X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কপ২৬: খাদের কিনারে বিশ্ব, আর দেরির সুযোগ নেই

এরশাদুল আলম প্রিন্স
০৭ নভেম্বর ২০২১, ১০:০০আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২১, ১৫:২৬

এরশাদুল আলম প্রিন্স

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু সম্মেলনে গত ১ নভেম্বর কপ২৬-এর ভাষণে বলেছেন, ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে বাস্তুচ্যুত জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বিশ্বব্যাপী দায়বদ্ধতা ভাগ করে নেওয়াসহ লোকসান ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অবশ্যই সমাধান করতে হবে।’ এবারের সম্মেলনের মূল এজেন্ডাই হলো জলবায়ুর ঝুঁকি হ্রাসে বিশ্বের দায়বদ্ধতা মেনে নেওয়া এবং সেই অনুযায়ী সমাধানের পথরেখা তৈরি করা। সেজন্যই গ্লাসগো সম্মেলনের প্রত্যাশা অনেক, কিন্তু চ্যালেঞ্জ তার চেয়েও বেশি। তবে আগামী দিনের ঝুঁকির বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভাবলে এটি মোকাবিলা করা কঠিন কিছু নয়। প্রশ্নটি অস্তিত্ব বনাম উন্নয়নের।

পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। গত পাঁচ বছর ছিল বিগত ১৫০ বছরের তুলনায় উষ্ণতম সময়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধীরে ধীরে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। এমন অবস্থা চলতে থাকলে একসময় হয় বাসযোগ্য পৃথিবী, না নয় মানুষ– যেকোনও একটি টিকে থাকবে।

উন্নয়ন ও জীবনকে আজ আমরা মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছি। আজকের উন্নয়নের জন্য আগামীর বেঁচে থাকাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছি। অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, দাবানল, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দুর্যোগের পরিমাণ ও মাত্রা দুই-ই বাড়ছে। উন্নয়নই এর পেছনে প্রধানত দায়ী। ফলে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ। আমাদের ভাবতে হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্যসহ আরও নানান ইস্যু নিয়ে। কানাডার দাবদাহ, ইউরোপের বন্যা, জার্মানির বৃষ্টিপাত, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়ামের বন্যা এবং ক্যালিফোর্নিয়া, সাইবেরিয়া ও ইউরোপের দাবানল আমাদের আগামীর অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। সেই ভাবনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৯৯৫ সালে। জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ওই বছর। এবার হচ্ছে ২৬তম সম্মেলন। এমন আয়োজন নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রতিবারই বিশ্বমানব নতুনভাবে আশায় বুক বাঁধে। ২৬ বারের মতো মানুষ আশায় বুক বেঁধেছে। সবাই প্রত্যাশা করছে, যদি পরিবেশ রক্ষায় আরেকটু এগিয়ে যাওয়া যায়। 

জলবায়ু সম্মেলনের ভাষায়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রা দেড় ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখাই এবারের অন্যতম এজেন্ডা বা আশা। কিন্তু এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে পরিবেশবাদীদেরই যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তারপরও আমরা আমভুক্তভোগীরা আশায় আছি– উন্নত রাষ্ট্রগুলো কার্বনের বিনিময়ে উন্নয়নের লাগাম টেনে ধরবে। তাতে উন্নয়নের গতি আপাতত কিছুটা শ্লথ হলেও জীবনের গতি বাড়বে। কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর অনীহাই জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বড় বাধা। এ অনীহা দূর করতে মানে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনতে ১৯৯২ সালে ফ্রেমওয়ার্ক সম্মেলনে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। সহজ কথায় নীতিটি হলো– Common But Differentiated Responsibility। কার্বণ নিঃসরণে রাষ্ট্রগুলোর দায় অনুযায়ী দায়িত্ব নেবে– এটাই এই নীতির মূল কথা।

উন্নত দেশগুলো ৮৬ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে। আর আমাদের মতো দেশগুলো নিঃসরণ করে মাত্র ১৪ শতাংশ। কিন্তু ভুক্তভোগী হই আমরাই বেশি। কাজেই শিল্পোন্নত দেশগুলোই এর বেশিরভাগ দায়ভার বহন করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা সেই দায়ভার নিতে চাইছে না। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, রাশিয়াসহ শিল্পোন্নত দেশগুলোর অসম্মতিই আজ ও আগামীর উষ্ণ এবং অ-বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য দায়ী।

১৯৯২ সালের আরও পাঁচ বছর পর ১৯৯৭ সালে গৃহীত হয় কিয়োটো প্রটোকল। এতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর ওপর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। এক্ষেত্রে ছিল জরিমানার বিধানও। কিন্তু বিশ্ববাসী সেই চুক্তির বাস্তবায়ন দেখেনি। যেখানে আইনি বাধ্যবাধকতা দিয়েই বাধা যাচ্ছে না; আজ প্রটোকল স্বাক্ষর করে কাল তা ফিরিয়ে নেয়, সেখানে কপ-২৬ সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি মিললেও বাস্তবায়নের সন্দেহ থেকেই যায়। অতীতে এমন নজিরও আছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ওই কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু কংগ্রেসের অনুমোদন না পাওয়ায় দেশটি ওই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কাছে জলবায়ু ইস্যুটি এভাবেই বারবার হেরে যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।

যুক্তরাষ্ট্র যদিও ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে ফিরে আসে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে বেরও হয়ে আসেন। এরপর জো বাইডেন আবারও প্যারিস চুক্তিতে সম্মতি দেন। ‍যদিও জলবায়ুর পক্ষে বাইডেন আরেক ধাপ এগিয়ে গেছেন। তিনি জলবায়ু অর্থায়নে বছরে ৫৭০ কোটি ডলার খরচ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমনকি এই বরাদ্দের পরিমাণ দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। এটা আশার কথা। দেখা যাক, বাইডেন তার জলবায়ু প্রতিশ্রুতি কতটুকু রক্ষা করতে পারেন।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কেবল বরাদ্দ দেওয়াই একমাত্র করণীয় নয়; দেশটির অন্যতম করণীয় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস ও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাকে কার্বনমুক্ত করা। কিন্তু এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। কপ২৬-এ যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে কতটুকু এগিয়ে আসে সেটাই দেখার বিষয়।

জলবায়ু লড়াইয়ের আরেক বড় প্লেয়ার চীন। চীনের প্রেসিডেন্ট তো গ্লাসগোতেই আসছেন না। না এলেও কপ২৬-এ চীন শেষমেষ কী বার্তা দেয় সেটিও দেখার। চীন ২০৬০ সালের মধ্যে যে নেট জিরোর কথা বলছে সেই অনুযায়ী তাদের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।

আরেক জলবায়ু পরাশক্তি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রোমের জি-২০ বৈঠকে যোগ দেননি। তিনিও হয়তো চীনের পথেই হাঁটছেন।

সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন– পরিবেশের এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে আমরা এমন জায়গায় পৌঁছাবো, যেখান থেকে আর ফিরে আসার পথ থাকবে না। এভাবে চললে ২১০০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উষ্ণ হতে না দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, জাপানের নেতৃত্বে আগামী দিনে আমরা কোথায় পৌঁছাবো? সেখান থেকে ফিরে আসতে পারব তো? কাজেই নিঃসরণের গতি রোধ করার এখনই সময়, হতে পারে এটাই শেষ সময়।

তবে দায়ভার শুধু উন্নত দেশগুলোর একারই নয়। তাদের ছায়াসঙ্গী আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ভূমিকাও একই। বিশ্বব্যাংক এখনও জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেই যাচ্ছে। শুধু তাই নয়; টোটাল, বিপি, শেল, গাল্প, ইকুইনর, এনি ইত্যাদির মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি বিষয়ক প্রকল্পে শত শত কোটি ডলার লগ্নি করছে। কিন্তু দিনশেষে সব জ্বালা পোহাতে হয় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর। আগুন জ্বালাবে একজন, জ্বলবে আরেকজন। তবে উষ্ণায়ন রোধ না করলে এ আগুনে একদিন সবাইকেই জ্বলতে হবে।

কাজেই উন্নত দেশগুলোকে কয়লাবিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। পরিবহন খাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বিদ্যুৎ বা অন্য কোনও উৎসের দিকে ঝুঁকতে হবে। যেভাবেই হোক সবুজ ধরীত্রিকে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। সেজন্য বৃক্ষরোপণের ওপর জোর দেওয়া চাই। পরিবেশ রক্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমনে উপকূলেও বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ করতে হবে। অভিযোজনেও দিতে হবে সমান গুরুত্ব।

জলবায়ু দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্লাসগো সম্মেলনে চার দফা দাবি পেশ করেছেন। এগুলো আমাদের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বিশ্বকে এসব দফা বিবেচনায় নিতে হবে। জলবায়ু বিষয়ক ন্যায়বিচারের স্বার্থেই এগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখাই কপ২৬-এর বড় চ্যালেঞ্জ। একইসঙ্গে উন্নত দেশগুলো জলবায়ুর দায় মেটাতে ২০২০ সালের মধ্যে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও জরুরি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিশ্বনেতাদের ঐকমত্য দেখার অপেক্ষায় সবার দৃষ্টি এখন গ্লাসগোর দিকে।

জলবায়ু যুদ্ধ মোকাবিলায় জাতিসংঘের নেতৃত্বে কপ একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম মাত্র। জলবায়ু মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন কার্বন নিঃসরণকারীদের সদিচ্ছা। জাতিসংঘের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও কার্যকর করার ক্ষমতা বা এখতিয়ার নেই। সেই এখতিয়ার আছে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর। উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে তাই এগিয়ে আসতে হবে।

জাতিসংঘ মহাসচিবের ভাষায়, ‘জলবায়ুর দিক থেকে আমরা যে খাদের কিনারে পৌঁছে গেছি সেই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। এটি আশার কথা।’ তাই কপ২৬-নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে, আছে প্রত্যাশাও।

এবারের সম্মেলনের সভাপতি অলোক শর্মা এই আয়োজনকে ‘সবচেয়ে আশাপ্রদ’ হিসেবে দেখছেন। তবে তিনি এটাও বলেন, ‘এটাই শেষ সুযোগ। ভালো কিছু আশার শেষ ভরসা।’ বিশ্ববাসীও ভালো কিছুর আশাই করছে।  

জাতিসংঘ মহাসচিব বা অলোক শর্মার মতো আয়োজক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কথাও আশার আলো দেখায়। তিনি বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে আর একমিনিটও দেরি করারও সুযোগ নেই।’

সত্যি, আমাদের হাতে আর এক মিনিটও সময় নেই।

লেখক: আইনজীবী

/এসএএস/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রেলক্রসিংয়ে রিকশায় ট্রেনের ধাক্কা, বাবার মৃত্যু মেয়ে হাসপাতালে
রেলক্রসিংয়ে রিকশায় ট্রেনের ধাক্কা, বাবার মৃত্যু মেয়ে হাসপাতালে
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ