X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র বিলাস বিড়ম্বনা

আনিস আলমগীর
২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪:১২আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৩৭

আনিস আলমগীর ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে আমি শিক্ষা সফরের অংশ হিসেবে কেরালার কোভালাম সমুদ্র সৈকত দেখতে যাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট থেকে আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম তখন। পুরো এক মাস দক্ষিণ ভারতে কাটিয়েছিলাম। সে সময় মাদ্রাজ সমুদ্র সৈকত, কন্যাকুমারি এবং কোভালাম সমুদ্র সৈকত দেখা হয়েছিল। এর পরে নানা দেশে সৈকত দেখলেও তার আগে সমুদ্র দেখা বলতে শুধু কক্সবাজার সৈকত দেখা হয়েছিল দুইবার। কিন্তু কোভালামের রূপ এবং ব্যবস্থাপনা দেখে আমি এত মুগ্ধ হয়েছিলাম যে সেখানে আমাদের সপ্তাহ খানেক থাকাকে কম মনে হয়েছে।

এই মুগ্ধতা সেখানে থেমে থাকেনি। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি তখন দৈনিক আজকের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার ছিলাম। ঢাকা এসেই লিখলাম, ‘কক্সবাজার হতে পারতো কেরালার কোভালাম’। এখন দেখছি তিন দশক আগে কক্সবাজারকে নিয়ে যে আফসোস করেছিলাম সেটা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। কক্সবাজার এখনও কেরালার কোভালাম হতে পারেনি। হয়েছে একটা কনক্রিটের বস্তি, যেখানে নিরাপত্তা নেই, পর্যটকদের পকেট কাটায় মরিয়া সবাই। বাজেট ঠিক রাখা যায় না।

কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তার কমতি নেই। কোভালামের সাদা ঢেউ, নীল জল, মাতাল বাতাস আর সারি সারি নারিকেল গাছের অরণ্য, দূরের-কাছের পাহাড় কোভালাম সমুদ্র সৈকতকেও অপরূপ করেছে। সমুদ্রে একদল লোক সার্ফ করছে। অনেক দূরে জেলেরা মাছ শিকার করছে। কেউ সমুদ্রস্নানে নেমেছে। অদ্ভুত এক মাদকতা পেয়ে বসে একা একা থাকলে। কেরালাতে পর্যটক হিসেবে যা বাড়তি পেয়েছি সেটা কক্সবাজার এখনও দিতে পারছে না কাউকে। বিশেষ করে দুটি বিষয় আমার এখনও মাথায় আছে– সমুদ্রস্নানে নেমে একটু দূরে গভীর জলে যেতে দেখলেই তীরে বসা ওয়াচম্যানরা হুইসেল বাজিয়ে সতর্ক করতো, এমনকি পানিতে নেমে তুলে নিয়ে আসে। কক্সবাজারের সৈকত অনেক দূর ঢালু হয়ে সমুদ্রে নেমেছে কিন্তু কোভালামে ঢালুটা অনেক দীর্ঘ না, তবে সাঁতারের জন্য সে ঢালুটাও পর্যাপ্ত।

দ্বিতীয় যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা হচ্ছে রাত ১২টায়ও আপনি প্রিয়জনকে নিয়ে সমুদ্র তীরে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে পারবেন, কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না। নিরাপত্তার ঝুঁকি নেই। কোভালামে আপনি পানিতে নামলে একদল উল্লুকরূপী মানুষ আপনাকে চোখ দিয়ে গিলে খাবে না- পরনে আপনার যতই স্বল্প বসন থাকুক। কিন্তু কক্সবাজার এর ব্যতিক্রম। এখানে সমুদ্রস্নানে গিয়ে যেমন বোরকার ছড়াছড়ি রয়েছে তেমনি বোরকাপ্রিয় না হলেও নারীরা প্রায় বোরকাসম কাপড় পরে সমুদ্রে নামতে বাধ্য হয়। যতজন গোসল করতে নামে তার ১০ গুণ অন্যের গোসল করা দেখে আনন্দ পায়। এমনকি ভিডিও করে। ২০০৩ সালে আমি একবার কক্সবাজারে সমুদ্রে নেমেছিলাম। এর ২ বছর পর ঢাকায় দেখা হলে একজন আমাকে জানান, সেখানে প্রিয়জনের সঙ্গে আমার সমুদ্রস্নানের ভিডিও করেছেন তিনি। অথচ তখন তিনি ছিলেন আমার অপরিচিত। তিনিও সেখানে গিয়েছিলেন পর্যটক হিসেবে।

তাই আমার চোখে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের প্রধান ইস্যু মনে হয় কালচারাল সমস্যা। সেখানে আমার মতো সাধারণ মানুষের শর্টস পরে গোসলের ভিডিও ধারণ করে রাখার শখ অন্যের, বিকিনি পরা বিদেশিনীর কী হাল তাহলে কল্পনা করুন। সেখানে অগণিত বেগানা চোখ অন্যের প্রাইভেসিকে তছনছ করে দিচ্ছে। সেখানে সমুদ্র তীরে যখন ইচ্ছা নির্জনে বসে কথা বলার পরিবেশ নেই। নিরাপত্তা নেই। প্রিয়জনের হাতে হাত রাখার, একান্তে চুমু খাওয়ার পরিবেশ নেই। বাণিজ্যিক ছাতা ছাড়া বসার জায়গা নেই। বিদেশিনীদের ধর্ষণের চেষ্টা হয় সমুদ্র সৈকতে।

অতি সম্প্রতি এক মহিলাকে কক্সবাজারের হোটেলে গণধর্ষণ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সোচ্চার। এর আগেও ২০১৯ সালে এক অস্ট্রেলিয়ান তরুণী ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। এবার বাংলাদেশি এক নারীকে অপহরণের পর একটি হোটেলে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২২ ডিসেম্বর ২০২১ দিবাগত রাত দুইটার দিকে ঘটনার শিকার নারীকে একটি গেস্ট হাউজ থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাব। পরে তিনি চার জনের নাম উল্লেখ করে মোট সাত জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজার থানায় মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামি সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির মামলায় অতীতে সাজাপ্রাপ্ত কক্সবাজারের আশিকুল ইসলামকে ২৬ ডিসেম্বর রাতে মাদারীপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

খবরে দেখলাম কক্সবাজারে নারীদের জন্য আলাদা একটি সংরক্ষিত এলাকা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। তারা বলছে, ‘কক্সবাজারে আসা শুধু নারী পর্যটকদের জন্য আলাদাভাবে কার্যক্রম চলছে। যারা নারী পর্যটক বা পর্দানশীন নারী যারা রয়েছেন, তাদের জন্য ১০০ বা ১৫০ গজের একটা সংরক্ষিত এলাকা থাকবে। যারা ইচ্ছুক হবেন বা স্বেচ্ছায় চাইবেন, তারা সেখানে গিয়ে পানিতে নামতে পারবেন। খুব তাড়াতাড়ি সেটি চালু করা হবে।

২২ ডিসেম্বরের ঘটনায় কেউ কেউ কক্সবাজারকে বয়কট করার ডাক দিচ্ছেন। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, কক্সবাজারের মানুষের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বয়কটে তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ, পর্যটকের জন্য সেখানে উচ্চ মূল্যের ধকল তাদেরও সইতে হয়। অথচ কক্সবাজারে যারা বিজনেস করে তারা সিংহভাগ বাইরের। ফেরিওয়ালা, হেলপার, ফটোগ্রাফার অথবা অন্যান্য যারা আছে তাদের ৯০% রোহিঙ্গা অথবা বাইরের অঞ্চলের। সে কারণে তারা চায় ট্যুরিজমের নামে কক্সবাজারকে যে নৈরাজ্যের শহর বানানো হয়েছে তা থেকে সেটিকে মুক্তি দিয়ে নৈসর্গের শহর হিসেবে রাখা হোক।

অবশ্য এমনটা সবাই ভাবেন বলা যাবে না। এই ভরা মৌসুমে ধর্ষণ শিরোনাম হওয়ায় ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে। কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার এই প্রসঙ্গে একটি গণমাধ্যমে বলেন, এর আগে ৮ জানুয়ারি এক অভিযানে ৫৪ জন নারীকে খদ্দেরসহ গ্রেফতার করা হয়েছিল। এভাবে প্রায় ধরা পড়ে কিছু নারী-পুরুষ। তবে ২২ ডিসেম্বরের ঘটনায় ভিকটিমকে পর্যটক আখ্যা দিয়ে প্রচারণা আমাদের কক্সবাজারের ঐতিহ্যের চরম ক্ষতি করেছে। এরপরও অভিযোগ ওঠা বিষয়ের সঠিক বিচার কাম্য আমাদের।

কক্সবাজারে যে নারী ধর্ষিত হয়েছেন তিনি পর্যটক নয় এটা মিডিয়ার রিপোর্ট থেকে অনেকটা পরিষ্কার। কিন্তু কথিত 'পতিতা' হলেই কাউকে গণধর্ষণ করা যাবে এটা কোনও যুক্তির কথা হতে পারে না। পুলিশ শুরু থেকে গা এড়ানোর জন্য ওই নারীর চরিত্রকে বড় করে সামনে আনছে। পর্যটন শহরে একজন নারী অপহৃত হচ্ছে, এটা পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা না জানাটা দায়িত্বে অবহেলার শামিল। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতরা সৈকত এলাকার বাজার থেকে মানুষের সামনে দিয়ে একজন নারীকে ধরে নিয়ে গেলো- এটা কী করে হয়! অন্যরা কেন তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলো না- সেই প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে।

কক্সবাজার বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র, তাকে ঘিরে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। দেশে মানুষের ঘোরার জায়গা নেই। আমোদ প্রমোদের জায়গা নেই। যাদের অতিরিক্ত টাকা আছে তারা যাচ্ছে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা ইউরোপে। কিন্তু করোনার কারণে বিদেশ যাওয়া এখন অনেক রিস্ক এবং হয়রানিরও। আমাদের কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত আছে কিন্তু সেখানে পর্যটক যাতায়াত, পরিবেশ, থাকা-খাওয়া, অবকাঠামো তেমন গড়ে ওঠেনি। উপভোগেরও কিছু নেই। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত একবেলার বেশি উপভোগ করা যায় না, সেন্ট মার্টিনে যাওয়া খুব সহজ নয় এবং পরিবেশ দূষণের কারণে সব সময় যাওয়াতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বেড়ানোর জন্য কক্সবাজার বা পার্বত্য জেলায় না গিয়ে দেশি পর্যটকরা যাবে কোথায়? সমুদ্র বিলাস নিরাপদ করা শুধু পর্যটকদের সুবিধার জন্য নয়, দেশের ইমেজ বৃদ্ধির জন্যও জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ