X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুরাদ-কাণ্ডের বার্তা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:০৬আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:০৬

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলে একটা কথা আছে। কিন্তু সেই স্বর্ণযুগেও ভালো আর খারাপ বলে কিছু থাকে এবং তারা হাত ধরাধরি করে হাঁটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বারের মতো বারো বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকাকে আওয়ামী লীগের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। দল লম্বা সময়ের জন্য ক্ষমতায়, তাই দলের নেতাকর্মীদের পাওয়ার শেষ নেই– পদপদবি, অর্থ-বাণিজ্যের নানা সুবিধা, এমনকি মান মর্যাদা। কিন্তু এসবের সঙ্গে দায়িত্বের যে সম্পর্ক আছে, সেটা বুঝতে পারেন না অনেকেই। আরও যেটা পারেন না সেটা হলো একটু সমঝে চলা, সীমা মেনে চলা, ক্ষমতা চর্চা বেশি না করে রাজনৈতিক চর্চা করা। ভালো সময়ের এটাই খারাপ দিক।

টকশোতে প্রশ্ন করা হয়, প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে ডাক্তার মুরাদ হাসানের অপসারণ কী বার্তা দেয়? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর খুব কঠিন। প্রধানমন্ত্রী দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সে জন্য তিনি ধন্যবাদ পাচ্ছেন। ডাক্তার মুরাদের যিনি সিনিয়র সেই তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি আগে যে রকম ছিলেন, গত তিন মাস ধরে একটা পরিবর্তন আমার কাছে মনে হচ্ছিল। বিভিন্ন ঘটনা ও কর্মকাণ্ডে আমরা সেটি মনে হচ্ছিল”। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তিন মাস ধরে পরিবর্তন লক্ষ করা গেলে তার আচরণ সুবিধাজনক মনে না হলে তাকে দল থেকে বা অন্য কোনও চ্যানেল থেকে বার্তা দেওয়া হলো না কেন, সে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। অবশ্য আমরা জানি না, হয়তো ডাক্তার মুরাদকে সতর্কও করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা মেনে চলেননি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বার্তা খুব পরিষ্কার – দলে এবং সরকারে নিম্নরুচির ব্যক্তি, শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীরা থাকতে পারবে না।

ডাক্তার মুরাদ একজন চিকিৎসক, একজন সংসদ সদস্য, একজন প্রতিমন্ত্রী এবং তার এলাকায় তিনি নেতা। কিন্তু তিনি যেন অনেক দিন ধরেই বেসামাল ছিলেন। নিজেকে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভাবছিলেন এবং তিনি হয়তো এটাও ভাবছিলেন যে শক্তিশালী মানেই একজন হবেন কঠিন ও কঠোর, যিনি শৃঙ্খলা, ভদ্রতা, শিষ্টাচারের তোয়াক্কা করবেন না, বরং হয়ে পড়বেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তিনি নিজের মাঝে একজন সর্বাধিনায়ককে খুঁজে পেয়েছিলেন, তিনি নিজে এবং তার অনুগতরা এই ধারণাটায় নানাভাবে ইন্ধনও জুগিয়েছেন।

মুরাদকাণ্ড আমাদের সেই বার্তাটিই দিয়েছে। আমাদের সমাজে নানা স্তরের নেতাদের ভেতর এরকম সর্বশক্তিমান নেতৃত্বের সমস্যা তৈরি হয়েছে। এরকম শক্তিশালী নেতা ছিলেন গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, রাজশাহীর কাটাখালীর মেয়র আব্বাস আলী, যুবলীগের সম্রাট আর এনু-রূপমরা। তারা যা মন চেয়েছে করেছেন এবং সেটা করেছেন নিয়মের বাইরে গিয়ে শক্তি প্রদর্শন করে। ডাক্তার মুরাদও শক্তি প্রদর্শনে তার মুখের ভাষাকে বেছে নিয়েছিলেন।

প্রশ্ন হলো- কীভাবে তৈরি হয় এই অতিরিক্ত শক্তিমান নেতৃত্ব বা কীভাবে নির্মিত হয় এমন ভাবমূর্তি? সেটা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে বড় প্রশ্ন। অনেকেই বলবেন এমপি, মেয়র বা মন্ত্রী হিসেবে তারা দলের ক্ষতি করেছেন। আসলে বলতে হবে তারা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আরও নিচে নামিয়েছেন।

তারা একেকজন স্বাভাবিক জননেতা হিসেবে সার্থক হয়ে উঠতে চাননি। তারা নিজেদের ভাবমূর্তি যেভাবে গড়ে তুলেছিলেন সেটা যত না স্বতঃস্ফূর্ত, তার চেয়ে বেশি বানানো, পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট। আর তার ফলে বাস্তবকে কখনও অনুধাবন করতে পারেননি তারা। বুঝতে পারেননি যে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়তে পারেন যেকোনও সময়। ক্ষমতার সঙ্গে যে দায়িত্বের যোগ থাকে, তার সমন্বয় করতে পারেননি তারা।

সজ্জন, ভদ্রলোকেরা মনোনয়ন পান না, পেলে জিততে পারেন না এবং জিতলে কাজ করতে পারেন না। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন নেতৃত্বের স্বতঃস্ফূর্ততা নেই, পুরোটাই আরোপিত। এমন ব্যক্তিকেন্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। তাদের কোথাও কোনও জবাবদিহি নেই, তাদের কেউ প্রশ্ন করতে পারেন না, এমনকি দলের কর্মীরাও নয়। তারা শুধু চান আনুগত্য, চান কুর্নিশ।

মানুষের মনে নেতার মূর্তি গড়ে উঠবে একটা স্বাভাবিক, ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায়, তবেই সেটা যথার্থ হবে। দল অনেক দিন ধরে ক্ষমতায় থাকায়, ক্ষমতা একচ্ছত্র বা নিরঙ্কুশ হওয়ায় সেই নেতৃত্ব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার তুলনায় বেশি প্রকট হয়ে উঠছে পেশির প্রদর্শনী। শক্তিশালী নেতৃত্ব ও শক্তিশালী রাজনীতির সংগঠন করতে গিয়ে অনেক নেতার আচরণে বারবার প্রতিভাত হচ্ছে এক ধরনের অহংকার, এক ধরনের দুঃশাসন।  

এসব নেতারা প্রথমেই মানুষকে বলে দেন যে, ‘আমি জানি কীসে আপনাদের ভালো হবে, তাই আমার কথাই শুনতে হবে’। এবং এই সুর কিন্তু ভালোবাসার নয়, শাসনের, ধমকের।  এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি শেখায় ‘তুমি অহংকারী হও, সবাইকে ধমকে নিয়ন্ত্রণ করো, তাহলে এ পৃথিবী তোমার অনুগত থাকবে। যদি তুমি নিরহঙ্কার বিনয়ী হও, তা হলে তুমি সফল হবে না’।

গোটা পৃথিবী এখন এক ভার্চুয়াল রিয়ালিটির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। নেতারা এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে যেমন পরিচিতি পান, সেই প্ল্যাটফর্মেই অডিও আর ভিডিও ভাইরালে হঠাৎ পতিত হন। এই জমানায় অর্জন যেমন সহজ, বিসর্জনও দূরে নয়। তাই প্রত্যেকের নিজের দিকে তাকানো দরকার, দরকার আত্মসংযম। কারণ, সংযত না হলে আত্মরক্ষা করা যায় না। এক স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত, অকৃত্রিম নেতৃত্বের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রত্যাশায় আমরা সবাই।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ