X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

এমন আইনে কী হবে?

এরশাদুল আলম প্রিন্স
২৯ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০৫আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০৫

এরশাদুল আলম প্রিন্স পর পর দুই মেয়াদে সংলাপের মাধ্যমে কাজী রকিবুদ্দিন আহমেদ ও কে এম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে কমিশন গঠন করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর। রাষ্ট্রপতি নিজের বিবেচনা মতো কমিশন গঠন করতে পারেন। যদিও সংবিধানের বিধান হচ্ছে আইন অনুযায়ী কমিশন গঠন করা। কিন্তু সে আইন না থাকায় রাষ্ট্রপতি নিজের বিবেচনা অনুযায়ী কমিশনারদের নিয়োগ দিয়েছেন। এখন আইন হয়েছে, তাই রাষ্ট্রপতি এখন থেকে ‘আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে’ কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন [অনুচ্ছেদ ১১৮(১]।

গত পঞ্চাশ বছর ধরেই একটি আইনের সাংবিধানিক প্রয়োজন ছিল। এ নিয়ে রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজ বহু দিন ধরেই কথা বলেছেন। তারপরও কোনও সরকারই আইন করেনি। কিন্তু পঞ্চাশ বছরে যা হয়নি এই সরকার সেটি করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২ সচিবালয় ও মন্ত্রিসভা, স্থায়ী কমিটি দরজা পেরিয়ে সংসদে পাস হয়েছে।

সংবিধানের বিধান বাস্তবায়ন একটি জরুরি বিষয় সন্দেহ নেই।  কিন্তু জনদাবি ছিল তারচেয়েও বেশি কিছু। জনদাবি ছিল একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা, যে কমিশন স্বাধীন, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষভাবে যেকোনও নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে।

কিন্তু এ আইনের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করার সুযোগ হলো কি? এ আইনের ফলে কমিশন কি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে? আইন বিশ্লেষণে না গিয়েই এ কথা বলা যায়, এ আইনের মাধ্যমে শক্তিশালী ও স্বাধীন কমিশন গঠন এবং নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করার মতো নতুন কোনও সুযোগ সৃষ্টি হয়নি।

গত দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি সংলাপের মাধ্যমে কমিশন গঠন করেছেন। সংলাপের মাধ্যমে তিনি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। সেই সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করতো। অতঃপর রাষ্ট্রপতি কমিশনার নিয়োগ দিতেন। অর্থাৎ, সংলাপে বিভিন্ন দল সার্চ কমিটি বা কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করতো, তারপর রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করতো, সার্চ কমিটি কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করতো এবং সবশেষ রাষ্ট্রপতি কমিশন গঠন করতেন।

কিন্তু সেখানে কয়েকটি ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ ছিল। সেগুলো হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো সার্চ কমিটির সদস্য বা কমিশনার হিসেবে কাদের নাম প্রস্তাব করতো সেটি প্রকাশ করা হতো না। সাম্প্রতিক সংলাপেও আমরা শুধু জাতীয় পার্টির প্রস্তাবিত নামগুলোই জানতে পেরেছি। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলো কাদের নাম প্রস্তাব করেছে আর রাষ্ট্রপতি সেই নাম থেকে কাউকে গ্রহণ করেছেন কিনা সেটা জনগণ জানতে পারেনি। জনগণ এটা জানার দাবি রাখে।  

নতুন আইনেও এ নিয়ে কোনও বিধান নেই। সেখানে শুধু সার্চ কমিটিতে কারা থাকবেন তার একটা খতিয়ান দেওয়া হয়েছে। ছয় সদস্যবিশিষ্ট সার্চ কমিটিতে থাকবেন আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাবরক্ষক, পিএসসি চেয়ারম্যান, দুজন বিশিষ্ট নাগরিক যাদের মধ্যে একজন নারী থাকবেন।

বলা হয়েছে, ‘সার্চ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করিয়া দায়িত্ব পালন করিবে’। প্রশ্ন হচ্ছে, সার্চ কমিটির সব সদস্যই সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পদে নিয়োগকৃত। নিরপেক্ষ বা সরকারের প্রতি বিরাগভাজন কেউ ওইসব উচ্চ পদে নিয়োগ পান না। কাজেই সরকারের প্রতি অনুরাগভাজন সার্চ কমিটি কেন নিরপেক্ষ বা সরকারের প্রতি বিরাগভাজন ব্যক্তিদের কমিশনার হিসেবে নিয়োগদানের সুপারিশ করতে যাবেন। সরকারি সার্চ (যে সরকারই হোক না কেন) কমিটি কাদের নাম সুপারিশ করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

গত দুই মেয়াদে তো সংলাপের মাধ্যমে সার্চ কমিটির সদস্যদের ও কমিশনারদের নাম প্রস্তাবের সুযোগ ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে সার্চ কমিটি ও কমিশনার উভয় সদস্যদেরই নাম প্রস্তাব করতে পারতো, নতুন আইনে তো সেই সুযোগও নেই। সার্চ কমিটিতে কারা থাকবেন তা আইনই ঠিক করে দিয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ বা অন্তত বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনীত প্রতিনিধি নিয়ে সার্চ কমিটি গঠনের সুযোগ এই আইনে নেই।  সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের যে পথ ছিল এখন সে পথও বন্ধ হলো।  বরং, সমস্যাকে এখন স্থায়ীভাবে বিধিবদ্ধ করা হলো।

বলা হয়েছে, সার্চ কমিটি ‘স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করিয়া দায়িত্ব পালন করিবে’। স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার বিষয়টি আপেক্ষিক। এছাড়া কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়টি তো আইনেই বলা আছে (ধারা ৫)। সার্চ কমিটি সে বিষয়গুলো বিবেচনা করেই সদস্যদের নাম সুপারিশ করবে। এর বাইরে তো তারা কাউকে সুপারিশই করতে পারবে না। করলেও সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তারা কাউকে সুপারিশ করলে তাদের প্রশ্ন করারও কিছু থাকবে না।

আইনে আছে, অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব হচ্ছে, ‘আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করিয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করা’। আইনের ৫ ও ৬ ধারায় কমিশনারদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার (চাকরির বয়স) কথা বলা আছে। কিন্তু সততা ও সুনামের বিষয়টি নির্ধারিত নেই, সেটি নির্ধারণ করাও যায় না। আর একজন ব্যক্তি ঘুষ না খেলেই যে সৎ হবে তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? সততা বলতে কি শুধু আমরা অর্থনৈতিক সততাকেই বুঝি? একজন ‘ঘুষখোর’ ব্যক্তিও দলনিরপেক্ষ হতে পারেন? আবার একজন ঘুষ না খাওয়া ব্যক্তিও দলকানা হতে পারেন। এরকম একজন ঘুষ না খাওয়া (সৎ) দলকানা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন? বাঘা বাঘা রাজকর্মচারীরা অধিকাংশই ঘুষ খান না এবং চাকরি জীবনে তাদের সুনামও আছে। কিন্তু তারা দলীয় অনুগ্রহভাজন এবং সে কারণেই বড় বড় রাজকর্মচারী।

সার্চ কমিটি আইনের ৫ ও ৬ ধারা অনুসরণ করে এই বড় বড় রাজকর্মচারীদের নামই সুপারিশ করবে ও করতে পারবে। কাজেই এই নতুন আইন অনুসরণ করেই রকিবুদ্দিন ও আজিজের মতো কমিশনারদের নাম সুপারিশ ও নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। কাজেই, প্রস্তাবিত আইনে ‘নতুন বোতলে পুরনো সুরা পেশ’ করা হলো মাত্র। আগের দুই মেয়াদে এই ‘সুরা’ তৈরি করা হতো দশ জনের সঙ্গে আলোচনা-সংলাপ করে, এখন আইন করে সেই রেসিপি জাতিকে ধরিয়ে দেওয়া হলো মাত্র।

ধারা ৫(খ) অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ৫০ বছর। সংবিধান অনুযায়ী ৩৫ বছর হলে রাষ্ট্রপতি হওয়া সম্ভব, ২৫ বছর হলে এমপি, মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হওয়াও সম্ভব কিন্তু কমিশনার হতে হলে বয়স হতে হবে ৫০। কিন্তু ৩৫ বছরে রাষ্ট্র্রপতি হওয়া গেলে, ২৫ বছরে এমপি, মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হওয়া গেলে নির্বাচন কমিশনার হতে গেলে বয়স কেন ৫০ বছর লাগবে সেটা পরিষ্কার না।

২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞার বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যদের ২০ বছর লাগলেই কি কমিশনারদেরও ২০ বছরের অভিজ্ঞতাই লাগবে? সুপ্রিম কোর্টে দশ বছর প্র্যাকটিস করলে বিচারক হওয়া যাবে, কিন্তু নির্বাচন কমিশনার হতে লাগবে ২০ বছর। অথচ কমিশনারদের (প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাদে) পদমর্যাদা হাইকোর্টের বিচারকেরই সমান। একজন ১০ বছর হাইকোর্টে ওকালতি করে বিচারক হবেন, আরেকজন ২০ বছর কাজ করে তারই পদমর্যাদাসম্পন্ন কমিশনার হবেন।

কমিশন আইনে একজন ব্যক্তি যদি দোষী সাব্যস্ত হয়ে যদি দুই বছর বা তার অধিক কারাদণ্ড ভোগ করেন তবে তিনি কমিশনার হতে পারবেন না। কিন্তু দুই বছরের কম হলে তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়েই পরের দিন কমিশনার হিসেবে শপথ নিতে পারবেন। এটাই [দফা ৬(ঘ)] আইনের বিধান। অথচ একজন ব্যক্তি যদি দোষী সাব্যস্ত হয়ে দুই বছর বা তার চেয়ে বেশি জেল খাটেন তবে তাকে এমপি হতে আরও ৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এটাই সংবিধানের বিধান [অনুচ্ছেদ ৬৬ (২) (ঘ)]। গতকাল খালাস পাওয়া কমিশনারের অধীনে ৫ বছর আগে খালাস পাওয়া প্রার্থী এমপি নির্বাচন করবেন। এটা কি অসঙ্গতি না মধুর ভুল?

ধারা ৯-এ সার্চ কমিটির কার্যক্রম, এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগকে সুরক্ষা বা হেফাজত করা হয়েছে। কোনও ধরনের দায়মুক্তি বা হেফাজত আদালতের ক্ষমতাকে খর্ব করে। এসব তথাকথিত হেফাজত আইন ও ন্যায়বিচার পরিপন্থী। ভোট এক মহা আমানত। রাজকর্মচারীদের আর্থিক অনিয়মও আমানতের বড় খেয়ানত। এসবের হেফাজত কাম্য নয়। বিদায়ী কমিশনের দুর্নীতির খবর যখন একে একে বের হয়ে আসছে, তখন এরকম তথাকথিত হেফাজত আমানতের খেয়ানতের বড় নজির।

শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। আইন অনুযায়ী কমিশনের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারপরও কমিশন কেন নখদন্তহীন কাগুজে বাঘই রয়ে গেলো  তার কারণ  খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। সরকার আইন করে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূর্ণ করেছে সে জন্য সাধুবাদ। কিন্তু এ আইনে দেশের চিরবিবদমান নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানের কোনও সূত্র দৃশ্যমান নয়। ভোট বালাই দূর হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ