X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এ শুধু টিপ নয়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৬ এপ্রিল ২০২২, ১৫:৫৭আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২২, ১৭:১২

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সম্প্রীতি হলো এমন ভ্রাতৃত্ববোধ, যা একাত্মতা সঞ্চার করে সমগ্র জাতির মধ্যে। মুসলমান, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় বাংলাদেশে এক মিশ্র সমাজের বিবর্তন মসৃণ করবে। বায়ান্ন বছর আগের মুক্তির লড়াইয়ের সময়কার এই ধারণাটি এখন এক অলীক কল্পনামাত্র, কারণ বারবার আমাদের কোনও না কোনও ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের জন্য যে অন্ধকার সমাজ সৃষ্টি করেছিল তা থেকে মুক্ত হইনি আমরা।

আসলে এক বিশাল ভয় বা আতঙ্ক ধীরে ধীরে গ্রাস করছে সবার মনে। এই দেশে সম্প্রীতির যে পরিবেশ এবং তা বজায় রাখার যে স্পৃহা মানুষের মধ্যে ছিল, তা কেমন যেন এখন ঠুনকো হয়ে ভেঙে পড়ছে। নিয়মিত সেই ভেঙে পড়াটা দেখছে মানুষ। অশিক্ষিত তো বটেই, শিক্ষিত সমাজের এক অংশ যখন যুক্তিকে হারিয়ে, বিক্রীত বিকৃত আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন বলতেই হয়, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমাদের সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে।

একজন নারী টিপ পরবে নাকি পরবে না, তার পোশাক কেমন হবে– সেটা রাস্তাঘাটে বলে দেওয়ার লোক অসংখ্য। যেমনটা ঢাকায় শিক্ষক লতা সমাদ্দারের সঙ্গে ঘটলো। কপালে টিপ পরায় লতা সমাদ্দারকে হেনস্তা করার ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের নাম নাজমুল তারেক। তিনি ডিএমপির প্রোটেকশন বিভাগে কাজ করেন। সাধারণ মানুষকে তিনি কী রকম সুরক্ষা দেন সেটা বোঝা গেলো ভালোভাবেই। লতা সমাদ্দার শিক্ষিত, সৎ, সাহসী ও সচেতন মানুষ। তাই তিনি প্রতিবাদ করেছেন। এই শিক্ষককে হেনস্তা করার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রতিবাদ হয়েছে, জাতীয় সংসদেও বিষয়টি উঠেছে। শেষ পর্যন্ত সেই কনস্টেবলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু এই সেবা বাহিনীর ভেতর যে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীলতার বাড় বাড়ন্ত আছে তার প্রমাণ আরেকজন দিয়েছেন। সিলেটে পরিদর্শক লিয়াকত আলী আরও নোংরা ভাষায় প্রতিবাদকারীদের কটাক্ষ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। অবশ্য তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।   

বিষয়টা শুধু টিপ নয়। খুব ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠার কাজটা করছে একটা শক্তি। দুর্গাপূজায় হামলা, পহেলা বৈশাখের উদযাপনে হামলা এবং এ নিয়ে ফতোয়া, ছবি ছাড়া বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় পরিচয়পত্র দাবি করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন, বাসের ভেতর টি-শার্ট পরায় কিশোরী মেয়েকে হিজাবি নারীর অত্যাচার, ইউটিউব ওয়াজে নিয়মিত নারী বিদ্বেষ, মুক্তিযুদ্ধ বিদ্বেষ, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি বিদ্বেষ, পাঠ্যপুস্তকের ইসলামিকীকরণ সব একসূত্রে গাঁথা।

তাই এই পুলিশ কনস্টেবল যা করেছে– সেটা তার এবং তাকে এই লাইনে উদ্বুদ্ধকারীদের রাজনৈতিক লড়াই। মৌলবাদের সঙ্গে মুক্তমনের লড়াই। টানা ১৩ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, অথচ সমাজে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রভাব ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। অবস্থাটা এমন হয়েছে যে মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে রাজপথে মিছিল করে ছাত্রলীগ। আগে এ কাজটা করতো ছাত্রশিবির।

এর জন্য কারা দায়ী? সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে হবে। বেশি করে খুঁজতে হবে আওয়ামী লীগকে– কেন তার আমলে এত স্পর্ধা প্রদর্শন করছে অন্ধকারের শক্তি। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির শিকার একাত্তরের স্বপ্নে গড়া বাংলাদেশ। সম্প্রীতির চারণক্ষেত্রে এখন সাম্প্রদায়িক অশান্তি আছড়ে পড়ছে নিয়মিত। সম্প্রীতির শান্ত, স্নিগ্ধ বার্তা আজ ঘৃণা আর ভয়ের কালো থাবায় দিশেহারা।

আমরা উন্নত ও আধুনিক হচ্ছি বলে দাবি করি। সত্যিই কি তাই? আসলে ক্রমশ বন্য হিংস্র জন্তু হয়ে যাচ্ছি আচরণে। মৌলবাদীদের আক্রোশে আজ সংস্কৃতির আয়োজন জেলায় জেলায় প্রায় বন্ধ। সামাজিক মাধ্যমে সব অসভ্যদের চিৎকার। ধর্মের জিগির তুলে, কাউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে গা কাঁপছে না আজ বাংলাদেশে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যেভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সারাদেশে হেফজতি তাণ্ডব হয়েছে, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে, তাতে মনে হতে পারে যে এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে স্বাধীনতা বিরোধীরাই।

এরা সহিংস, এরা হিংস্র। চারদিকে শুধু ভয়ের দেয়াল ঘিরে ফেলছে মানুষকে। শিক্ষিত বিবেকের এখন বড়ই অভাব। যুক্তি দিয়ে সমস্যাকে বোঝার মতো শিক্ষা এই মৌলবাদীদের নেই। এদের আদর্শ আফগান তালেবান।

১৯৭১-এ বাংলাদেশ নামের যে আত্মাটা ছিল তার মেরুদণ্ড এখন আর শক্তপোক্ত নেই। তবে আশার কথা যে শাসক দলের নির্লিপ্ততা সত্ত্বেও প্রতিবাদ হয় এখনও। এখনও কিছু মানুষের কাছে অন্তত স্বাধীনতার আদর্শটি নড়বড়ে হয়ে যায়নি। তবে মানতেই হবে যে পাঁচ দশক আগে দেশের প্রগতিশীল রাজনীতি শক্তি যতখানি সংগঠিতভাবে মানুষকে সচেতন ও প্রগতিমুখী করার কাজ করেছিল, সেই শক্তিতে বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে একাত্তরের পরাজিত রাজনীতি। শাসক দল ক্ষমতার মোহে অনেক খানি আপসকামী, বাম রাজনীতি বলতে গেলে একেবারে ক্ষয়িষ্ণু। এত বেশি আপস করা হয়েছে যে ভেতর থেকে মেধাশক্তি ও চিন্তাশক্তির ক্ষয় ঘটে গেছে। মৌলবাদী শক্তি রাজনীতির হাতিয়ার এখন এবং তারা রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রভাবিত করতে পারছে, তখন তা ভয়ের কারণ হতে বাধ্য।

যারা এই সত্যটা বুঝতে পারছেন তারা বিপন্নবোধ করছেন। তাই মাঝে মাঝেই মুখ খুলছেন। তারা অনেক দিন আগে থেকেই বলছিলেন, যে শক্তিতে আমাদের ঐক্যবন্ধন সেই শক্তি একবার যদি আলগা হতে শুরু করে, তবে সমূহ বিপদ। আমরা এখন সেই বিপদে আছি। নেতাদের অসতর্কতায় অশিক্ষা কুশিক্ষা ছড়াচ্ছে। মানুষের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ করছে ধর্মীয় রাজনীতি। যাদের উদার বলে জানতাম তারাও সেটা গ্রহণ করছে নিজেদের স্বার্থেই। জঘন্য কুরুচিকর ভাষায় চলে এসবের প্রচার। জঘন্য আচরণ করে এরা, যেমনটা করেছে এই পুলিশ সদস্য। এদের থামানোর উপায় কী? সহজ করে বললে, সাম্প্রদায়িকতার চরম শত্রু যথার্থ গণতন্ত্র। সেই চর্চাটা হতে পারলে পরাজিত হবে সেই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি।

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ