X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোন পথে নাসিক নির্বাচন?

এরশাদুল আলম প্রিন্স
১৫ জানুয়ারি ২০২২, ১৯:৩০আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ২১:৩৮

এরশাদুল আলম প্রিন্স নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন হয় ২০১১ সালে। তখন থেকে এই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন (নাসিক) নজর কাড়ছে দেশবাসীর। এর মূল কারণ এখানকার প্রার্থী ও নির্বাচনে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা। নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন দলের স্থানীয় নেতারা জাতীয় নেতা না হলেও জাতীয় রাজনীতিতে তারা সবসময়ই আলোচিত।

২০১১ সাল থেকে নাসিকের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। এর আগে ২০০৩ সাল থেকে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তার বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা স্বাধীনতার পর থেকে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই অনেকে মনে করেন, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি তথা স্থানীয় সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান দাবিদার ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী।

আইভীর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকার হাত ধরে রাজনীতি শুরু করেছিলেন তৈমুর আলম খন্দকার। একসময় পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে চুনকার বিরোধ শুরু হয়। তখন তৈমুরের সঙ্গে চুনকার সখ্য গড়ে ওঠে। সেই সুবাদে তৈমুরকে চাচা বলে সম্বোধন ও সম্মান করেন আইভী। আইন পেশায় সম্পৃক্ত হওয়ার পর তৈমুর ১৯৯৬ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে লড়তে চাইলে শামীম ওসমানের বিরোধিতার মুখে রণে ভঙ্গ দেন। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০১১ সালে আইভীর বিপরীতে তৈমুর প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু বিধি বাম‍!‍ ভোটের আগের রাতে দলের নির্দেশে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন।

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা শামীম ওসমান। তার দাদা এম ওসমান আলী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আর বাবা একেএম শামসুজ্জোহা দেশের প্রথম সংসদের সদস্য। তিনি নিজে ১৯৯৬ সাল থেকে সংসদ সদস্য।

মূল কথা, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে এই তিন জনই ফ্যাক্টর। সেটা ভোটের হোক বা মাঠের। তাছাড়া নির্বাচনে তারা প্রার্থী হন বা না হন, নির্বাচনে তারাই প্রভাব বিস্তার করেন।

আসন্ন নাসিক নির্বাচনেও তিন জনই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বিএনপির দলীয় প্রার্থী ছিলেন তৈমুর। কিন্তু দল তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তিনি এখন আর দলীয় প্রার্থী নন। কিন্তু ভোটের মাঠে আছেন। এর আগে ২০১১ সালে দল তাকে বসিয়ে দিয়েছিল। এবারও দল একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু দল এবার তাকে প্রত্যাহার করলেও (চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলার আহ্ববায়কের পদও হারিয়েছেন) তিনি নিজেকে নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করেননি। নির্বাচনের মাঠে আরও উদ্যম নিয়ে হাজির হয়েছেন তৈমুর। বিএনপি তাকে প্রত্যাহার করলেও যেহেতু তিনি ভোটের মাঠে আছেন, তাই বিএনপির প্রার্থীরা তাকে প্রত্যাহার করেননি। দলের স্থানীয় নেতৃত্ব ও সমর্থকরা সরাসরি তার পেছনে না থাকলেও তাদের ছায়া সমর্থন ঠিকই আছে, যার প্রভাব হয়তো দেখা যাবে ভোটের ফলে।

আইভী এবারও আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী। ২০১৬ সালেও তিনি দলের সমর্থন পেয়েছেন। যদিও প্রথম নির্বাচনে (২০১১ সালে) দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। কিন্তু জয়ী হওয়ার পর তিনি শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে দোয়া নিয়েছেন, শপথও নিয়েছেন। পদের শপথের সঙ্গে হয়তো দলীয় আনুগত্যের শপথও নিয়েছেন। কারণ, এরপরের সব নির্বাচনেই তিনি দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। আর আলী আহাম্মদ চুনকা তো আওয়ামী লীগের ঘরেরই লোক। শেখ হাসিনা তা ভুলবেন কেন! আইভীকে তাই তিনি কাছে টেনে নিয়েছেন। ফলে, ২০১৬ সালের মতো এবারও তিনি দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। কেন্দ্র থেকে লোক পাঠিয়ে শামীমকে আইভীর পক্ষে কাজ করার আদেশ জারি করা হয়েছে। আর শামীমও পরদিন সাংবাদিক ডেকে আইভীর পক্ষে বা বিপক্ষে বড় কথা নয়, নৌকার পক্ষে কাজ করার ওয়াদা করেছেন।  

আইভীকে নিয়ে কেন্দ্র ও দলের মধ্যে সবসময়ই টানাপড়েন ছিল। আইভী কখনোই তৃণমূলের পুরোপুরি সমর্থন পাননি বলে তার অভিযোগ। এটি ভিত্তিহীন নয়। এর কারণও খুব পরিষ্কার। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনকেন্দ্রিক আওয়ামী রাজনীতি দুটি ধারায় বিভক্ত। একটি ধারা শামীম ওসমান কেন্দ্রিক, অন্যটি আইভী কেন্দ্রিক। আইভী সবসময়ই সিটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, কিন্তু তিনি কখনোই দলের আরেক ধারা শামীম ওসমানের একনিষ্ঠ সমর্থন পাননি বলে মনে করেন। কিন্তু তারপরও আইভী পরপর দুটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।

২০১১ সালে শামীম নিজেই প্রার্থী ছিলেন। আর ২০১৬ সালে আইভীকে সমর্থন দিয়েছেন বলে শামীম দাবি করেন। এবারও যদি শামীম সেই সমর্থন অব্যাহত রাখেন তাহলে আইভী হয়তো এবারও জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার আরও কাছে যাবেন, আরও আস্থাভাজন হবেন। আইভী ১২ বছর ধরেই অপরাজিত, তিনি মেয়র। আর শামীম ওসমান সংসদ সদস্য।

তবে রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই, ভোটের মাঠে একথা আরও সত্যি। আমরা জানি, স্থানীয় নির্বাচনের ভোটে জাতীয় মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এর আগেও সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলে প্রায় সব সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু আইভী এখানেও ব্যতিক্রম। ২০১১ সালে তিনি সরকারসমর্থিত না হলেও ২০১৬ সালে তিনি সরকার সমর্থিতই ছিলেন এবং জয়ীও হয়েছেন। শামীমের ভোট ছাড়াই আইভী ২০১১ সালেও জয়ী হয়েছিলেন, যদিও বলা হয়– ওইবার তৈমুরের ভোট পড়েছিল আইভীর বাক্সে। তখন শামীম ওসমানের চেয়ে আইভী ১ লাখ ১ হাজার ৩৪৩ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে বিএনপির ভোট না পেয়েও তিনি প্রায় ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন।

২০১১ সালে আইভীর জয়ের পেছনে কারণ আওয়ামী লীগবিরোধী, শামীমবিরোধী ও বিএনপির ভোট তার বাক্সে পড়েছিল। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ বলতে যারা শুধু শামীমকেই বোঝেন, তারাই ওইবার শামীমকে ভোট দিয়েছেন। শামীম পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ভোট। ভোটের আগের রাতে তৈমুরের রণে ভঙ্গ দেওয়ায় বিএনপির সব ভোটারও আইভীর নৌকায় উঠেছিল। ফ্লোটিং ভোটাররাও আইভীকেই সমর্থন দিয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে ১ লাখেরও বেশি ভোটে আইভী জয়ী হন।

২০১৬ সালে শামীম প্রার্থী ছিলেন না। সেই নির্বাচনে বিএনপির শাখাওয়াত হোসেনের চেয়ে প্রায় ৮০ হাজার ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন আইভী। শাখাওয়াতের চেয়ে তৈমুরকে বেশি শক্তিশালী মনে করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এবার আইভীর ভোট কমেও যেতে পারে। যদিও নৌকার জন্য শামীমের শক্ত সমর্থন আইভীর পক্ষে ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করবে।

যদি ধরে নিই– ২০১৬ সালে শামীমের ভোট পাননি আইভী, তাহলে এবারও সেই ভোট ছাড়াই আইভীরই জয়ী হওয়ার কথা। তবে, শাখাওয়াতের চেয়ে তৈমুর বেশি জনপ্রিয় হওয়ায় ভোটের ব্যবধান কিছু কমতে পারে। কিন্তু ২০১৬ সালে শামীমের ভোট ছাড়াই যদি আইভী ১ লাখ ৭৫ হাজার ভোট পেয়ে থাকেন এবং তার ওপর এবার যদি শামীমের ভোট যুক্ত হয় তাহলে আইভী আরও বেশি ব্যবধানে জয়ী হবেন বলে ধরেই নেওয়া যায়। ভোটের সমীকরণ অন্তত তাই বলছে।

আবার যদি ধরে নিই– ২০১১ সালে বিএনপির ভোট এবং ২০১৬ সালে শামীম সমর্থকদের ভোটে আইভী জয়ী হয়েছেন, তবে ২০২২ সালে শামীমের (সমর্থকদের) ভোট আইভী পান কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। কারণ, এবার বিএনপির ভোট তৈমুরই পাবেন। কাজেই শামীম কি সত্যিই আইভীকে সমর্থন করেন কিনা, নাকি শুধু সংবাদ সম্মেলনের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ তা স্পষ্ট হবে ভোটের ফলে।

আইভী এরই মধ্যে অভিযোগ তুলেছেন– তৈমুর বিএনপি বা স্বতন্ত্র নয়, বরং ওসমান পরিবারের প্রার্থী। ওসমান ও চুনকা পরিবারের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে মূলত নৌকাই গতি হারাবে। আর শামীমের সমর্থন আইভীর বৈঠায় গতি সঞ্চার করলে উভয়ের শক্তিতে নৌকা হবে আরও বেগবান, সহজেই গন্তব্যে পৌঁছাবে। তা না হলে হেলেদুলে চলে হাতিও হারাতে পারে চিতাকে, পদভারে ডুবে যেতে পারে নৌকাও। সেক্ষেত্রে নাসিক-এ বাঘের গর্জনের বদলে বৃংহিতই শোনা যাবে।

তবে, শেষ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের ভোটযাত্রার ফলের জন্যই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। মনে পড়ে রবিঠাকুরের ‘ভক্তিভাজন’ কবিতাটি– রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম/ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম/ পথ ভাবে আমি দেবো রথ ভাবে আমি/ মূর্তি ভাবে আমি দেব-হাসে অন্তর্যামী।’

ভোট নিয়ে প্রার্থী, জনগণ, ভোটার ও বিশ্লেষকরা যার যার ভাবনায় বিভোর। শেষ হাসি কে হাসে সেটা শুধু জানে অন্তর্যামী। যদি সুষ্ঠু হয় তাহলে ভোট একটি শক্তি। আগামীকাল (১৬ জানুয়ারি) নারায়ণগঞ্জে সেই শক্তিভাজন পর্বই দেখার অপেক্ষায় দেশের ভোটভক্ত জনগণ।
 
লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

/এসএএস/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ