X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগ কেন সাংস্কৃতিকভাবে ব্যর্থ হলো

স্বদেশ রায়
২১ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৫০আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২২, ১৫:৫০

স্বদেশ রায় বৈপরীত্যের রাজনীতি

আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিকভাবে ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ বৈপরীত্যের রাজনীতি। ষাটের দশক থেকে আওয়ামী লীগ পরিপূর্ণভাবে বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল একটি রাজনৈতিক দল। যদিও সেভাবে আওয়ামী লীগ তাদের কোনও পলিটিক্যাল লিটারেচারে বিষয়টি কখনও স্পষ্ট করেনি; তারপরেও তাদের রাজনৈতিক গতিপথই স্পষ্ট করে দিয়েছিল দলটির অবস্থান। বাঙালির হাজার হাজার বছরের যে সংস্কৃতি দেশটির মানুষের নানান আচরণের সঙ্গে জড়িত– তাকে এগিয়ে নিয়ে, তার সঙ্গে আধুনিকতার যোগ ঘটিয়ে বাংলা ও বাঙালি কনসেপ্টের একটি জাতিরাষ্ট্র তারা গড়ে তুলবে, যার ভেতর এই ভূখণ্ডের সকল মানুষ তার নিজ নিজ আচরণ নিয়ে, এমনকি নতুন কোন আধুনিক আচরণ গ্রহণ করে– নিজের ইচ্ছেমতো বেড়ে উঠতে পারবে। রাষ্ট্র বা সমাজের কেউ তাতে বাধা দেবে না।

আওয়ামী লীগের অতি সাধারণ কর্মীরাও এ বিষয়টি তত্ত্বগতভাবে না বুঝলেও তারা এভাবে মোটা দাগে বুঝতেন, কেউ যদি নাটক করতো, রবীন্দ্র বা নজরুলসংগীত গাইতো, বা কেউ যদি তার মনের ইচ্ছেতে রাস্তায় বাউল গান গাইতে গাইতে নাচতো- আওয়ামী লীগের অতি সাধারণ কর্মীটিও অতি সহজে জানতো এগুলোকে করতে সাহায্য করতে হয়। বরং কেউ যদি তাদের দিকে তেড়ে আসতো তখন ওই দুর্বল সংস্কৃতি কর্মীর আগে সবল আওয়ামী লীগ কর্মী লাঠি নিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিতো। এ কারণে একজন আওয়ামী লীগ কর্মী তত্ত্বগতভাবে না বুঝলেও ব্যবহারিক জীবনে বুঝতো তাকে কী আচরণ করতে হবে। এবং দেশের কোন কাজগুলোকে সহায়তা করতে হবে। আর একটা মানুষের মানসিক চিন্তার ওপরেই তার পরিবার গড়ে ওঠে। সে কারণে আওয়ামী লীগার পরিবারগুলো সেভাবেই গড়ে উঠেছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ অনেক ঝড়ঝাপটার ভেতর দিয়েও আওয়ামী লীগ এই ধারা ধরে রেখেছিল। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ও সামাজিক একটি গোষ্ঠী বারবার একে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে।  কিন্তু আওয়ামী লীগ তার সহজ ও স্বাভাবিক আচরণ দিয়ে প্রতিহত করে বাঙালি সংস্কৃতি নির্ভর রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

আওয়ামী লীগের এই দৃঢ়তার কারণে, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে দুর্গম পথ চলেও ২০০৮ পৌঁছাতে সমর্থ হয়। ২০০৮-এর নির্বাচনে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগকে অর্থাৎ বাঙালি সংস্কৃতিনির্ভর রাজনীতিকে সমর্থন করে। তারা বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে ক্ষমতায় পাঠায়। তারা আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে শুধু বাঙালি সংস্কৃতিনির্ভর রাজনীতিকে বিজয়ী করতে নয়। পাশাপাশি তারা মনে করেছিল, বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ধর্মের নামে যে রাজনীতি বাংলাদেশকে প্রতি মুহূর্তে পিছিয়ে দিচ্ছে তারও অবসান ঘটবে। কারণ, আওয়ামী লীগের নির্বাচনি কর্মসূচিতে ছিল তারা ধর্মের নামে এই অপরাজনীতি করার মূলহোতা অর্থাৎ ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। তরুণ প্রজন্ম এ দাবি তাদের প্রাণের দাবি হিসেবে নিয়েছিল। কারণ, এই একক বিশ্বে তারা আধুনিক বাঙালি জাতিই হতে চেয়েছিল।

কিন্তু প্রথমেই তরুণ প্রজন্ম ধাক্কা খেলো যুদ্ধাপরাধীর প্রথম বিচারের রায়ে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় ‘যাবজ্জীবন’ হওয়াতে তারা বুঝতে পারলো, তাদের মূলোৎপাটন হচ্ছে না বা সরকার হয়তো নিজেকে দুর্বল মনে করছে। তরুণ প্রজন্ম একাত্তরের প্রজন্মের পথ ধরেই রাস্তায় নেমে এলো বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে। শুধু ঢাকা নয়, গোটা দেশের রাজপথ তাদের নিয়ন্ত্রণে গেলো। যা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পথ খুলে দিলো। আওয়ামী লীগের রাজনীতি মনেপ্রাণে তাদের শতভাগ সহায়ক হয়ে এগুলো বাংলাদেশে সেদিন বাঙালি সংস্কৃতির বিপ্লব ঘটানোর সব পথ উন্মুক্ত হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের সহায়তা করলেও দ্বিধাগ্রস্ত ছিল।

আর এই দ্বিধাগ্রস্ততার সুযোগ নিয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধী গোষ্ঠী হেফাজতের নাম দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কট্টর মৌলবাদী গোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ করে। ৭১-এর পরাজিত শক্তি পাকিস্তান সেদিন সরাসরি তাদের সমর্থন করে ও গোপনে সব ধরনের সহায়তা করে। যার ফলে রাজপথে নেমে আসার সুযোগ পায় হেফাজতিরা। আওয়ামী লীগের সেদিন সুযোগ ছিল তাদের রাজপথে নামতে না দিয়ে রাজপথ বাঙালি সংস্কৃতির শক্তি দিয়ে ভরে রাখা। কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য দ্বিধা সেদিন সে কাজ করতে দেয়নি। বরং সেদিন হেফাজতকে রাস্তা থেকে তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একই শক্তি প্রয়োগ করে রাস্তা থেকে তুলে দেওয়া হয় গণজাগরণ মঞ্চের নামে রাজপথে নামা সেই বাঙালি সংস্কৃতির বিপ্লব ঘটানোর মতো শক্তিকে।

শুধু তা-ই নয়, তারপরে দেখা গেলো সামরিক শাসনামলে যেমন করে দলভাঙা হয় অমনি করে ভেঙে গেলো গণজাগরণ মঞ্চ। বিজয়ী হলো হেফাজত। আর এই হেফাজত অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়ার সৃষ্ট পাকিস্তানি রাজনীতির কাছে শেষ অবধি আত্মসমর্পণ করলো আওয়ামী লীগ। যার ফলে বাঙালি সংস্কৃতির রাজনীতির সঙ্গে প্রথম সখ্য ঘটলো এই ভূমিতে ধর্মীয় উগ্রতার রাজনীতি। আর এখান থেকেই আওয়ামী লীগে বৈপরীত্যের রাজনীতি শুরু।

বৈপরীত্যের রাজনীতির ফল

বৈপরীত্যের এই রাজনীতির ফলে প্রথমেই সংকটে পড়লো আওয়ামী লীগের নিজস্ব রাজনীতি আর নিজস্ব সংগঠন। কারণ, হেফাজত কারা ছিল সে কথা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সৎ নেতা সৈয়দ আশরাফ স্পষ্ট করে বলেছিলেন। ‘ওরা রাজাকার ও’ রাজাকারের সন্তান’। এখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান ও রাজাকার ও রাজাকারের সন্তানদের সঙ্গে এক হয়ে কীভাবে তাদের রাজনীতি করবে তার কোনও দিক নিশানা তারা পেলো না। আর সত্যি অর্থে এই উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু এক জায়গাতে আসার ফলে আওয়ামী লীগের নৌকা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। কোনদিকে তার গতি, কোন পথে সে এগোবে তা আর নির্ধারণ করার কোনও পথ থাকলো না। অন্যদিকে সব সংস্কৃতির জন্যে ঘুণ পোকা হলো উগ্র ধর্মান্ধত্ব। হেফাজত অর্থাৎ এই উগ্র ধর্মান্ধত্ব। এই উগ্র ধর্মান্ধত্ব ঘুণ পোকা আওয়ামী লীগে প্রবেশ করার ফলে তার বাঙালি সংস্কৃতির মজবুত খুঁটিটি কুরে কুরে ভেতর দিয়ে খাওয়া শুরু করলো। এর ফলে আওয়ামী লীগের যে নিজস্ব ঐতিহ্যগত শক্তি তা ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলছে সংগঠনটি। আর দেশের মানুষ তো ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস দেখে ভাইরাসের চরিত্র সম্পর্কে জেনেছে। এটা প্রথমে নাকে ঢোকে, তারপরে গলায় যায়, তার পরে ফুসফুসকে শেষ করে শেষাবধি হার্ট থেকে পাকস্থলী সবই শেষ করে দেয়। ধর্মীয় এই ঘুণ পোকা আওয়ামী লীগে ঢুকে তাই শুধু তাদের রাজনীতি ও সংগঠনকে আক্রান্ত করেনি, ক্রমে ক্রমে ব্যক্তিজীবন থেকে পরিবার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে গেছে। যার ফলে পরিবারে পরিবারে যে বাঙালি সংস্কৃতি বেড়ে ওঠার জায়গা ছিল সেটা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে গেছে।

নতুন রাজনীতি দিতে না পারা

মানুষ পরিবর্তনশীল। তাই সমাজের সব উপাদানই পরিবর্তনশীল। সমাজের একটি উপাদান হিসেবে রাজনীতিও পরিবর্তনশীল। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক সমাজেই সময়ের সঙ্গে মিল রেখে রাজনীতিকে নতুন হতে হয়। বা নতুন রাজনীতি দিতে হয়। আওয়ামী লীগও তার জন্মের পর থেকে একের পর এক এভাবে নতুন রাজনীতি দিয়েছে। যার ভেতর বঙ্গবন্ধুর সময়ের রাজনৈতিক পরিবর্তনের গতি সব থেকে লক্ষণীয়। এ কাজ ব্রিটেনের লেবার পার্টি যেমন করে তেমনি কনজারভেটিভ পার্টি আমেরিকার রিপাবলিকানদেরও করতে হয়। এমনকি চায়নাও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ধসে পড়তো যদি তারা তাদের কমিউনিস্টপার্টির রাজনীতিতে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন না আনতো। কিন্তু এই ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে আপস করার ফলে গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ কোনও নতুন রাজনীতি তার দলের জন্যে ও দেশের জন্যে দিতে পারেনি। কারণ, বাঙালি সংস্কৃতির নির্ভর রাজনৈতিক দল যখন ধর্মীয় ঘুণপোকাকে আশ্রয় দেয় তখন তো তার কোনও স্বকীয়তা থাকে না। আর রাজনৈতিক দলের স্বকীয়তা ও ভূগোলের কালচারের সঙ্গে একাত্মতা না থাকলে কখনই নতুন রাজনীতি দেওয়া সম্ভব হয় না।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব

কোনও রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থেকেও যখন নতুন রাজনীতি চালু করে বা নিজের রাজনীতিকে অগ্রসরমুখী করে সে সময়ে তার দলের ভেতর রাজনৈতিক নেতাদের যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার অনেক পরীক্ষা স্বাভাবিকই সামনে এসে যায়। আর যখনই কোনও দলের নেতাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে নেতা হতে হয় তখনই কেবল ওই দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যোগ্য ও শক্তিশালী নেতারা আসে। অন্যথায় অনুগত ও অযোগ্যরা নানাভাবে স্থান নিয়ে নেয়। যেমন, বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে দলে বারবার নতুন রাজনীতি দিয়েছিলেন বলে তার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সারা দেশের বাঘগুলো দিয়েই ভরে উঠেছিল।  আর এই শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব শুধু রাজনৈতিক সংগঠনের কমিটি তৈরির জন্যে লাগে না। তাদের সম্মিলিত চেষ্টা ও মেধার ফলে রাজনীতি নতুন পথে যায়, ভুল পথকে প্রতিরোধ করে এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে রাজনৈতিক দলের ও সরকারের যে ভুল হয় সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথগুলোও তারা খুঁজে বের করে। আজ যে আওয়ামী লীগ সাংস্কৃতিকভাবে পরাজিত হয়ে গেছে, এখান থেকে বের করে আনার জন্যে সব থেকে বড় দরকার ছিল একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। যারা এখান থেকে দল ও দেশকে বের করে আনার পথ খুঁজে বের করতে পারতো। আর সত্যি অর্থে এ পথ খুঁজে বের করতেই হবে। আওয়ামী লীগ যদি এই ব্যর্থতার ভেতর দিয়ে যায় তাহলে নতুন প্রজন্মের কোন দলকে এসে কোন এক সময়ে খুঁজে বের করতে হবে। কারণ, বাঙালি সংস্কৃতি মূলত বাঙালির নিশ্বাস, একে বন্ধ করে রেখে তো বাঙালি বেশি দিন বাঁচবে না। 

ব্যবসায়ী ও ক্রোনি ক্যাপিটালিজম

হেফাজতের বাইরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বাঙালি সংস্কৃতির পরাজয়ের আরেকটি কারণ আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য ও জাতীয়তাবাদী ক্যাপিটালিজমের বদলে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের অর্থাৎ সরকারের সুবিধাভোগীদের নিয়ন্ত্রিত ক্যাপিটালিজম গড়ে ওঠা। প্রকৃত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া রাজনৈতিক দল কীভাবে দেশের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উন্নতি করবে এটা অন্য কেউ ভালো বোঝে না। এমনকি সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব তার অবস্থানে থেকে তার কাজটি ভালোমতো বোঝে কিন্তু তাকে যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়া হয় সে পারবে না রাজনীতির মাধ্যমে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে। এ কাজ কেবল প্রকৃত রাজনীতিকেরই। যেমন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোমরা যদি বাংলা পরিভাষা তৈরি না করতে পারো তবু আমি বাংলা ভাষা চালু করে দেবো। কাজের ভেতর দিয়েই পরিভাষা বের হয়ে আসবে। কিন্তু এখানে সংস্কৃতিক নেতৃত্ব হলে তিনি চালু করার আগে পরিভাষাগুলো সব তৈরির গুরুত্বটাই বেশি দিতেন। আর তাতে সময় চলে যেতো। সময় তো আর বসে থাকে না। প্রকৃত রাজনীতিকরা সময়ে গতিটা বোঝেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনকে প্রকৃতভাবে উপলব্দি করতে পারলে রাজনীতিবিদরা এটা বুঝতে পারবেন।

এখন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণীতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য থাকায় স্বাভাবিকই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ছাড়া সুফল দেয় না। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুকে ব্যবসায়ী ও আমলারা বেশি পরামর্শ দেয়াতে তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নেই ঝুঁকে ছিলেন সবকিছু বাদ দিয়ে। ওই সময়েই কিন্তু পার্লামেন্টেও বাইরের বেশ কয়েকটি বক্তৃতায় ভারতের সংবিধান প্রণেতা নেতা আম্বেদকর বলেছিলেন, নেহরু অনেক বেশি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন না হলে সমাজ অন্ধত্বের দিকে চলে যাবে। এবং সব উন্নয়ন তখন অন্ধরা নষ্ট করে ফেলবে। নেহরু পরবর্তী ভারতে আজ সেটাই দেখা যাচ্ছে। ভারত আজ ধর্মান্ধদের হাতে।

অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি জাতীয়তাবাদী দলকে সব সময়ই ন্যাশনালিস্ট বা জাতীয়তাবাদী পুঁজিপতি গড়ে তুলতে হয়। কখনই সরকারের পাশে থাকা শুধু নিজেদের সুবিধা বোঝা ও সরকারের সুযোগ নিয়ে নিজেদের ব্যবসা বড় করার এই গোষ্ঠী -অর্থনীতির ভাষায় ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট- এদেরকে গড়ে তুলতে নেই। কারণ, এই ধরনের সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী গড়লে সমাজের অধিকাংশ সম্পদ কয়েকজনের হাতে চলে যায়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে এ হুঁশিয়ারও আম্বেদকর করেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, ডেমোক্র্যাসি ইজ নট অনলি ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল বাট অলসো ডেমক্র্যাসি ইজ ইন ইক্যুয়ালিটি। অর্থাৎ গণতন্ত্র শুধু জনগণের জন্যে, জনগণের দ্বারা তৈরি সরকার নয়, গণতন্ত্রে অবশ্যই বৈষম্যহীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক বেশি বৈষম্য কখনই গণতন্ত্র নিশ্চিত করে না। এজন্য দরকার হয় জাতীয়তাবাদী পুঁজিপতি, যারা প্রকৃত জাতীয় সংস্কৃতিকে লালন করতে সহায়তা করে। এবং সমাজকে বেশি বৈষ্যমের দিকে নিয়ে যায় না। অন্যদিকে সরকারের সুবিধাবাদী এই ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা সবসময়ই ধর্মের রাজনীতিকে সমর্থন করে। কারণ, ধর্মীয় রাজনীতিতে সমাজের মুখ বন্ধ করতে সুবিধা হয় বেশি। তাতে তাদের লুটপাটেরও সুবিধা হয়। এরা কখনই সংস্কৃতি নির্ভর শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠতে দেয় না।

আমলাতন্ত্র

বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে যেহেতু কোনও সংস্কার আনা হয়নি, কোনও বিপ্লবী পরিবর্তন সেখানে স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি ঘটানো হয়নি। তাই আমলা থেকে গেছে জনগণের ‘প্রভু’র চরিত্রে। তারা নিজেদের সুবিধার বাইরে অন্য কিছু বোঝে না। আর সংস্কৃতির সম্পর্ক সবসময়ে উদার মনের সঙ্গে। আধিপত্যবাদী সংকীর্ণ মন কখনও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয় না। এ কারণে আমলা দিয়ে কোনও সাংস্কৃতিক কাজ করাতে গেলেও তার শেষ ফল দেখা যাবে ওই সব আমলা নিজেকে ওই কাজের মধ্য দিয়ে বড় করেছে। সংস্কৃতি বা ওই কাজ সঠিকভাবে হয়নি। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ও সমাজকে রাজনীতির থেকে আমলা দিয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ করেছে, যারা ফলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির বেড়ে ওঠা।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ