X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

পি কে’র পেছনে কে?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৮ মে ২০২২, ১৭:০২আপডেট : ১৮ মে ২০২২, ১৭:৩৪

বেশ বড় একটা সময় ধরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা সাধারণ মানুষের টাকায় একটা মানুষের সাম্রাজ্য ফুলেফেঁপে ওঠা এবং তার বেআইনি কাজ কারবার রমরমিয়ে চলতে থাকা সত্ত্বেও তা কেন কোনও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের চোখে পড়লো না? এমন একটা প্রশ্ন সর্বত্র, কিন্তু জানি এর উত্তর সহজে পাওয়া যাবে না, কারণ এখানে যাদের নজরদারি করার কথা তাদের জবাবদিহি নেই কোথাও। লোকটা দোর্দণ্ড প্রতাপে আর্থিক খাতকে উলটপালট করেছে এবং সেটা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চোখের সামনেই। গণমাধ্যমে খবর আসার পর দুদকের টনক নড়ে এবং রেড অ্যালার্ট জারির আগেই তিনি হাওয়া হয়ে গেলেন। তিনি দেশের বাইরে চলে গেলেন বা তাকে নিরাপদে চলে যেতে দেওয়া হয়েছে।

বলছিলাম পি কে হালদারের কথা। বাংলাদেশ থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচারের দায়ে অভিযুক্ত এই প্রশান্ত কুমার হালদার, যিনি পি কে হালদার নামে বেশি পরিচিত, তার পাঁচ সহযোগীসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন। বিষয়টাকে দু’ভাবে দেখা যায়, যেমন- একটা ব্যাংক দখলদার, আর্থিক খাতের দুর্বৃত্ত শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছে। কিন্তু চিন্তার বিষয় এই যে অপরাধীকে নিজের দেশে ধরা গেলো না এবং এটার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে বড় চোরেরা পালিয়ে যেতে সক্ষম।

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদার ২০১৯ সালে ভারতে পালিয়ে যান এবং পরে সেখান থেকে কানাডায়। ভারত ও কানাডা দুই দেশেই তাঁর প্রচুর সম্পদ আছে। ভারতে গিয়ে পি কে হালদার নিজের পরিচয় গোপন করে শিবশঙ্কর হালদার নামে দেশটির পরিচয়পত্র, নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র, আয়কর দফতরের পরিচয়পত্র, আধার কার্ড ইত্যাদি সংগ্রহ করে সেখানে বাড়ি কেনেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য করেন।

গত শনিবার ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগরে অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করে। অভিযোগের মধ্যে আছে, ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ ও বসবাস, বেনামে সম্পত্তি কেনা, আইনবহির্ভূতভাবে অর্থ বাংলাদেশ থেকে ভারতে আনা।  

বোঝাই যাচ্ছে তার পেছনে বড় একটি শক্তিশালী চক্র রয়েছে, যারা তাকে সর্বোচ্চ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে গেছে এসব অপকর্ম করে যেতে।  বলা হচ্ছে, অনিয়ম-দুর্নীতি ও হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের নেপথ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের প্রভাবশালীদের হাত রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক খাতে তার দুর্দান্ত প্রতাপ ও একচ্ছত্র ক্ষমতার উৎস ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় তিন কর্মকর্তা। নিজের দুর্নীতির রাস্তা সহজ করে রাখতে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্তাদের মাসিক বেতন দিতেন বলেও জনশ্রুতি আছে। পি কে হালদারের অবিশ্বাস্য জালিয়াতিতে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নাম আসে বেসরকারি খাতের প্রভাবশালী এক ব্যক্তির। সহযোগী হিসেবে নাম আসছে আরও অনেকের। এরা সবাই ক্ষমতাধর, প্রভাবশালী। এদের কারণেই পি কে হালদার নিজের এক অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।

আরেকটি বিষয় অবশ্যই ভাববার আছে। এই পি কে হালদার যে শুধু কতিপয় ক্ষমতাবানের আশীর্বাদেই দুর্নীতির এ রকম মহীরুহ বনে গেছেন তা নয়, এর পেছনে আমাদের আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির ভয়াবহ অন্ধকার দিকটিও বিবেচনার দাবি রাখে। পি কে হালদার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন নামে কোম্পানি খুলে ঋণ নিয়েছেন, এসব কোম্পানির প্রায় সবই প্যাডসর্বস্ব। কীভাবে এত বেনামি ঋণ নেওয়া সম্ভব? শেয়ার বাজারে দাপটে বেড়ানো যায়? কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা কেলেঙ্কারি করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া যায়? দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ব্যর্থতা শিকার করতে হবে। দায়িত্বশীল এত সংস্থার চোখে ধুলো দিয়ে এত অপকর্ম করার অর্থ হলো আমাদের আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব আছে।

সবচেয়ে বেশি ভূমিকা প্রত্যাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। আর্থিক খাতের নজরদারি সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ভূমিকা— তাতে খামতির একটি উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত পি কে হালদার। প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ঠিক কতখানি, বহু ক্ষেত্রেই তা বুঝতে অনেক বিলম্ব হয়ে যায়। শুধু পি কে হালদার নয়, এই নজরদারির কাজে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা দীর্ঘমেয়াদি। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নামক অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির তেমন পরিণতি কারও কাম্য হতে পারে না। কিন্তু আমরা সেটাই দেখছি বারবার। তার স্বায়ত্তশাসন তো দূরের কথা, অনেক বছর ধরে এটি যেন সরকারের অধীন একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছে। তাতে ব্যাংকের প্রতি ভরসা কমছে। বাংলাদেশ ব‍্যাংকের নিজের টাকা হ‍্যাকিংয়ের মাধ্যমে লোপাট হয়েছে। এটি তার দক্ষতা ও সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।  সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ফার্মার্স ব‍্যাংক  ও বেসিক ব‍্যাংক লোপাট হওয়া, পিপলস লিজিং, ইন্টারন‍্যাশনাল লিজিংসহ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা উধাও হওয়ার ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাঙ্ক্ষিত কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি।

পি কে’র পেছনের মানুষদের সম্পর্কে জানতে, ভবিষ্যতের সব লুটপাট ঠেকাতে এই ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা অবশ্য কর্তব্য। তাই এখনকার বড় কাজ হলো তাকে তার  সহযোগীদেরসহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তি আছে, ফলে কাজটি কঠিন হওয়ার কথা নয় যদি আন্তরিকতা থাকে। এরকম পি কে হালদার আর সৃষ্টি না হোক।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগপিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
রাজস্থানকে হারিয়ে প্লে অফের আশা বাঁচিয়ে রাখলো দিল্লি
রাজস্থানকে হারিয়ে প্লে অফের আশা বাঁচিয়ে রাখলো দিল্লি
ঢাকা আসছেন মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু
ঢাকা আসছেন মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ