X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘শরণার্থী ব্যবসা’ বন্ধ করে প্রত্যাবাসনে এগিয়ে আসুন

এরশাদুল আলম প্রিন্স
২৯ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৩১আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৩১

এরশাদুল আলম প্রিন্স ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর গণহত্যার শিকার হয়ে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ নিয়ে সব মিলে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় তারা আশ্রয় নিয়েছে।

শরণার্থী একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার অনেক দেশেই শরণার্থী রয়েছে। শরণার্থী গ্রহণকারী দেশ বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে তাদের সুবিধা মতো শরণার্থীদের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় আশ্রয় দিয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে কক্সবাজারে ৮ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। কিন্তু স্থায়ীভাবে ১১ লাখ লোকের আশ্রয়ণ করা কক্সবাজারে সম্ভব নয়। ফলে, শরণার্থীরাও ধীরে ধীরে কক্সবাজারের নির্ধারিত সীমার বাইরে পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সে কারণেই সরকার রোহিঙ্গাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।

৮ লাখ বা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে একই স্থানে রাখার মতো এলাকার ব্যবস্থা করা সহজ কিছু নয়। তাই সরকার কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা এবং সেই অনুযায়ী সেখানে আশ্রয়ণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। প্রাথমিকভাবে সরকার ভাসানচরে নিজস্ব অর্থায়নে এক লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়ণের ব্যবস্থা করে।  এ আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ হয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।

ভাসানচর আলাদা একটি দ্বীপ হলেও এটি বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ভূখণ্ড না। প্রতিদিনই হাতিয়া, সন্দ্বীপ, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম থেকে ভাসানচরে মানুষ আসা যাওয়া করে। এর চেয়েও বিচ্ছিন্ন নিঝুম দ্বীপ, এমনকি দমারচরেও মানুষ বসবাস করেন। এসব দ্বীপের চেয়ে মূল ভূখণ্ডের কাছে হওয়ায় ভাসানচরে যাতায়াতও সহজ। কিন্তু জলবেষ্টিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এখানে জোয়ার-ভাটার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তাই জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে ভাসানচরের সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ। একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। ভাসানচরে তাদের থাকার মতো পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে জাতিসংঘ প্রথম থেকেই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করে আসছিল। সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়টি  জাতিসংঘকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু শুধু জাতিসংঘ নয়, অন্যান্য বিদেশি সংস্থাও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করেছে। জাতিসংঘ বা এসব সংস্থা মূলত তাদের নিজেদের সুবিধার জন্যই ভাসানচরের বিরোধিতা করেছে, রোহিঙ্গাদের স্বার্থে নয়। কিন্তু তারা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার বা অন্যান্য অজুহাতে ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করেছে।

এসব সংস্থার বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার ভাসানচরের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং সেই লক্ষ্যে সেখানে আবাসন প্রকল্প চালু করে। একই সঙ্গে ভাসানচরে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তির জন্যও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এ লক্ষ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিবকে সভাপতি করে জুন মাসে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি জাতিসংঘের বিভিন্ন কমিটি ও সংস্থার কাছে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের ইতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরে। এ কমিটি ১০টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের ভাসানচরে ঘুরিয়ে আনে। তারা সবাই ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সৃষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ফলে, অবশেষে ৯ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর কার্যক্রমে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তির জন্য বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে সমঝোতা হয়। এর মাধ্যমে ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের দেখভালের দায়িত্বও এখন থেকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রমে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তি একটি ইতিবাচক দিক। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলেছে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়বে।

রোহিঙ্গাদের আসল গন্তব্য মিয়ানমার। কিন্তু যতদিন তারা এখানে আছে ততদিন তাদের জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। বিশ্ব সম্প্রদায় সে দায়িত্ব পালনে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এদিকে গ্রহণকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ দিয়ে যতটুকু পেরেছে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের একার পক্ষে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা অনির্দিষ্টকাল বহন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ তার নিজের জনসংখ্যার ভারেই ন্যুব্জ।  

জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টতায় ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসা, শিক্ষা ও জীবিকায়নের ব্যবস্থা করা হবে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম, আইওএম ও জাতিসংঘ সবাই এখন থেকে ভাসানচরে তাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে। আর বাংলাদেশ সরকার এখানে জাতিসংঘ এবং এর সহযোগী সংস্থা ও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনা করবে।

ভাসানচরে মাত্র ১ লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তর করা হবে। বাকি থাকবে আরও ১০ লাখ। সেই সঙ্গে প্রতিদিনই বাড়ছে এই সংখ্যা।

ভাসানচর বা অন্যত্র স্থানান্তর রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। এর একমাত্র সমাধান প্রত্যাবাসন। সে জন্য মিয়ানমারের ওপর বৈশ্বিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক চাপ তো রয়েছেই। ৩০ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লা মাস্টার নিহত হয়। বিষয়টি আমাদের স্থানীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এড়াতে পারে না। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসী বিভিন্ন রোহিঙ্গা গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। ধীরে ধীরে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম একসময় ক্যাম্পের বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা দেখাও গেছে। ভবিষ্যতে এটি স্থানীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল তাদের কাজে লাগিয়ে স্বীয় স্বার্থ হাসিল করবে। শরণার্থী কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এখানে ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

মিয়ানমার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। তারা নিজ দেশের জনগণ রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে, ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে দেশছাড়া করেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বহির্বিশ্বের পক্ষ থেকে তেমন কোনও কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখছি না। উপরন্তু জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশেই স্থায়ীকরণের পক্ষে সাফাই গাইছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকও সে রকম এক প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ সঙ্গত কারণেই বিশ্বব্যাংকের ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। শুধু বিশ্বব্যাংকই না, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থায়ীকরণের জন্য কাজ করছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিও-আইএনজিও। রোহিঙ্গারা এখানে থাকলেই বিদেশি ফান্ড পাওয়া যাবে। ফলে তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশেই স্থায়ীকরণের জন্য বিভিন্নভাবে লবিং করছে। এবং এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে তার বিরোধিতা করছে। এমনকি রোহিঙ্গাদের মধ্যে আন্তকোন্দলসহ বিভিন্ন  অপরাধপ্রবণতা কমাতে কোনও পদক্ষেপ নিলেও এসব এনজিও মানবাধিকারের ধোয়া তুলে সে প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা রোহিঙ্গাদের মাঝে বিভিন্ন দল, উপদল তৈরি করে প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধেও জনমত গঠনের চেষ্টা করছে। এসব স্বার্থান্বেষী মহল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বদলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেয়ে নিজেদের চাকরি ও জীবিকার ধান্দাই তাদের কাছে আসল। তবে দাতাগোষ্ঠীর এ চরিত্র শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর যেখানেই শরণার্থী রয়েছে সেখানেই তারা এ ভূমিকা পালন করে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি।

দেশি-বিদেশি সংস্থার রোহিঙ্গা বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশ। তাদের এই শরণার্থী বাণিজ্যের বিষয়টি বাংলাদেশও উপলব্ধি করতে পেরেছে। সেই উপলব্ধি থেকেই প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ অধিবেশন থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, শরণার্থীদের লালন-পালন করাটাই অনেক বিদেশি সংস্থার জন্য ব্যবসা। রোহিঙ্গারা এখানে থাকলেই তাদের ব্যবসা। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করতে পারলেই ফান্ড। এ ব্যবসার লাগাম টেনে ধরতে হবে।

আশার কথা, অনেক দেশই আজ মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশকেও তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটের সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার, সমাধানও করতে হবে মিয়ানমারকেই। জাতিসংঘ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য এগিয়ে এসেছে। এভাবে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাশেই তারা এগিয়ে আসুক। রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফিরতে সাহায্য করুক। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও অন্যান্য সংস্থাও এ কাজে এগিয়ে আসুক।  

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পহেলা বৈশাখের নির্দেশনা উপেক্ষা উদীচীর: যা বলছে ডিএমপি
পহেলা বৈশাখের নির্দেশনা উপেক্ষা উদীচীর: যা বলছে ডিএমপি
সিডনির গির্জায় ছুরিকাঘাতকে সন্ত্রাসী হামলা ঘোষণা
সিডনির গির্জায় ছুরিকাঘাতকে সন্ত্রাসী হামলা ঘোষণা
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১২ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১২ জনের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ