X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ই-পাসপোর্ট: এখনও নাগরিকবান্ধব নয়

আনিস পারভেজ  
০৭ নভেম্বর ২০২১, ১৯:১০আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২১, ১৯:১০
আনিস পারভেজ উল্কাগতিতে এগিয়ে চলছে তথ্যপ্রযুক্তি। ১৯৮০’র দশকে কম্পিউটার নেটওয়ার্কে টেলিফোন লাইন যুক্ত করে সূচনা হয় তথ্যপ্রযুক্তির, ধারাবাহিকতায় দ্রুতই এলো ইন্টারনেট, সামাজিকমাধ্যম এবং এভাবেই পৃথিবীর মানুষের জীবনযাপন বদলে মানুষ এখন বিকশিত হচ্ছে ভিন্নমাত্রায়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রধানতম বিষয় হচ্ছে তথ্য বা ডাটা। দু’ ধরনের ডাটা আছে— জৈবিক ও অজৈবিক। শরীরের বাইরের ডাটা অজৈবিক, যার আদান-প্রদান এবং সংরক্ষণ অনেক পুরনো। বিগত দু’ দশক  জৈবিক বা বায়োমেট্রিক ডাটা সংরক্ষণে অভূতপূর্ব কাজ হয়েছে, এবং এর আশু উন্নয়নে সম্ভবত আমূল বদলে যাচ্ছে মানুষের চেনা এবং অভ্যস্ত পৃথিবী। বায়োমেট্রিক ডাটা উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় উদ্ভাবিত হয়েছে বায়োমেট্রিক বা ই-পাসপোর্ট।

১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় ই-পাসপোর্ট শুরু হলেও বিশ্বব্যাপী বিকাশের সময় লেগেছে দু’ দশক—প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে বিশ্বের ১২০টি দেশে ই-পাসপোর্ট প্রচলিত। ২০২০ থেকে বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে ই-পাসপোর্ট । দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই সর্বপ্রথম ই-পাসপোর্ট চালু করলো। ব্যাপারটা নিশ্চিত শ্লাঘার।  

বাংলাদেশে অন্য অনেক রাষ্ট্রীয় সার্ভিসের মতো পাসপোর্ট পাওয়াও ছিল ভোগান্তির। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ‘কানেকশন’ না থাকলে বা দালাল ছাড়া পাসপোর্ট পেতে ছিল অনেক ঝক্কি-ঝামেলা। ই-পাসপোর্টের প্রবর্তনে ঝক্কি-ঝামেলা কমেছে, এখন আর পাসপোর্ট অফিস ঘিরে রাখে না দালাল।

তবে সম্প্রতি ই-পাসপোর্ট করতে গিয়ে কিছু সিস্টেমজাত সমস্যায় ভুগেছি, যার সংস্কার খুব অসম্ভব নয় যদি আমাদের মনোভাব বদলাতে পারি। প্রযুক্তির আগে মানুষকে বদলাতে হবে, এটাই হলো যেকোনও নতুন প্রযুক্তি বিকাশের পূর্বশর্ত।  

অনলাইনে ফরম পূরণ করতে হয় ই-পাসপোর্টের আবেদনের জন্য। ফরম পূরণের সময়ই লভ্য দিনগুলো থেকে একটি দিন ও সময় বেছে নিতে হয়  পাসপোর্ট অফিসে অ্যাপয়নমেন্টের জন্য। সেই ফরম দেখিয়ে নির্ধারিত পাঁচটি ব্যাংকের কোনও একটিতে টাকা জমা দিয়ে নির্ধারিত দিন ও সময়ে পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে। পাসপোর্ট অফিসে সব নিরীক্ষণের পর বায়োমেট্রিক ডাটা—আঙুলের ছাপ, চেহারা ও রেটিনার ডিজিটাল প্রতিলিপি—নিয়ে একটি রিসিট দেওয়া হয়। পাসপোর্ট তৈরি হলে ই-মেইল বা এসএমএস-এ বার্তা পেলে পাসপোর্ট অফিস থেকে ই-পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হয়।  

পুরো ব্যাপারটা একটা যৌক্তিক কাঠামোয় আনা হলেও মানুষই কাঠামো চালায় বলে ই-পাসপোর্ট নেওয়ার ভোগান্তি কিন্তু কম নয়। আমি তো পদে পদে ভুগেছি।  

অনলাইনে ফরম পূরণ করে আবেদন করার ফলে আপনার যাবতীয় তথ্য পাসপোর্ট অফিসের সার্ভারে জমা হচ্ছে। আপনার অ্যাপয়নমেন্ট হয়তো দু’ মাস পরে। আবেদন করার পর প্রিন্ট নিয়ে দেখলেন আপনার বাবার নামের বানান ভুল হয়েছে, হয়তো এফ আর জায়গায় এস লিখেছেন, যা শুধরাতে হবে। আপনি ভাবলেন এ আবার এমন কী। এডিট করলেই তো হবে। না, সেটি হচ্ছে না। একবার পূরণ করলে সেই ডাটা আপনি ২০০ দিনের আগে বদলাতে পারবেন না। এটাও বিশ্বাস করতে হবে আজকের এত এত এগিয়ে যাওয়া তথ্যপ্রযুক্তির যুগে? যিনি সফটওয়্যার বানিয়েছেন তিনি এডিট করার প্রয়োজন থাকতে পারে তা ভাবেননি। ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যাওয়াও এক বিড়ম্বনা। প্রায়ই পাসপোর্ট অফিসের সার্ভার বিকল থাকে, ব্যাংকের কর্মকর্তা ঘেমে যাচ্ছেন, কিন্তু টাকা জমা নিতে পারছেন না। আমি টাকা জমা দিতে গেলে দু’ ঘণ্টার চেষ্টায় সার্ভারে সংযোগ পাওয়া গেলো। তারপরও সময় লাগছে। কী ব্যাপার? জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ব্যাংকের নারী কর্মকর্তাকে আমার দেওয়া ডাটা আবারও সার্ভারে ম্যানুয়ালি পূরণ করতে হচ্ছে। এটাই নাকি পদ্ধতি। আমিও ডাটা পূরণ করবো, ব্যাংকে যিনি টাকা জমা নেবেন তাঁকেও করতে হবে। তাহলে সার্ভারে ডাটা রাখার মানে কী? মধ্যযুগের বুদ্ধি নিয়ে তথ্যযুগের সিস্টেম তৈরি করতে গেলে এরকমই হয় এবং হচ্ছে।  

পাসপোর্ট অফিসের বিড়ম্বনা আরও জটিল। কিলোমিটার লাইনে দাঁড়িয়ে কচ্ছপ গতিতে এগোচ্ছেন। পাঁচটি স্টেশনের জন্য পাঁচবার লাইন। প্রথম স্টেশনে আনসার চেক করবে প্রয়োজনীয় সব এনেছেন কিনা। দ্বিতীয় স্টেশনে আপনার দেওয়া সংযুক্তি সার্ভারে পূরণকৃত ডাটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়, যা অত্যন্ত জরুরি। যেখান থেকে আবার অন্য লাইনে, যেখানে শুধুই তিন সেকেন্ডের কাজ—আপনার আবেদনপত্রে ‘আবেদনকৃত’ সিল দেওয়া হয়। এবার চতুর্থ স্টেশন, অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর আপনাকে সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হলো, পঞ্চম স্টেশন যেখানে ছবি তোলে এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে বায়োমেট্রিক ডাটা সংগ্রহ করা হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্টেশনের কাজ, অর্থাৎ সিল ও সিরিয়াল নম্বর দেওয়া কিন্তু দ্বিতীয় স্টেশনেই হওয়া সম্ভব। কিন্তু তা না করে আপনাকে জায়গায় জায়গায় লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে, লাইন এগোচ্ছে কচ্ছপ গতিতে। গতি আরও কমে যায় যখন স্টেশন মাস্টার হঠাৎ আধঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিটের জন্য উধাও হয়ে যান। কোথায় যান তিনি? তলপেট ঝাড়তে নাকি চা খেতে?

লাইন থেমে গেলেই তাদের রোবোটিক উত্তর– ‘সার্ভার ডাউন’। আমরা কী শত বছরের পুরনো সার্ভার কিনেছি, যা ঘণ্টায় ঘণ্টায় অজ্ঞান হয় আর সে সুযোগে সার্ভিসদাতারা চা সিঙ্গাড়া খান?  

আমার অ্যাপয়নমেন্ট ছিল সকাল ১০টা ১২-তে, আমি যখন লাইনে দাঁড়াই তখন সকাল ৯টা ২০। সারা দিন পাঁচটি লাইনে থেকে কাজ শেষ করেছি বিকাল ৫ টায়। সব বয়সের নাগরিকই লাইনে দাঁড়িয়ে—ছেলে, বুড়ো সবাই, নারী ও পুরুষ। বসার জায়গা নেই নারীদের জন্য; আছে অল্প কিছু, না থাকার মতোই। করোনাকালে কিলবিল করা লোকের ভিড়ে নিজেকে খুব বিপন্ন মনে হয়। কিন্তু উপায় কী?    

আমি ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট এক্সপ্রেস ডেলিভারির আবেদন করেছি, টাকা জমা দিয়েছি ১০ হাজার ৩৫০। তৃতীয় দিনে মেইল এলো ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট সংগ্রহ করুন। আবারও লাইন, তবে এবার মাত্র দুবার। পাসপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে এসে খুলে দেখি আমাকে ইস্যু করেছে ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট। সঙ্গে সঙ্গে ই-মেইল এলো, আপনি ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। না, আমি তো করিনি, যদিও ৬৪ পৃষ্ঠার জন্য বাড়তি টাকা দিয়েছি। কার কাছে যাবো? কে শুধরে দেবে? পাসপোর্ট অফিসের জনৈক পরিচালককে ফোন করলাম, তিনি উত্তর দিলেন না। এসএমএস করেও সাড়া নেই। আমার অভিযোগ শোনার কেউ নেই।

আমি এবং আমরা কি আসলে নাগরিক? নাকি রাষ্ট্রের কর্মচারীদের অনুকম্পা-ভিখারি?  

যেসব সমস্যার কথা বললাম তার একটিও প্রযুক্তিগত নয়। সমস্যাটা মানুষের এবং তাদের তৈরি সিস্টেমের। একই ডাটা বারবার একই সার্ভারে পূরণ করে দেশকে ডিজিটাইজ করা সম্ভব নয়। তথ্যপ্রযুক্তি আমরা উদ্ভাবন করছি না, উদ্ভাবিত এবং বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তি ব্যবহার করছি মাত্র। যেকোনও প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সবার আগে প্রয়োজন মান্ধাতা আমলের মনমানসিকতা ও মনোভাব পরিবর্তন। আমরা অ্যানালগ মানসিকতায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। তাই দক্ষিণ এশিয়ায় সবার আগে ই-পাসপোর্ট চালু করলেও সুবিধার পুরোটা দিতে পারছি না নাগরিককে।    

প্রযুক্তির থাকে তিনটা জিনিস—যন্ত্র, কৌশল, এবং যন্ত্র ও কৌশল ব্যবহারের দক্ষতা ও মানসিকতা। রাষ্ট্র তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে, তৈরি হয়েছে অধিদফতর, চলছে নানাবিধ প্রকল্প। কিন্তু আমাদের ঘাটতি আছে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় মন, মনোভাব ও সংস্কৃতির। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাগরিকের সার্ভিস পাওয়ার  কোনও অধিকার আছে বলে মনে করেন না। যেটুকু পাচ্ছে তা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দয়া মাত্র। এটা অতীব জরুরি যে প্রজাতন্ত্র, বিশেষ করে এর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা, নাগরিকবান্ধব হয়ে উঠুন।

রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের আছে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি- রাষ্ট্র তার কর্মচারীদের মাধ্যমে নাগরিকের দেখভাল করবে এবং নাগরিক স্বীয় দায়িত্ব পালন করবে রাষ্ট্রকে নাগরিকের দেখভাল করার সক্ষমতা অর্জনের জন্য। শুধু ই-পাসপোর্টই নয়, যেকোনও  প্রযুক্তিই নাগরিককে ভোগাবে যদি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নাগরিককে সম্মান করতে না শেখে। যত দেরি হবে ততই আমরা পৃথিবীর দৌড় থেকে পিছিয়ে পড়বো। উল্কাগতিতে দৌড়াচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি, বদলাচ্ছে বিশ্ব; আমাদের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে কি চলবে?

লেখক: যোগাযোগ ও সিনেমা গবেষক।  
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ