X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা (তৃতীয় পর্ব)

ডা. মালিহা মান্নান আহমেদ
১১ মে ২০২২, ১২:৫২আপডেট : ১৩ মে ২০২২, ১৭:৫৮

মহামারি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের সেরা কিছু দেশকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। এমন নয় যে কোনও মিরাকল ঘটেছিল কিংবা রাতারাতি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দারুণ সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছিল। ব্যাপারটা হলো, সরকার ও জনগণ জানতো যে আমাদের ব্যবস্থার কোথায় ত্রুটি আছে এবং পরিস্থিতির গভীরতা আসলে কতটুকু। স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত, আইসিটি, ওষুধ শিল্প ও নাগরিকদের সমন্বিত অংশগ্রহণ এবং সেই সঙ্গে শিল্প-কারখানা ও দুস্থদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদানের কারণেই মহামারির সঙ্গে লড়াইটা জেতা সম্ভব হয়েছে। ২০৩২ সালের মধ্যে সরকার যে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ (ইউএইচসি) অর্জনের লক্ষ্য স্থির করেছে, সেটার জন্যও চাই এমন সমন্বিত প্রচেষ্টা। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যে ব্যয় বাড়ানো, নীতিমালার সংস্কার, স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত মানবসম্পদ এবং এ সংক্রান্ত সেবার সরবরাহে অভিনবত্ব নিয়ে আসা হবে অবশ্য কর্তব্য।

পশ্চিমের দেশগুলো স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে জিডিপির ৯-১২ শতাংশ। এ খাতে বিশ্বের গড় হলো ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যয় করছে মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এরমধ্যে সরকারের ব্যয় হলো মোট খরচের ২৩ শতাংশ। এর বাইরে উন্নয়ন অংশীদাররা খরচ করছে ৭ শতাংশ ও এনজিওগুলো ৩ শতাংশ।

গত কয়েক বছরে মুদ্রাস্ফীতির বিবেচনায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকারের ব্যয় বাড়লেও মোট খরচের বিপরীতে বরাদ্দের হার ব্যাপক হারে কমেছে। 

ধারাবাহিকভাবে ব্যয় কমার পরও, বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু কিন্তু তার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বেড়েছে। পাশাপাশি কমেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং মা ও শিশু মৃত্যুর হার।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ

বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে একযোগে কাজ করছে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো। উন্নয়ন পার্টনাররা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রোগ্রামের পরিকল্পনা ও অর্থায়ন করে, যেগুলোর বেশিরভাগই সম্পন্ন করা হয় এনজিও ও সরকারের মাধ্যমে। অর্থাৎ সেবাগুলো মূলত সরবরাহ করা হয় সরকারি ও বেসরকারি খাতের মাধ্যমেই।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় (এমওএইচএফডব্লিও) হলো সরকারি ও বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই সংস্থাটিই মেডিক্যাল পেশা ও সংশ্লিষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ থেকে শুরু করে ওষুধ সরবরাহ, মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকর্মী ব্যবস্থাপনার যাবতীয় নীতিমালা ও আইন-কানুন ঠিক করে।

জাতীয় ও গ্রাম পর্যায়ের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাও (পিএইচসি) এই মন্ত্রণালয়ের অধীন। তবে শহরাঞ্চলের পিএইচসি আবার শহরের প্রশাসনিক সংস্থা যেমন—সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভার অধীনে থাকে। এই সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এছাড়া, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা এনজিওগুলো বেশিরভাগই অলাভজনক এবং এরা স্বল্প আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও প্রাথমিক সেবা প্রদানে কাজ করে।

লাভজনক সংস্থা হিসেবে বেসরকারি খাতে আছে মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। সরকারি খাতের চেয়েও বেশি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী নিয়োগ দেয় তারা।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন

আয়কর, কর ছাড়া অন্য আয়, বিদেশি ঋণ, উন্নয়ন তহবিলসহ যাবতীয় অনুদানের টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় হয়ে পৌঁছে যায় অন্য সব মন্ত্রণালয়ে, যে তালিকায় আছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়ের ৯৩ শতাংশ বহন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আবার স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বাজেটকে ভাগ করা হয় রেভিনিউ ও উন্নয়ন বাজেটে।

এরমধ্যে রেভিনিউ বাজেট হলো নির্দিষ্ট বিরতিতে যেসব ব্যয় হয়, যেমন—প্রতিষ্ঠানের চলমান খরচ, বেতন-ভাতা, ওষুধ ও মেডিক্যাল সাপ্লাই, অস্ত্রোপচারের ব্যয় ও বেড, যানবাহন ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ। এই রুটিন খরচটা নির্ভর করে মূলত শয্যা সংখ্যার ওপর; রোগ, জনসংখ্যা বা রোগীর চাহিদার ওপর নয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন তথা ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত প্রত্যেকে তাদের মেডিক্যাল সরবরাহের চাহিদাপত্র কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পাঠায়। তবে তারা কতটা বরাদ্দ পাবে না পাবে, তা ঠিক করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

উন্নয়ন বাজেটে থাকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রচারণা প্রোগ্রাম। এই উন্নয়ন বাজেটের বিপরীতে খরচ হয় না বললেই চলে। অর্থ বরাদ্দের বিষয়টিও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বাধার মুখে পড়ে। কেননা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের বাজেট বরাদ্দে এক উপ-শিরোনাম থেকে আরেক উপ-শিরোনামে বরাদ্দ আদান-প্রদান করতে পারে না।

সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অধীনে নগর স্বাস্থ্যসেবার জন্যও আলাদা বাজেট রয়েছে। এর ৯০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ আসে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে এবং মাত্র ৮ শতাংশ আসে ব্যবহারকারীর ফি এবং ওষুধ বিক্রি থেকে। এই রিসোর্সগুলো পিএইচসি সরবরাহ, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ, সুবিধাদি স্থাপন, মশা নিয়ন্ত্রণ, শিশুর টিকাদান কর্মসূচি নিশ্চিতকরণ এবং সিটি করপোরেশন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও বহির্বিভাগের রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে ব্যবহার করা হয়।

বর্তমানে ৩৩ শতাংশ জনসংখ্যা বাস করছে শহরে। ২০৩৯ সালের মধ্যে এটি ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। শহরের ফার্মেসি ও হাসপাতালগুলোই হলো স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় খরচের জায়গা। দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ শহরে বাস করে। নিম্ন বায়ুমান ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের কারণে ফুসফুসের রোগ বৃদ্ধির সঙ্গে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপও এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে, শহরাঞ্চলের মানুষদের স্বাস্থ্যে আনুমানিক মাথাপিছু ব্যয় হয়েছিল ৪,৮৬৯ টাকা, যেখানে গ্রামের বাসিন্দাদের ছিল ২,৩৪১ টাকা।

সেবার আওতা

প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং তৃতীয় স্তরের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে সরকার। এটা নির্ভর করে মূলত মানুষ কোথায় বাস করছে এবং সেখানে থেকে কমিউনিটি ক্লিনিক ও মেডিক্যাল কলেজ বা বিশেষায়িত হাসপাতাল পর্যন্ত সে পৌঁছাতে পারে কিনা সেটার ওপর।

সব নাগরিকের জন্য ইউএইচসি’র প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকার সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ এসেনশিয়াল হেলথ প্যাকেজ নীতি ও ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছে। 

সব স্তরে যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে—স্বাভাবিক প্রসব, অসংক্রামক রোগ নির্ণয়, সামাজিক ও আচরণজনিত পরিবর্তন সংক্রান্ত যোগাযোগ, টিকাদান কর্মসূচি, জন্মের আগে ও প্রসবোত্তর যত্ন, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, শিশুর বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ ও পুষ্টির পাশাপাশি তালিকাভুক্ত জরুরি ওষুধের বিনামূল্যে সরবরাহ।

এসব সরকারি সংস্থায় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায় নামমাত্র ফি’র বিনিময়ে কিংবা বিনামূল্যে। বহির্বিভাগে পরামর্শ নিতে রোগীদের দিতে হয় মাত্র ১০ টাকা ভিজিট। তালিকায় থাকা জরুরি ওষুধগুলো দেওয়া হয় বিনামূল্যে, ওয়ার্ডের বেডও পাওয়া যায় বিনামূল্যে, শেয়ার করা কক্ষ বা কেবিন পাওয়া যায় দিনে ১৫০ থেকে ৬০০ টাকায়।

সরকারি সেবাদান কেন্দ্রের আউট-অব-পকেট (ওওপি) খরচটা হয় শুধু ওষুধ বা অস্ত্রোপচারের অনুষঙ্গ কিনতে কিংবা স্টাফদের কাছ থেকে বাড়তি সেবা পেতে যদি কোনও অর্থ প্রদান করা হয়।

গত দুই দশকে অবশ্য সরকার জনগণের জন্য বিনামূল্যের ওষুধ সরবরাহ দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। পাশাপাশি যোগ্যতাসম্পন্ন স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার বিষয়ে প্রচারণা বৃদ্ধির ফলে এখন ওওপি খরচটা হচ্ছে শুধু ভর্তি-রোগীদের ক্ষেত্রে। 

সরকারি স্বাস্থ্য খাতের তুলনায় বেসরকারি খাত বরাবরই এগিয়ে গেছে ও আরও উন্নতমানের সেবাও দিচ্ছে। বেসরকারির এ খাতটা হলো প্রতিযোগিতামূলক, সেবার খরচও অনেক। এ খাতে ওষুধপত্র ও মেডিক্যাল সামগ্রীর পেছনে ওওপি খরচও তাই বেশি। সরকারি স্বাস্থ্য খাতে সেবার মান ও আওতার যে ঘাটতি থাকে, সেটা বেসরকারি খাত মিটিয়ে দিচ্ছে ঠিকই, তবে সেই অনুযায়ী খরচটাও পড়ছে বেশি। তথাপি, দুই খাতের জবাবদিহির জায়গাটা এখনও আলোচনার ঊর্ধ্বে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের মানবসম্পদ

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের মানবসম্পদ নিয়ে একটি কাঠামোগত নীতিমালার ঘাটতি আছে। প্রতিবছর ১০ হাজার ৫০০ মেডিক্যাল শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে ৩৭টি সরকারি ও ৭২টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে। প্রতিবছর সরকারি থেকে পাস করছে সাড়ে ৩ হাজার ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী। এর ওপর আছে ৩৯টি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল টিচিং ইনস্টিটিউট, একটি আর্মড ফোর্সেস, পাঁচটি আর্মি মেডিক্যাল কলেজ, ৯টি সরকারি ও ২০০টি বেসরকারি মেডিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল, ১৩টি সরকারি ও ৯৭টি বেসরকারি ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি।

বিশ্বের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে সরকারের নির্ধারিত পদসংখ্যা অপর্যাপ্ত এবং দূরবর্তী অঞ্চলে হওয়ায় ২০ শতাংশ পদ শূন্য পড়ে থাকে।

বর্তমানে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য গড়ে আছে ৫ দশমিক ২৬ জন ডাক্তার ও ৩ দশমিক শূন্য ৬ জন নার্স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুসারে ডাক্তার-নার্স-মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের অনুপাতটা হলো ১:৩:৫। সেখানে বাংলাদেশের অনুপাত হলো ১:০.৪:০.২৪।

দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট তো আছেই, সেইসঙ্গে তাদের বিন্যাসেও আছে অসামঞ্জস্যতা। তাদের বেশিরভাগের শহরাঞ্চলে থাকার প্রবণতার কারণে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা খাতে বেশি চাপ পড়ে, দেখা দেয় কর্মী সংকট ও যন্ত্রপাতিও থাকে অপর্যাপ্ত।

বেশিরভাগ ডাক্তারের মাঝেই দেখা যায় স্পেশালিস্ট হওয়ার পর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার প্রবণতা। সরকারি সংস্থায় ডাক্তারদের ধরে রাখতে সরকারকে আরও পদ তৈরি করতে হবে, তাদের পরিবারের জন্য ওষুধসহ আরও কিছু চাহিদাভিত্তিক সুবিধাও তৈরি করতে হবে। একটি সহজ ও স্বচ্ছ কৌশল গ্রহণ করলেই ডাক্তাররা তাদের পেশাটিকে আরও বুদ্ধিমানের মতো গুছিয়ে নিতে উৎসাহ পাবে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যখন পর্যাপ্ত দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করবেন তখনই কেবল ইউএইচসি অর্জন করা সম্ভব। তাই সেবা প্রদানের সংস্কার কার্যক্রমে যেকোনও নীতি সংক্রান্ত উদ্যোগে মানবসম্পদকেই প্রাধান্য দিতে হবে।

চিকিৎসা অন্বেষণ সংক্রান্ত আচরণ

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষিতদের মাঝেই চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খোঁজার মনোভাব থাকে। টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা, হাত ধোয়া এবং স্যানিটারি অনুশীলন ইত্যাদি বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রচারাভিযানগুলো প্রায়শই সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই পরিচালিত হয়। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সংস্কৃতি আমাদের মাঝে নেই। এটি থাকলে আরও সচেতন নাগরিক তৈরি হতো।

অনেক সময় ডাক্তার বা নার্সের অনুপস্থিতি, তাদের আচরণ বা অপেক্ষার সময় কিংবা সরকারি সেবাকেন্দ্রে ভ্রমণের ঝক্কি এড়াতে স্ব-চিকিৎসার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অনেকের মাঝে। দুই-একটি ছাড়া বেশিরভাগ ওষুধই স্থানীয় ফার্মেসিতে পাওয়া যায় এবং এগুলো প্রেসক্রিপশন-ড্রাগের মতো অতটা নিয়ন্ত্রিতও নয়। তাই, ফার্মেসিগুলো যেহেতু হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে এবং কেউ কেউ যেখানে ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ দেওয়া থেকে শুরু করে ব্লাডপ্রেসার মাপা কিংবা সুগার মাপার সেবাও দিচ্ছে, তাই অনেকেই সময় বাঁচাতে আর ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। আইন অনুযায়ী সরকার কিন্তু প্রবিধান আরোপ করে ওই সেবা প্রদানকারীদের আনুষ্ঠানিক সেবাদাতা বানিয়ে পিএইচসির ব্যাপ্তি আরও বাড়াতে পারে।  

ওষুধ নীতি

বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে ব্যাপ্তি বিশাল। বেশিরভাগ ওষুধ তৈরি হচ্ছে বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্যাটেন্ট কেনার মাধ্যমে। দেশের ওষুধ চাহিদার ৯৮ শতাংশই মেটাচ্ছে এই শিল্প। ১৯৮২ সালে চালু হওয়া জাতীয় ওষুধ নীতিতে যথাসম্ভব কম দামে মানসম্পন্ন জরুরি ওষুধ উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে, ১১৭টি তালিকাভুক্ত জরুরি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এর বাইরে থাকা ‘জরুরি নয়’ এমন ওষুধগুলোর জন্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো নিজেরাই একটি ‘সূচক মূল্য’ ঠিক করে দেয়, যার সঙ্গে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে। এতে আবার ওষুধগুলোর দামও বেড়ে যায়।

স্বাস্থ্য-বিমা

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার অর্থের জোগান দিতে স্বাস্থ্য-বিমা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধু কর্মজীবী লোকদের জন্য কিছু বিক্ষিপ্ত নীতিমালা আছে। এরমধ্যে চলমান কিছু স্কিম হলো—সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগকর্তাদের তত্ত্বাবধানে চালু থাকা স্কিম, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কারাবন্দিদের স্বাস্থ্যসেবা এবং সব সরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী, রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বন্দর ও কারখানার কর্মীদের জন্য সরকারি স্কিম।

আইসিডিডিআর,বি, ব্র্যাক, গ্রামীণফোনের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের আংশিক স্বাস্থ্য-বিমা দেয়। বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো নিয়োগকর্তাদের কাছে বিদেশ ভ্রমণের জন্য মেডিক্লেম পলিসি, গ্রুপ হেলথ প্ল্যান বিক্রি করে। ব্যক্তিবিশেষে তারা আবার সাধারণ পলিসিও বিক্রি করে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, গ্রামীণ কল্যাণ, ব্র্যাক, সাজিদা ফাউন্ডেশন, শক্তি এবং আরও কিছু এনজিও তাদের ক্লায়েন্টদের স্বাস্থ্য-বিমা সেবা প্রদান করে।

বাণিজ্যিক ব্যাংক, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি এবং কনসোর্টিয়ামগুলো করপোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) হিসেবে একটি তহবিল আলাদা করে রাখে। যা সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হয়।

একটি সুলভ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সরঞ্জামগুলো কী কী?

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা (পিএইচসি)

ইউএইচসির উন্নয়নের মূল উপযোগিতাটি মূলত সরকারি ব্যয় বাড়ানোর মাধ্যমে ওওপি খরচ কমিয়ে সামাজিক সুরক্ষা স্কিম সরবরাহের মধ্যেই অন্তর্নিহিত। এই খরচের সেরা ব্যবহারটা হলো পিএইচসিতে ব্যয় করা। এ কাজে পিএইচসি যখন প্রাথমিক গেটকিপারের ভূমিকা রাখবে, তখন সেবার সমান বিতরণ নিশ্চিত হবে। তখন হাসপাতাল কিংবা বিশেষজ্ঞ যত্নের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারও হ্রাস পাবে, জনগণের সুস্বাস্থ্যও বজায় থাকবে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও ইউরোপের দেশগুলো দশকের পর দশক ধরে পিএইচসি ব্যবস্থাকে মজবুত করেছে।

একটি সুপরিসর পিএইচসি-ই পারবে স্বাস্থ্য খাতে করের টাকার যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে। এতে স্বচ্ছতা তৈরি হবে এবং জনসমর্থনও বাড়বে। 

উন্নত স্বাস্থ্যসেবার উপলব্ধি থেকে তৈরি হবে জনসমর্থন, যা থেকে তৈরি করা যাবে একটি স্থায়ী নীতি। নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, পর্যাপ্ত খাবার, দূষণমুক্ত পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও সচেতনতা নিশ্চিত করার জন্য ইন্টার-সেকটোরাল তথা আন্তক্ষেত্রীয় অংশগ্রহণও পিএইচসির সম্প্রসারিত রূপ।

স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা

একটি সমন্বিত, নিরাপদ, কর্মতৎপর ও সহজে পরিবর্ধনযোগ্য স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থাই হলো যেকোনও আধুনিক স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে এটি এবং নজরদারির বাহক হিসেবেও কাজ করে। এখানে যে তথ্য সংগ্রহণ ও সংরক্ষণ করা হয় তা কৌশলগত নির্দেশনার পথ দেখায়। এটা ব্যয়বহুল হলেও রোগ শনাক্তকরণ, সিস্টেমের মধ্যে কোনও গ্যাপ থাকলে সেটা শনাক্ত করা, সম্পদের পরিকল্পনা, বিভিন্ন পরিষেবা ও সেবা প্রদানকারীর জবাবদিহি এবং চলমান প্রবণতা বিশ্লেষণ করে ইনস্টিটিউশনের সক্ষমতা গড়ে তুলতে এটি বেশ অগ্রগতিমূলক ভূমিকা রাখে।

ডিজিটাল আবিষ্কারগুলো ব্যবহার করে স্বাস্থ্য খাতে এক লাফে বহুদূর এগুনোর মতো যথার্থ ভিত্তি তৈরিই আছে বাংলাদেশের জন্য।

হাসপাতালগুলোর অ্যাক্রিডিটেশন

স্বাস্থ্যসেবার পরিষেবাগুলোর আদর্শমান ও আধুনিকতার নির্দেশক হলো হেলথকেয়ার অ্যাক্রিডিটেশন। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর জন্য এখনও আইনি বাধ্যবাধকতা হয়নি। তবে যে দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার খরচ তৃতীয় কোনও পক্ষকে দিতে হয়, সেখানে অনুমোদিত সংস্থা থেকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে জবাবদিহির খাতিরে স্বীকৃতি পেতে হয়।

এশিয়ার জন্য জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল (জেসিআই) একটি নামকরা অ্যাক্রিডিটেশন সংস্থা। ভারতে জেসিআই’র স্বীকৃতি পাওয়া হাসপাতাল আছে ৩৬টি। বাংলাদেশে আছে মাত্র একটি। কোনও প্রতিষ্ঠানের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন হলো নিজেদের সেবার মানকে ক্রমাগত উন্নত করার এক ধরনের অঙ্গীকার।

ইউএইচসি অর্জনের অনুষঙ্গ দুটো কী কী?

বাংলাদেশে ইউএইচসির উন্নয়নে সামাজিক সুরক্ষা স্কিমের এমন একটি ধরন বাস্তবায়ন করতে হবে যা পিএইচসি’র প্রসারে কাজ করবে। যেহেতু বেশিরভাগ নাগরিক অ-প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্মে জড়িত, তাই এই ব্যবস্থার ডিজাইন করাটা কঠিন কাজই হবে। ভালো হবে, যদি ইতোমধ্যে চালু থাকা স্কিমগুলোকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। জনগণের সঞ্চয় থেকে এরইমধ্যে সিএসআর-এর পুল ফান্ড, জাকাত তহবিল ও আবগারি শুল্ক নেওয়া হয়েছে।

সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে শুধু নীতি গ্রহণ করলেই হবে না। অবশ্যই কৌশল এবং সেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতিও থাকতে হবে। জরুরি প্রাথমিক স্বাস্থসেবা-পিএইচসি দ্বারা শক্তিশালী যেকোনও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় জনসাধারণের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি থাকবে। কারণ, এটি স্বল্প খরচের একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগীর জীবনকে আরও উন্নত করে।

লেখক: অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপে স্নাতকোত্তর।

প্রথম পর্ব:  ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ও হেলথ সিস্টেম

দ্বিতীয় পর্ব:  ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ: উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

/এফএ/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিলিয়ান-গ্রানাডিয়ানের গোলে আবাহনীর দারুণ জয়
পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিলিয়ান-গ্রানাডিয়ানের গোলে আবাহনীর দারুণ জয়
শিশু হাসপাতালে আগুন: পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
শিশু হাসপাতালে আগুন: পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত
অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ