিটি করে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে গত দুইবার নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। আওয়ামী লীগ এবারও এই ফর্মুলায় আস্থা রাখতে চায়। প্রধানমন্ত্রী সেটা সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার জানান দিয়েছেন। বিএনপির তরফে কোনও ফর্মুলা জানা যায় না। তত্ত্বাবধায়ক বা সেই গোছের কোনও সরকার না এলে নির্বাচন কমিশন কেমন করে হচ্ছে– এ আলাপ তাদের কাছে এই মুহূর্তে অতটা আগ্রহোদ্দীপক হওয়ার কথা নয়। তবু মনে হচ্ছে তারা ৫৩ নাগরিকের বক্তব্যে সওয়ার হতে চান।
 
বিধিবদ্ধ একটি আইন কেন দরকার? এর প্রথম যুক্তি হলো, এটা একটা সাংবিধানিক আজ্ঞা ও  অভিজ্ঞান। কমিশন গঠন করার ব্যাপারে এবং এর কাজের পরিধি বর্ণনার সময় সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ বেশ কয়েকবার ‘আইনের সাপেক্ষে’ কথাটির দোহাই দিয়েছে। তাই এমন একটি আইন না করার কোনও কারণ নেই। দ্বিতীয় যুক্তি হলো, আইন দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য সদস্যদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা ও কর্মপরিধি ঠিক করা থাকলে একদিকে যেমন ক্ষমতাসীন দল তাদের নিজস্ব পছন্দের মানুষ নিয়োগ দিতে পারবে না, অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনাররাও  তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ থাকবেন।

তৃতীয়ত, একটা বিধিবদ্ধ আইন উপস্থিত প্রয়োজন চালানোর দায় থেকে সরকারকে নিষ্কৃতি দেবে। কমিশন গঠন প্রক্রিয়া একটা স্থায়ী রূপ পেলে, কোনও রাজনৈতিক দলের প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু একটি আইন থাকলেই কি নির্বাচন সমস্যার সমাধান হবে? অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের খুব আশাবাদী করে না।
মার্কিন বিচারপতি হোমসের কথা ধার করে বলা যায়, ‘আইনের জীবন যুক্তির নয়, অভিজ্ঞতার।’

সংবিধান কর্তৃক তাগাদাপ্রাপ্ত অনেক আইন-ই তো আমাদের করার কথা ছিল, আছেও বোধহয় কয়েকটি। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি, কেউ রাখে না। আমাদের রাজনীতির পরিশুদ্ধি ঘটলো কোথায় আর নির্বাচন সমস্যার সমাধান হলো কোথায়? উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন থাকার কথা ছিল, নেই। ‘ন্যায়পাল আইন’ হওয়ার কথা ছিল, হয়নি। নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার আইন আছে, কিন্তু এখানে কসমেটিক ভাষায় ‘ফুলের মতো পবিত্ররাই’ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্বাচনে দাঁড়ায় ও জেতে। তাই আইন হলেই যে সমস্যার সমাধান হবে না তার সপক্ষে শক্ত কিছু যুক্তি উত্থাপন করা যায়।

‘যার হয় না ছয়ে, তার হয় না ষাটে’। পঞ্চাশ বছর চলে গেছে, কারও মনে হয়নি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্যে আলাদা একটা পূর্ণাঙ্গ আইন দরকার। যে কাজ পঞ্চাশ বছরে করতে পারা যায়নি, সে কাজ চার মাসে কেমন করে করা যাবে সেটা একটা প্রশ্ন।

একটু পেছনে যাই। বিএনপি ভাষ্যে দাবি করা হয়, জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ প্রবর্তক। তো নির্বাচন কমিশন আইনের অনুপস্থিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র কীভাবে হয়েছিল তা প্রশ্ন তোলা সমীচীন হবে। সেই প্রশ্ন তো শুধু  বিএনপির কাছে নয়, এ প্রশ্ন সবার কাছেই, বিশেষত নতুন প্রজন্মের মানুষরা করতে চাইবেন।  
এরপর হলো, আইনটি বানাবে কে? বর্তমান বাস্তবতায় কাঙ্ক্ষিত আইনটিকে যদি আলোর মুখ দেখতে হয়, তাহলে তা বানাতে হবে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদকে। সেটা কি বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে? একটা জোরালো মত রয়েছে যে বর্তমান সংসদ প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত। সেই সংসদ মনোলোভা একটা আইন প্রণয়ন করবে, এই ভরসাটা আসলে কোথা থেকে আসে?

সেটা কি এই যে শেখ হাসিনা আর যা কিছুই করুন, এযাবৎ জাতীয় জীবনের নির্বাচন প্রসূত যেসব ভালো কিছু ঘটেছে তার সিংহভাগের প্রবক্তা তিনি? নাকি জনমতের চাপের মুখে ‘দুর্বিনীত’ মানুষ শেখ হাসিনাকে দিয়ে এরকম একটা আইন করিয়ে নেওয়া সম্ভব? তো সেই জনমত সৃষ্টির বাস্তবিক মেধাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রচেষ্টাটি কোথায়?  

যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নিই আওয়ামী লীগের ‘শুভবুদ্ধির’ উদয় হলো, এবং ৫৩  নাগরিক প্রদত্ত খসড়ার ওপর পরিমার্জন করে তারা একটা আইন প্রণয়ন করলো। ধরা যাক, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এই আইনে একটা ধারায় লিখলো, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কোনও যুদ্ধাপরাধী সংগঠন বা ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত কোনও ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন কোনও দলের মতামত গ্রহণ করবেন না।’

তাহলে বিএনপি বা বিবৃতিদাতা বিশিষ্টজনদের অবস্থান কী হবে?

অথবা ধরা যাক, এসবের কিছুই থাকলো না, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কয়েকজন মানুষকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিলো। কিন্তু সেই কমিশনাররা শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক মানেন এবং সম্বোধনে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তাহলে বিএনপির মননে ও সংজ্ঞায় তাঁরা কি যোগ্য কমিশনার হবেন? এর সঙ্গে আমাদের ‘ড্রাফটিং পলিটিক্স’ তো আছেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা বর্ণনায় সামান্য ‘দৈনন্দিন কাজের’ সংজ্ঞা কি আমরা নির্ধারণ করতে পেরেছিলাম?  
একটা আদর্শ আইন দিয়ে ফেব্রুয়ারি ২০২২ নাগাদ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হলেও তা বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, ইতোমধ্যে বিএনপির একটা শক্ত অবস্থান প্রতিভাত হয়েছে যে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল ছাড়া ২০২৩ সালের নির্বাচনে যাবেন না। যদি তা-ই হয়, আলোচনায় আসা নির্বাচন কমিশন আইন তড়িঘড়ি করে করার কোনও মানে হয় না। সেটা নতুন সংকটের জন্ম দেবে।

আইন প্রণয়নে ‘প্রণয়’ ব্যাপারটা লাগে। এতে বোঝা যায়, আইন বানানোর প্রক্রিয়া সময় ভালোবাসা ও মনোনিবেশ দাবি করে। প্রাসঙ্গিকভাবে স্মর্তব্য যে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছেন (আব্দুল মান্নান খান, ২০১১)।
পরবর্তীতে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সেই বাতিলকে আরও সুসংহত করা হয়েছে।

তাই বিকল্প কোনও নির্বাচনকালীন সরকারের চিন্তা করে থাকলে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোকে নতুন কোনও সংবিধানসম্মত ফর্মুলা দিয়ে তা জনপ্রিয় করে তুলতে হবে এবং (সম্ভবত) নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে বা আলোচনা করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গত দশ বছরে এরকম কোনও ফর্মুলা বিএনপি দিতে পারেনি এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে কিছু মন্ত্রণালয় ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত নির্বাচনকালীন সরকারে অংশগ্রহণের একটা সুযোগ বিএনপি গ্রহণ করেনি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন হতে পারে, সার্চ কমিটি ফর্মুলার অবস্থান ও প্রকৃতি কী? উত্তর হচ্ছে, সার্চ কমিটির বর্তমান চর্চার মান একটা বিধিবদ্ধ আইন দিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশনের মান থেকে বেশ কিছু দিক দিয়ে বেশি সৌকর্য ও সৌন্দর্যমণ্ডিত।

এই চর্চা প্রথম শুরু করেন রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, ২০১২ সালে। তিনি প্রথমে ২৪টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনা করেন। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের পরামর্শ মতে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির (বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) নেতৃত্বে তিনি ছয় সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করেন। সার্চ কমিটির গঠনকে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে আইনি রক্ষাকবচ দেওয়া হয়। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ‘নোটিফিকেশন’ও আইনের মর্যাদা পায়। সার্চ কমিটি প্রতি পদের বিপরীতে দুই জন করে কমিশনারের নাম প্রস্তাব করে, এবং রাষ্ট্রপতি এদের মধ্য থেকে চার জনকে সদস্য এবং একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেন।

২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ রাষ্ট্রপতি  জিল্লুরের ফর্মুলা অনুসরণ করে এটাকে একটা সাংবিধানিক রেওয়াজে পরিণত করেন। গতবার থেকে একজন নারী সদস্য যুক্ত হওয়ার বিধান পাকা করা হয়েছে।

টিপ্পনিতে বলে রাখি, সাংবিধানিক আইনবিজ্ঞানের এই জেন্ডার উপলব্ধি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমবার বিএনপি সক্রিয়ভাবে এবং দ্বিতীয়বার নিষ্ক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এক্ষেত্রেও বলা যায়, সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই চর্চা একটা আইনের মর্যাদা পেয়েছে (অর্থাৎ ‘আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনও প্রথা বা রীতি’-দেখুন, অনুচ্ছেদ ১৫২, আইনের সংজ্ঞা)। এই চর্চার সুন্দর দিকগুলো হলো:
 
(১) সংলাপের মাধ্যমে এভাবে কমিশন গঠিত হলে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি হয়। জনগণ খেয়াল করে বিধায়, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ফর্মুলা প্রদান ও কথাবার্তায় সতর্ক হয়। এ প্রক্রিয়ায় সার্চ কমিটিতে ও কমিশনের মনোনয়নে রাজনৈতিক দলগুলো এমন নাম প্রস্তাব করে যে, যাতে তাদের প্রস্তাবিত নামটি শ্রেয়তরভাবে অন্য দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। নাগরিক প্রতিনিধিরা অংশ নেন বিধায়, এখানে অংশীমূলক গণতন্ত্রের চর্চা হয়। যেমন, এটা ভাবতেই কারও ভালো লাগতে পারে যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বা ড. মোহাম্মদ সাদিকের মতো ব্যক্তিত্বরা নাগরিক প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন গঠন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখছেন!

জনগণের ক্ষমতা অনুশীলনের একটি ছোট্ট কিন্তু তাৎপর্যময় উদাহরণ এটা। এভাবে গঠিত কমিশনের সদস্যরা মনে করতে থাকেন যে তারা সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কমিশনার হয়েছেন। সুতরাং, তাদের কাউকে ভয় পাবার কিছু নেই। মূলত রাজনৈতিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ অনুমোদন কোনও পাবলিক-ক্ষমতা অনুশীলনের মূল শক্তি।

(২) সংবিধান অনুসারে [অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩)] রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে বাধ্য। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এই সাংবিধানিক লাউঞ্জটি বড় ক্যানভাসে মেলে ধরেছেন। সংলাপের আবহ থাকায় সার্চ কমিটি প্রক্রিয়া প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার বিধানকে বেশ খানিকটা নিষ্প্রভ করে দেয়। বিধিবদ্ধ আইন প্রক্রিয়ায় সেটা সম্ভব নয়। বিধিবদ্ধ আইন দিয়ে সংবিধানে লেখা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শের বিধান উপেক্ষা করা যায় না।
 
সংলাপপ্রসূত বিষয়ে লিখিত সংবিধানিকতার ওপর অলিখিত সাংবিধানিক প্রজ্ঞার জয় হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অনুশীলন ব্যাপারটা ওই ৪৮(৩)-এর দ্বিতীয় অংশের ওপর জোর আরোপ করে: ‘প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনও পরামর্শদান করিয়াছেন কিনা এবং করিয়া থাকিলে কী পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।’ দলীয় পরিচিতি থাকলেও রাষ্ট্রপতি জিল্লুর এই চর্চাকে ৪৮(৩) প্রভাব-বলয়ের বাইরে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মুনশিয়ানা দিয়ে।
 
(৩) ব্রিটিশ সাংবিধানিক আইনে সাংবিধানিক কনভেনশন বা রেওয়াজ সাংবিধানিক আইনের উৎস। বিচারপতি আব্দুল মতিন তাঁর ‘আনরিটেন কনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ’ (মল্লিক ব্রাদার্স, ২০১৯) বইয়ে দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশ সংবিধানেও কিছু অলিখিত রীতিনীতি আছে, যা সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা পেতে পারে। যেমন, বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের সাথে রাষ্ট্রপতির পরামর্শের রীতি। তেমনি, ইদ্রিসুর রহমান মামলায় (২০১০) সুপ্রিম কোর্ট সাব্যস্ত করেছেন যে সাংবিধানিক রীতিনীতি সাংবিধানিক আইনের সমকক্ষ।

তাই বলা যায়, সংলাপের মাধ্যমে সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা একটা সাংবিধানিক রীতিনীতিতে পরিণত হয়েছে বা হওয়ার মতো পরিপক্ব অবস্থায় রয়েছে। আমরা এ চর্চাকে বাংলাদেশে কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যাবো সেটাই দেখার বিষয়।
 
মার্কিন বিচারপতি ফ্রাঙ্কফার্টার-এর একটা কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি মনে করতেন যে সবকিছুকে আক্ষরিক চোখ দিয়ে দেখা মানে হলো সংবিধানিকতাকে সাংবিধানিক প্রজ্ঞার সমান করে ফেলা। এটা উদারনৈতিকতার পরিপন্থী। দার্শনিক এমানুয়েল  কান্টের কথাও এখানে প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে: “Woe to the political legislator who aims in his Constitution to realize ethical purposes by force, to produce virtuous institution by legal compulsion. For in this way, he will not only effect the very opposite result, but will undermine and endanger his political Constitution as well.”
 
একটা প্রশ্ন জাগতে পারে যে সার্চ কমিটি চর্চা যদি এমন ভালোই হবে তাহলে কাজী রাকিবুদ্দিন আহমেদ বা নুরুল হুদা কমিশন জনমনে এমন খারাপ ভাবমূর্তি তৈরি করলো কেন? এর কারণ খুঁজতে গেলে একটা আলাদা প্রবন্ধ লিখতে হবে।

এখানে শুধু এটুকু বলা যাবে, ২০১৪ বা ২০১৯ সালের নির্বাচনের মান শুধু নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার ব্যর্থতার ওপর দাঁড়িয়ে নেই। এর সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আলাদা সুনির্দিষ্ট দায় রয়েছে। আগেই বলেছি, নির্বাচন কমিশনের শক্তি নির্ভর করে সেটা রাজনৈতিক দলগুলো (বিশেষ করে প্রধান প্রধান) কতটুকু একে নিজস্ব ভেবেছে তার ওপর। নুরুল হুদা কমিশন (২০১৭) গঠন আলোচনায় বিএনপি অংশ নেয়নি (এটা তাদের একান্তই নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত)।
 
আপন না ভেবেও তারা এর অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এর বড় একটা কারণ হলো, তারা অন্তত একজন মাহবুব তালুকদারকে তাদের ভাষায় কমিশনের ‘বিবেক’ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তাছাড়া অতীতে বিএনপি যে মডেলের নির্বাচন কমিশন উপহার দিয়েছে (কে এম সাদেক, আব্দুর রউফ, এমএ আজিজ প্রমুখ), তা থেকে রাকিবুদ্দিন কমিশন বা নুরুল হুদা কমিশন ভালো না হলেও বেশি মন্দ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।

এমএ আজিজ কমিশনের ‘পাগলামি’ এখনও মানুষের মনে ক্ষত হিসেবে রয়ে গেছে। নিকট অতীতে দেখা যায় যে টালমাটাল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কেএম শামসুল হুদা কমিশন শ্রেয়তর ভালো নির্বাচন করেছেন, এর কারণ হলো সব বড় রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিল হুদা কমিশন (২০০৯)।

হুদা কমিশনের সময় রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় ছিল না সত্যি, কিন্তু সেটা ১৩তম সংশোধনী প্রবর্তিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না মোটেও।

তাহলে লিখিত বিধিবদ্ধ আইনে নির্বাচন কমিশন গঠন বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনও ফল বয়ে আনবে না। সার্চ কমিটির মাধ্যমে সেটি হলে তা কিছুটা হলেও ভালো হবে। দীর্ঘ অনুশীলনের পর, একপর্যায়ে এটা লিখিত আইনি রূপ পেতে পারে। তাহলেই সেটা যদি মজবুত হয়!

আনুষঙ্গিক হিসেবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে দুই একটা কথা বলা দরকার। কারণ, বিনম্র রাজনৈতিক সংস্কৃতি (cultural humility) একটা দেশের আইন ব্যবস্থার চেহারা মূর্ত করে তোলে। শুধু সুপ্রিম কোর্ট দিয়ে ‘সাংবিধানিকতাবাদ’ হয় না। মার্কিন অধ্যাপক মার্ক টাশনেট একবার বলেন যে সুপ্রিম কোর্টের (মার্কিন) উঠান থেকে সংবিধানকে লোকচর্চায় আনতে হবে (টাশনেট, ‘টেকিং দ্য কনস্টিটিউশন এওয়ে ফ্রম দ্য কোর্টস, প্রিন্সটন, ১৯৯৯)। প্যাটি স্মিথের একটা পপ গান ব্যাপারটা চমৎকার করে ধরেছে (১৯৮৮):

The People Have the Power
To Redeem the Work of the Fools
Upon the Meek the Graces Shower
It's Decreed--
The People Rule.

একটা রাজনৈতিক সমাজকে সংবিধান পরিচর্যার দায়িত্ব নিতে হয়। একটা সংলাপময় আবহ জারি রাখলে আইনের শাসনের লাভ হয়। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে দেশ পরিচালনাকারীদের মতবিনিময় চর্চা অব্যাহত রাখা উচিত।

অধ্যাপক বিউ ব্রেসলিন তাঁর বইয়ে লেখেন (২০০৯): ‘রাজনৈতিক পরিশুদ্ধতার খোঁজে সংবিধান বানানোর কাজ শুরু হয় সংবিধানের ভাষা ও নাগরিকের মধ্যে রূপক সংলাপের মধ্য দিয়ে।’ সম্ভবত এটাকেই বিখ্যাত আর্জেন্টাইন সংবিধান বিশেষজ্ঞ রবার্তো গার্গারেলা নাম দিয়েছেন ‘ডায়ালজিক কনস্টিটিউশনালিজম’।
যে সংকট আমাদের জাতীয় জীবনকে নিয়মিত বিরতিতে তাড়িত করে, সে সংকট আমাদের জবান (word) ও জগতের (world) মধ্যে গরমিলের। আমাদের রাজনীতিকদের উচিত প্রতিশ্রুতি (word), বাস্তবতা (world) ও জবাবদিহিতার (accountability) মধ্যে সমন্বয় ঘটানো। বৃহৎ আমাদের সাংবিধানিক ক্যানভাস। সেখানে যে  বাধা তা মূলত ক্ষমতা অনুশীলন ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যকার, সরকার ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কের এবং আক্ষরিক ও চেতনাগত  দৃষ্টিভঙ্গির । এই বাধাগুলো আমাদের অতিক্রম করতে হবে।

নেলসন ম্যান্ডেলার একটা কথা দিয়ে শেষ করি। ম্যান্ডেলা বলেন যে, ‘আইনের শক্তি আইন থেকে আসে না, আসে আইন মানার সক্ষমতা থেকে। একটা সংবিধানের মহত্তম প্রভাব লুকিয়ে থাকে এর একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সমাজ প্রতিমূর্ত করে তোলার ক্ষমতা থেকে।’
 
লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
রিয়ালের মধুর প্রতিশোধে গর্বিত আনচেলত্তি 
রিয়ালের মধুর প্রতিশোধে গর্বিত আনচেলত্তি 
টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ, শহরজুড়ে আতঙ্ক
টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ, শহরজুড়ে আতঙ্ক
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৭ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির পূর্বাভাস
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৭ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির পূর্বাভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ