X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পুতিনের স্বপ্নবিলাস বনাম পশ্চিমাদের ইউক্রেন-কপটতা

আনিস আলমগীর
০১ মার্চ ২০২২, ১৭:১০আপডেট : ০১ মার্চ ২০২২, ১৭:১০

আনিস আলমগীর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জৌলুসপ্রিয় লোক। তিনি প্রথমবার নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্টের জন্য যে প্রাসাদ তৈরি করান তা নাকি সম্রাট নিকোলাসের প্রাসাদের চেয়েও জৌলুসময়। আবার রাশিয়াকে সোভিয়েতের পর্যায়ে নিতেও তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সোভিয়েত ধ্বংসের কারণ হিসেবে আধুনিক গবেষকরা বলছেন, তার বিরাটত্বই ছিল ধ্বংসের মূল কারণ। পুতিন বিরাট রাশিয়া গড়তে চান না সত্য, কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক কারণে রাশিয়ার সীমানা বাড়াতেও তিনি পিছপা হচ্ছেন না।

মনে পড়ে আট বছর আগে পুতিন যখন ইউক্রেনের স্বাধীন প্রদেশ ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করলো তখন ‘ক্রিমিয়ায় থামুক পুতিনের স্বপ্নবিলাস’- এই শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম (দৈনিক আমাদের সময়, ২৩ মার্চ, ২০১৪)। কৃষ্ণ সাগরে অবাধে প্রবেশের জন্য কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী ক্রিমিয়া দখল রাশিয়ার জন্য জরুরিও ছিল বটে। তারও আগে ২০০৮ সালে পুতিন জর্জিয়ার আবখাজিয়া এবং সাউথ ওসেটিয়াকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। মলদোভার ওপরেও পুতিনের নজর রয়েছে। মলদোভার পূর্বপাশের ট্রান্সনিস্ট্রিয়া মূলত রাশিয়ার দখলে এবং এখানকার অধিবাসীরা নিজেদের স্বাধীন ভাবে।

পুতিনের এই স্বপ্নবিলাস রাশিয়ার জন্য বিপদ ডেকে আনছে কিনা এই নিয়ে শঙ্কিত বিশ্ববাসী। কারণ, পুতিনের স্বপ্নবিলাস থেমে নেই। তিনি পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্ন দুটি অঞ্চলে ‘শান্তি বজায়’ রাখার জন্য রুশ সৈন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২। মানে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছেন। তার আগে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছেন। এখন সবাই ভয় করছে রাশিয়া যদি এটা করতে থাকে এবং ইউক্রেন দখলে সক্ষম হয়, তাহলে আগামীকাল কাজাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, স্লোভাকিয়া, ক্রোয়েশিয়া মানে সোভিয়েত রাশিয়ার সব রাষ্ট্রকে গিলে আবার বড় হতে চাইবে।

অবশ্য আমি মনে করি না পুতিন ইউক্রেন দখলের জন্য সেখানে গিয়েছেন। পুতিন চান তার ইশারায় নাচবে এমন একটা ইউক্রেন সরকার। কারণ, এখনকার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নাচেন পশ্চিমাদের কথায়। সে কারণে আমেরিকা গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করলেও জেলেনস্কি তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিকদের জেলে ভরেছেন, টেলিভিশন বন্ধ করেছেন, বাকস্বাধীনতা খর্ব করেছেন- সেসব বিষয় মার্কিনিরা দেখে না, পশ্চিমা মিডিয়াও তা দেখে না।

ক্রিমিয়া দখলে নেওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর দীর্ঘ সময়ব্যাপী বাণিজ্যিক অবরোধ দিয়ে রেখেছে কিন্তু রাশিয়া কোনও ভ্রুক্ষেপ করেনি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে এখন আরও বহুগুণ অবরোধ আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা। ফলে পুতিনের স্বপ্নবিলাসের নিন্দা হচ্ছে বেশি। খোদ রাশিয়াতে যুদ্ধবিরোধী প্রবল বিক্ষোভ হচ্ছে এবং এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার লোককে জেলে পুরেছে পুতিনের একনায়কতান্ত্রিক প্রশাসন।

এখন প্রশ্ন আসছে রাশিয়া কেন যুদ্ধে জড়ালো? যুদ্ধ এড়ানো কি অসম্ভব ছিল? আমার ধারণা, পুতিনের চেয়ে যুদ্ধ এড়ানো সহজ ছিল বাইডেনের। তার দরকার ছিল ইউক্রেনকে ন্যাটোতে নেওয়া হবে না, শুধু এটা বলা। ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে অন্তর্ভু্ক্ত হয়  তাহলে রাশিয়ার সীমান্তে হাজার হাজার ন্যাটো এবং আমেরিকান সৈন্যের উপস্থিতি রাশিয়ার নিরাপত্তার ওপর হুমকি তো বটেই, এটি রাশিয়াকে ছোট করে দেখানোর নামান্তর। যেই ‘বৈধ উদ্বেগের’ কথা পুতিন বারবার বলে আসছেন এবং ইউক্রেন নিরপেক্ষ থাকবে এমন নিশ্চয়তা না থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।

২০০২ সাল থেকে রাশিয়া ন্যাটোর সঙ্গে নানা ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করছিল। কিন্তু ক্রিমিয়া ইস্যুতে ন্যাটো রাশিয়াকে দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং পূর্ব ইউরোপের সাবেক সোভিয়েত ব্লকের অধিকাংশ রাষ্ট্রকে ন্যাটোর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করছে। রাশিয়া সীমান্তের ইউক্রেন, জর্জিয়াকে ন্যাটো সদস্য করতে চাওয়া মানে তার ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলা। ন্যাটোকে মোকাবিলায় যে ওয়ারশ চুক্তি হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের সঙ্গে তারও অবসান হয়েছে। তাহলে ন্যাটোর প্রাসঙ্গিকতা কোথায় এবং কেন তার সদস্য সংখ্যা বেড়েই চলছে– এই প্রশ্ন করবে কে? জর্জিয়া, ইউক্রেনকে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে হার মেনে প্রদেশ খোয়াতে হয়েছে। এর জন্য রাশিয়া কি এককভাবে দায়ী, নাকি তাদের ন্যাটোতে নেওয়ার পশ্চিমা উসকানি দায়ী?

বাস্তবতা হচ্ছে, এই পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সহসা ন্যাটোর সদস্য করবে না, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেও নেবে না। তারা শুধু ইউক্রেনের মাটিকে ব্যবহার করছে রাশিয়াকে ফাঁদে ফেলার জন্য। নিজেরাই প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা ইউক্রেনকে দখল করবে বলে বরং রাশিয়াকে তাদের দরকার ছিল। পুতিন সেটা করে দিয়েছেন। আর তাদের পুরোপুরি সহায়তা করেছেন ইউক্রেনের কমেডিয়ান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, যার কোনও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই, পুরোটাই আবেগে চলা পশ্চিমা পুতুল।

আমেরিকার ইউক্রেন যুদ্ধের দরকার ছিল। কারণ, বাইডেন প্রশাসন এই ছুতোয় অবরোধ দিতে পারে রাশিয়ার বিরুদ্ধে, রাশিয়ার জনগণের বিরুদ্ধে। রাশিয়া যদি ইউক্রেন দখল করে তাহলে এর মাধ্যমে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ আবার শুরু করা যায় এবং অস্ত্র বিক্রেতারা আরও বেশি অস্ত্র বানাতে পারে, বিক্রি করতে পারে, আরও বেশি আয় করতে পারে। মার্কিন প্রশাসনের ওপর অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের প্রভাব অনেক আগেই প্রমাণিত। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ধ্বংসের পর অন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে গোলোযোগ লাগানোর এখনও সময় আসেনি।

জেলেনস্কি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির মতো দেশ থেকে পালিয়ে যায়নি, লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। সে কারণে সোশাল মিডিয়ায় তার অনেক বাহবা চলছে। এটাও ঠিক যে তিনি না পালানোয় ইউক্রেনের জনগণ এবং সেনাদের মনোবল বেড়েছে। আফগানিস্তান দখলের পর রাশিয়া একসময় পালিয়েছিল। তাকে বর্তমান যুদ্ধের সঙ্গে এক করলে ভুল হবে। কারণ, আফগানিস্তানের জনগণের মধ্যে রাশিয়ান ছিল না। যারা রাশিয়াকে সাহায্য করেছে তারা তাদের পুতুল হিসেবে ছিল। কিন্তু ইউক্রেনের জনগণের মধ্যে রাশিয়ান স্পিকিং লোক আছে, রাশিয়ার অনুগত লোক আছে, তাদের দুই দেশের জনগণের বন্ধনও অনেক বেশি মজবুত।

যুদ্ধ যদি চলতেই থাকে এবং পশ্চিমারা সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িত না হয়, ইউক্রেন কখনোই রাশিয়ান মিলিটারির সঙ্গে পেরে উঠবে না। ইউক্রেন যদি বিশ্বাস করে তারা যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে পারবে তবে তারা বোকার স্বর্গে আছে। কৌতুক অভিনেতাকে রাষ্ট্রনেতা বানালে কি হয় ইউক্রেনবাসীকে তা দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আর অবস্থা এমন চলতে থাকলে ইউক্রেন হবে সন্ত্রাসবাদের নতুন উর্বর ভূমি।

ইউক্রেনের উচিত ন্যাটোয় যুক্ত না হওয়ার অঙ্গীকার করা। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে তার থেকে সুবিধা আদায় করা। যদি এই পরিস্থিতির উন্নতি না হয় তবে সেটি ইউক্রেনের জন্য যেমন ভালো হবে না, তেমনি রাশিয়ার জন্য ভালো নয়। রাশিয়া বড় ধরনের শক্তি প্রয়োগ করলে ইউক্রেন দখল করা কোনও বিষয় না। কিন্তু সেটা করতে গেলে অনেক নিরীহ জনগণ হত্যার শিকার হবে। ইতোমধ্যে দেড় লাখ লোক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। হাজার হাজার লোক অন্য দেশে পালিয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মানবিক বিপর্যয় আরও বাড়বে। রক্তক্ষয় আরও বাড়বে।

আরেকটি বিষয় পশ্চিমা মিডিয়া বলবে না যে ইউক্রেনের মিলিটারি যখন নিজেদের বাঁচাতে ব্যর্থ হবে তখন জনপদে ঢুকে পড়ে সাধারণ জনগণকে হিউম্যান শিল্ড বা মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে। রাশিয়ান সেনারা যখন ইউক্রেনের সেনাদের টার্গেট করে এসব জনপদে হামলা করবে, পশ্চিমা মিডিয়া সেটাকে আরও ফলাও করে প্রচার করতে পারবে। বলতে পারবে রাশিয়া মানবতার বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।

পশ্চিমারা মানববিধ্বংসী অস্ত্রের মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরাক দখল করেছিল। তাদের গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছে ইরাক ধ্বংস হওয়ার পর। লাখ লাখ ইরাকির জীবন গেছে। ধ্বংস করেছে তাদের ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ইরাকের ভূমিকে সন্ত্রাসের লীলাভূমি বানিয়ে, আইসিস দিয়ে ধ্বংস করেছে সিরিয়াকেও। আজও ইরাকে শান্তি ফিরে আসেনি। আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আগের অবস্থায় যেতে এই রাষ্ট্রগুলোর আরও কয় যুগ লাগবে বলা সম্ভব না।

ইরাককে যখন অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, হত্যাযজ্ঞ চলেছে, হিউম্যানিটেরিয়ান ক্রাইসিসের বিষয় পশ্চিমা মিডিয়ার তখন চোখে পড়েনি। ইউক্রেনের মানবিক বিপর্যয় অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু সেটা ইরাকের তুলনায় কিছুই না। সেটা আফগানিস্তানে চলমান মানবিক বিপর্যয়ের তুলনায়ও নগণ্য। দুই কোটি আফগান জনগণকে মেরেছে তারা শান্তি আনার নামে।

শেষ করবো এই বলে, রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না, তারা যুদ্ধ করছে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে। আমেরিকার সঙ্গে। ইউক্রেনকেও এটা বুঝতে হবে। কিন্তু এই যুদ্ধের মূল্য কাকে দিতে হচ্ছে? এর মূল্য দিতে হচ্ছে আমেরিকান জনগণকে, এর মূল্য দিতে হচ্ছে রাশিয়ান জনগণকে এবং অতি অবশ্যই ইউক্রেনের জনগণকে। সেই সঙ্গে সারা বিশ্বের জনগণও রেহাই পাবে না এই যুদ্ধের আঁচ থেকে।
 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ