X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচের মধ্যে মোদির চার, মমতার রাজনীতি ও বাংলাদেশ

স্বদেশ রায়
১৪ মার্চ ২০২২, ১৫:৩২আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২২, ০৯:১৫

স্বদেশ রায় ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর প্রদেশের বিধানসভাসহ পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে চারটিতে বিজেপি জয়লাভ করার ফলে সেদেশের রাজনীতিতে অনেকগুলো সমীকরণ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত, এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনকে তাদের রাজনীতিতে আগামী ২০২৪ এর জাতীয় নির্বাচন বা লোকসভার নির্বাচনের সেমিফাইনাল হিসেবে ধরা হয়েছিলো। বিজেপি ও তার নেতা নরেন্দ্র মোদি খুব সহজেই সে সেমিফাইনাল পার হলেন। এবং আশি শতাংশ মার্ক নিয়ে। এর ভেতর আরও বড় বিষয়, লোকসভা নির্বাচনে সব থেকে বেশি আসন যে উত্তর প্রদেশে (৮০টি আসন) সেখানেও বিজেপি বড় মাপের একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী এই রাজনৈতিক দলটির জন্যে এ রাজ্যটির ভোটের হিসাব সুখকর নয়। কারণ, সেখানে সংখ্যালঘু বিশ শতাংশ মুসলিম। বিজেপি মুসলিমকে তাদের বিপরীত শক্তি হিসেবে তুলে ধরে। অন্য দিকে হিন্দুত্ববাদ সব সময়ই নিয়ন্ত্রিত হয় বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা। সেই আদিকাল থেকে এটা চলে আসছে। উত্তর প্রদেশে এই বর্ণহিন্দুর সংখ্যা মুসলিমদের প্রায় কাছাকাছি। বাদবাকি যাদব ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণি। যাদবদের বা নিম্ন বর্ণের দল দুটির নেতৃত্বে একটি মায়াবতী অন্যটি মুলায়েম সিং যাদবের ছেলে অখিলেশ যাদব। যাদব পরিবারের সঙ্গে ২০ ভাগ মুসলিম ভোটের একটি অংশের রয়েছে একটা ইমোশনাল সম্পর্ক। অর্থাৎ প্রথমবার বাবরি মসজিদ ভাঙার চেষ্টার সময়ে মুলায়েম সিং যাদব কঠোরভাবে বাধা দিয়েছিলেন। অন্যদিকে অন্য পিছিয়ে পড়া বর্ণের দলের নেত্রী সাবেক মূখমন্ত্রী মায়াবতীও যাদব সহ অন্যান্য পিছিয়ে পড়াদের নেতৃত্ব দেন। এর ফাঁক গলিয়ে ২৩ ভাগের মতো বর্ণ হিন্দুর ভোট ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া ( ওবিসি) বর্ণগুলোর ভোটের ভাগ নিয়ে উত্তর প্রদেশে এই প্রথম বারের মতো কোনও দল পরপর দুইবার ক্ষমতায় এলো।

অনেকে ধারণা করেছিলেন, এখানে বিজেপি খারাপ করবে। তাদের হিসেবে ছিল ওবিসিরা এবার আর বিজেপিকে ওইভাবে সমর্থন করবে না। তাছাড়া কৃষক আন্দোলনে গুলি চলেছে এই রাজ্যে। আর বিজেপির অনেক নেতা মুসলিমদেরকে সরাসরি শত্রু হিসেবে তুলে ধরেছে বেশ কিছু কথাবার্তায়। এই পরিস্থিতিতে বিজেপির সেখানে এই বিজয়কে নানানভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তবে, এ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপকালে দিল্লি জওয়াহের লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষক বললেন, বিজেপির কিছু শিক্ষিত মানুষ মুসলিমদেরকে ভারতের শত্রু এই অবস্থানে রাখছে না।  তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ভারতের মুসলিমদের ভারতীয় সংস্কৃতিকে ধারণ করতে হবে। এটা ভারতীয় মুসলিমদের জন্যে বিশেষ করে উত্তরভারতীয় মুসলিমদের জন্যে মোটেই কোনও নতুন কিছু নয়। বরং সঙ্গীত, অভিনয়, ছবিআঁকা সহ ভারতের নানান ঐতিহ্য মনেপ্রাণে গ্রহণ করে শত শত বছর ধরে তারা ভারতীয়ই সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে গেছে। তাঁর মতো বিজেপির সকলে যদি এই ছোট আকারের শিক্ষিত শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে গ্রহণ করে মুসলিম বিরোধী জিঙ্গোইজম থেকে বের হয়ে আসতে পারে– তাহলে সেটা বিজেপির জন্যেও ভালো, ভারতের রাজনীতির জন্যেও ভালো। কারণ, ভারতের মতো একটি বহু নদী অথচ একই পানি এমন সংস্কৃতির রাষ্ট্রে এই ধর্মীয় উন্মাদনা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্যে ক্ষতিকর। তাছাড়া তিনি মনে করেন, যোগী আদিত্যনাথের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে এখন প্রধান কাজ হবে তাঁর নিম্ন পর্যায়ের জঙ্গি কর্মীদেরকে সুপথে নিয়ে আসা। যেমন তিনি আস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছেন ওবিসি’র নারী সম্প্রদায়কে। তারা মনে করে মায়াবতী বা অখিলেশের থেকে তাদের জন্যে যোগী আদিত্যনাথ অনেক কিছু করেছে। তাই বিজেপির হিন্দুত্ববাদের মুখটি এখন যদি মুসলিম বিরোধিতার বদলে নিজ ধর্মের মধ্যে যে বর্ণ বিভাজনের যন্ত্রণা সেখান থেকে মুক্তির আন্দোলনে নিয়ে যায়– সেটাই হবে, সিন্ধু নদের উপকূলে যে হিন্দু জাতি গোষ্ঠী বাস করতো ওই হিন্দু জাতি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব। অর্থাৎ সেই রবীন্দ্রনাথের চিন্তায়– আর্য, অনার্য, শক, হুন, পাঠান, খ্রিষ্টান সকলের দেশ।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ভদ্রলোক শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী। তার আশা অনেক ভবিষ্যতমুখী। তিনি রাজনীতিবিদদের চেনেন তাঁর চোখ দিয়ে। কিন্তু আসলে রাজনীতিবিদদের কাছে এই মানব সভ্যতার কল্যাণ কামনা যত কম করা যায় ততই আঘাতটি কম পেতে হয়। কারণ, তাদের মূল উদ্দেশ্য ভোট ও ক্ষমতা। যার ক্ষমতার জন্যে ভোটের দরকার আছে, তিনি ভোট কৌশলী হবেন। আর যার সেটার দরকার নেই তিনি বিভিন্ন বাহিনীর ওপর নির্ভর করবেন।

তাই ভবিষ্যতমুখী মানব কল্যাণের আশার বদলে এখন সত্য হলো, বিজেপি তাদের সেমিফাইনালে জিতেছে। আর এই সেমিফাইনালে তারা শুধু নিজেরা চারটি রাজ্যে জেতেনি, তিনটি রাজ্যে ভারতীয় কংগ্রেসকে বেশিরভাগ জায়গায় তৃতীয় অবস্থানে নামিয়ে এনেছে। এটা তাদের একটা বড় বিজয়। কারণ, দৃশ্যত এখন ভারতে বিজেপির অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা বা দল মনে হয়। কিন্তু সর্বভারতীয় ওই লোকসভা নির্বাচনে এখনও বিজেপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। কারণ পরপর দুটি লোকসভা নির্বাচনে তারা খারাপ করলেও গত লোকসভা নির্বাচনেও দেখা গেছে পাস করেছে ও দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এ মিলে ২৬১টি আসন ছিল ভারতের ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে কংগ্রেসের। যদিও তারা পাস করেছিলো মাত্র ৫৬টিতে। কিন্তু দ্বিতীয় অবস্থান ও পাস করা আসন মিলে যখন ২৬১ হয় তখন ক্ষমতাসীনদের কাছে সেই সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। ভোটের রাজনীতিক মাত্রই বোঝেন এ ধরনের ২৬১ থেকে ১৬০-৭০ টিতে বিজয়ী যে কোনও মুহূর্তে ওই দল হতে পারে। আর কংগ্রেস ওই ১৬০-৭০ টি আসন পেলে আঞ্চলিক দলের সমর্থনে দিল্লির মসনদের হিসাবও বদলে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। সে ক্ষেত্রে তিনটি রাজ্যে কংগ্রেসকে দ্বিতীয় থেকে তৃতীয়তে নামিয়ে দেওয়া অনেক বড় সাফল্য বিজেপির। ২০২৪ এর পথে অনেকটা নিরাপদ যাত্রা।

বিজেপির যেমন নিরাপদ যাত্রা হয়েছে তেমনি গত বছর পশ্চিমবঙ্গে মোদির হাজার চেষ্টার ফলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে না পারায়- মমতা জাতীয় পর্যায়ে অনেকটা পরিচিত হয়েছিলেন। কিন্তু মমতা নিজেকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গে যে দারিদ্র টিকিয়ে রেখে নগদ অর্থের রাজনীতি করেন, এ নিয়ে ভারতের অন্য প্রদেশে খুব বেশি দূর এগোনো যাবে না। তারপরেও গোয়াতে প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রীকে দলে এনে সেখানে প্রার্থী দিয়ে একটা সর্বভারতীয় দলের আমেজ আনার চেষ্টা শুধু নয়, কংগ্রেসের বিকল্প হতে গিয়েছিলেন রাতারাতি। রাজনীতিতে যে এতটা শর্টকাট পথ নেই সেটা তাঁর মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিক কেন জানলেন না সেটাই এখন বড় প্রশ্ন! অন্যদিকে মমতার মতো হাঁকডাক না করে শান্ত মাথায় কংগ্রেসের কাছ থেকে ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ছিনিয়ে নিয়েছেন দিল্লি কেন্দ্রিক আম আদমী পার্টি নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি এখন পশ্চিমবঙ্গে তাঁর হাত বাড়াচ্ছেন। বাঙালি জাতিসত্তার মধ্যে কেজরিওয়ালের পক্ষে দ্রুত ঢোকা খুব সহজ নয়। তবে মমতাকে এখন আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে হয় পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে আর সর্ব ভারতীয় হতে গেলে তাকে কংগ্রেসের অধীনেই জোটে জেতে হবে। মাত্র কিছুদিন আগে যে কংগ্রেসকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। অবশ্য এ ধরনের ভোটের ও ভাগাভাগির রাজনীতিতে নীতি ও শেষ কথা বলে কোনও কিছু খুব বেশি কাজ করে না।

তবে বিজেপির এই চার রাজ্যে বিজয় আবার আগামী ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফল করতে সহায়তা করবে পশ্চিমবঙ্গে। কারণ, বিধান সভায় তারা তাদের ঘরের মেয়েকে যতই ভোট দিক, লোকসভায় তাদের হিসেব থাকবে কেন্দ্রে ক্ষমতায় কে যাবে সেই দিকে। আর সে ক্ষেত্রে লোকসভা ভোটের আগে একটা বিজয়ের হাওয়া তুলে নিতে সমর্থ হয়েছে বিজেপি। যেমনটি ঘটেছে আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের নির্বাচনগুলোতে। যে দলের আন্দোলনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয় ওরাই নির্বাচনে যেতে। কারণ, ওই আন্দোলন ও তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠা করার ভেতর দিয়ে তারা বিজয়ের আগে একটা বিজয়ের হাওয়া তুলে নেয়। যে হাওয়াই ভোটের পালে লাগে। ভারতের এই পাঁচ রাজ্যসভা নির্বাচনের ফলও মূলত ছিল ২০২৪ এর ভোটের পালের হাওয়া পাবার নির্বাচন। আর সে হাওয়া বিজেপি পেয়ে গেছে।

এখন যদি সত্যি ২০২৪ এ বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসে তাহলে ভারতের রাজনীতিতে ও আর্ন্তজাতিক রাজনীতিক বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক রাজনীতিতে অনেক বড় পরিবর্তন হবে। কারণ, ২০২৪ এর আগে পুতিন নিজ দেশে ক্ষমতা হারাতেও পারেন আর যদিও ক্ষমতায় থাকেন তাহলেও দুর্বল অবস্থায় থাকবেন। বিশেষ করে সে দেশের ধনীদের সমর্থন পাবেন না। অর্থনীতিও খারাপ হয়ে যাবে। বাড়বে চীন নির্ভরতা। এমন একটা সময়ে অনেকটা একক চীনের বিপরীতে গড়ে উঠবে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স সহ একটি বড় জোট। আর এই জোট যদি সামরিক জোটের নাম না নিয়ে অর্থনৈতিক জোটের নাম নেয় তখন এই জোটের বাইরে চীনের জন্যে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা অনেক সমস্যার হবে। আবার এরা যদি সামরিক জোট হয়, সেখানে বাংলাদেশের যাবার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কারণ, সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ যে কোনও সামরিক জোটে না যাওয়ায় অঙ্গীকারবদ্ধ। অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেকগুলো যোগাযোগ ভূগোল কেন্দ্রিক। তাই ২০২৪ এর পরে আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের  সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি জটিল হলেও হতে পারে।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ