X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

উড়ন্ত ভ্লাদিমির পুতিন নামছেন মাটিতে

ডা. জাহেদ উর রহমান
২১ মে ২০২২, ১৮:৪০আপডেট : ২২ মে ২০২২, ১৯:১৪

ইউক্রেন আগ্রাসনের শুরুতে নিজ দেশ, বেলারুশ এবং কৃষ্ণ সাগর এই তিন দিক থেকে ইউক্রেনের ওপরে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেন পুতিন। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ফায়ার পাওয়ার দেখে অনেকেই ভড়কে গিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, খুব দ্রুত সময়ে ইউক্রেনকে পদানত করার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন পুতিন। 

ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন তাদের আত্মরক্ষার জন্য ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার কথা জোর দিয়ে প্রকাশ্যে আনে। ন্যাটোতে যোগদানের আলোচনা এই দুই দেশে আগেও ছিল কিন্তু ইউক্রেন আগ্রাসনের পর সেটার পালে অনেক বেশি হাওয়া পায়। যুদ্ধের আগেই দুই দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী ন্যাটোতে যোগদানের পক্ষে ছিল, কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পরে ন্যাটোতে যোগদান প্রশ্নে দুটি দেশের জনমত আরও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। অথচ এই দেশ দুটি এমনকি স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও ন্যাটো বা ওয়ারশ কোনও সামরিক জোটে যোগ না দিয়ে নিরপেক্ষ থেকেছিল।

ইউক্রেন আগ্রাসনের প্রথম দিকে পুতিন প্রচণ্ড আক্রমণাত্মকভাবে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ন্যাটোতে যোগ দেওয়া যাবে না। হুমকি দিয়েছিলেন, যোগ দিলেই সামরিক পদক্ষেপ নেবেন তিনি। তিনি হয়তো আশা করেছিলেন, ইউক্রেনের ওপরে সর্বাত্মক আক্রমণ দেখে ওই দুটি দেশ ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসবে।

এখন আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি, অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখল করে সেখানে নিজের একজন ‘পুতুল’ বসিয়ে দেওয়ার পুতিনের পরিকল্পনা সফল হয়নি। রাশিয়ান বাহিনী সরে গেছে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ থেকেও। দনবাসের পুরো এলাকার নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবেন কিনা, অনিশ্চিত সেটাও। সাফল্য বলতে মারিওপোল দখল করতে পারা। 

ইউক্রেন আক্রমণ করার আপাত যে কারণ বলা হয়েছিল, ইউক্রেনের ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তকরণ ঠেকিয়ে নিজের সীমানা থেকে ন্যাটোকে দূরে রাখার চিন্তা, সেটাও এগোচ্ছে না ঠিক পথে। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন শুরুর আগেই ন্যাটো সদস্য তিন বাল্টিক দেশেরই সীমান্ত ছিল রাশিয়ার সঙ্গে। এরমধ্যে এস্তোনিয়া ও লাটভিয়ার আছে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আর লিথুয়ানিয়ার আছে রাশিয়ার ছিটমহল কালিনিন গ্রাদের সঙ্গে। তবু পুতিন সমর্থকরা বলছিলেন, ওই তিন দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের দৈর্ঘ্যের তুলনায় ইউক্রেনের সীমান্তের দৈর্ঘ্য অনেক বেশি।  

আমরা এখন দেখছি, আলোচিত দেশ দুটি যোগ দিলে ফিনল্যান্ডের সঙ্গে রাশিয়ার ১৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত যুক্ত করলে ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের দৈর্ঘ্য বর্তমানের দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাবে। ন্যাটোর সম্প্রসারণ রোধ করার অজুহাতে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করে ন্যাটো দেশের সংখ্যা যেমন বাড়াচ্ছেন, তেমনি বাড়াচ্ছেন ন্যাটোর সঙ্গে নিজ দেশের সীমানা। 

এই প্রেক্ষাপটে পুতিন আবারও কথা বলেছেন। রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোট আছে, যার নাম কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিএসটিও)। রাশিয়ার সঙ্গে এই জোটের সদস্য হচ্ছে বেলারুশ, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান। কয়েক দিন আগে মস্কোতে এই সংস্থার সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় পুতিন বলেন, ‘সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে ন্যাটোর বিস্তার রাশিয়ার জন্য সরাসরি হুমকি নয়। তবে এই অঞ্চলে সামরিক স্থাপনার বিস্তার ঘটালে তা অবশ্যই আমাদের প্রতিক্রিয়া উসকে দেবে’। তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটি নির্ভর করবে তারা কী ধরনের হুমকি তৈরি করে তার ওপর।’ 

এই দুই দেশের ন্যাটোতে যোগদানের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার পক্ষ থেকে বাল্টিক অঞ্চলে পারমাণবিক বোমা এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এই হুমকিকে দেশগুলো খুব একটা পাত্তা দেবে বলে মনে হয় না। কারণ, বাল্টিক অঞ্চলে রাশিয়ার ছিটমহল কালিনিনগ্রাদে এখনই পারমাণবিক বোমা মোতায়েন করা আছে, এটা প্রায় নিশ্চিত।

সুইডেন-ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিলেই সামরিকসহ সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া পুতিন এখন পর্যন্ত বাস্তব যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটা হলো ফিনল্যান্ডে বিদ্যুৎ রফতানি বন্ধ করেছেন। এতে অবশ্য দেশটির কিছু আসে যায় না। কারণ, তাদের মোট চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে রাশিয়া। হুমকির ক্ষেত্রেও এখন গলার স্বর নামিয়েছেন। তিনি এখন প্রকাশ্যে বলছেন, দেশ দুটির ন্যাটোতে যোগ দেওয়ায় আপত্তি নেই তার। দেশ দুটিতে ন্যাটোর সামরিক স্থাপনার বিস্তার ঘটালে...।

একটা দেশ ন্যাটোতে যোগ দেবে কিন্তু সেখানে ন্যাটোর সামরিক স্থাপনা হবে না, সেটা আশা করা একেবারেই হাস্যকর। যেহেতু ন্যাটোর আর্টিক্যাল ৫ অনুযায়ী যেকোনও একটি সদস্য রাষ্ট্রের ওপরে হামলা সব সদস্যের ওপর হামলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাই প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও সম্মিলিতভাবেই প্রাথমিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। অর্থাৎ ওই দুই দেশ ন্যাটো সদস্য হতে পারলে সেখানে ন্যাটোর সামরিক স্থাপনা হবেই। আসলে পুতিন সর্বশেষ যা বলেছেন, সেটা আসলে মুখ রক্ষার একটা চেষ্টা মাত্র। ফিনল্যান্ড বা সুইডেনে ন্যাটোর সামরিক স্থাপনা হলেও কিছুই করার নেই তার। ইউক্রেনের মাটিতে একেবারে ভিন্ন বাস্তবতা দেখা পুতিন আবার আরেকটি দেশে আগ্রাসন চালানোর মতো অবস্থায় নেই আর, এটা নিশ্চিত।

নিজের জন্য এই পরিস্থিতি পুতিন নিজেই তৈরি করেছেন। আসলে প্রতিটি স্বৈরশাসককেই ফ্যান্টাসির জগতে বাস করতে হয়। স্বৈরশাসকেরা যেহেতু চরিত্রগতভাবে তাদের চিন্তার বাইরের কথা পছন্দ করেন না, তাই চিরকালীন চাহিদা-জোগান তত্ত্ব মেনে তার চাহিদার ভিত্তিতেই চারপাশে আসতে থাকে সেসব তথ্য, যেসব তিনি পছন্দ করেন; এমনকি যদি সেগুলো ডাহা মিথ্যা কথাও হয়। তাদের চারপাশ ঘিরে থাকে, তাদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন এমন সব মানুষ, যারা তাদের পছন্দ মতো তথ্য, বিশ্লেষণ হাজির করতে পারেন।

অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন আগ্রাসনের আগে কোনও জেনারেলের মাথায় কোনও অপ্রিয় সম্ভাবনার কথা থাকলেও সেটা তিনি পুতিনকে বলেননি। তাই যখন ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর সরবরাহ করা কিছু হালকা অস্ত্রের সামনেই নাকানিচুবানি খেলো ‘পরাক্রমশালী’ রুশ সেনাবাহিনী, তখন সেই পরিস্থিতি নিশ্চয়ই ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ হয়েছে পুতিনের জন্য। তবে বিনা মেঘে হলেও তার ক্ষেত্রে বজ্রপাতটি তো সত্য। 

জর্জিয়া ন্যাটো সদস্য হতে চাওয়ার ‘অপরাধে’ ২০০৮ সালে পুতিন জর্জিয়াতে আক্রমণ করেন এবং কার্যত দখল করেন জর্জিয়ার অংশ দক্ষিণ ওসেটিয়া আর আবখাজিয়া। যে জর্জিয়ার ন্যাটো সদস্য হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে এই দুর্যোগ, সেই যুদ্ধে জড়ানো দূরে থাকুক ন্যাটো জর্জিয়াকে অস্ত্র সাহায্যও দেয়নি। একতরফা জিতে যান পুতিন। এরপর ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নিলেন। ডনবাসের রুশ ভাষাভাষীদের উসকে দিয়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া, এমনকি সেখানে বেসামরিক পোশাকে রাশিয়ান সৈন্য ঢুকিয়ে দেওয়ার পরও তেমন কিছু হয়নি নামকাওয়াস্তে কিছু অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ ছাড়া। 

এরপর তো অবিশ্বাস্যভাবে ইউরোপিয়ানরা (ফ্রান্স, জার্মানি) ইউক্রেনের জন্য চরম অবমাননাকর মিনস্ক চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে। এরমধ্যে সিরিয়ায় সরাসরি সামরিক অভিযান চালিয়ে পশ্চিমাদের স্বার্থের বিপরীতে বাশার আল আসাদের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করেছিলেন। সবকিছুর পরও ইউরোপ রাশিয়া থেকে তেল গ্যাস কিনে যাচ্ছিল আগের মতো করেই। সঙ্গে দীর্ঘ সময় তেল-গ্যাসের অতি উচ্চমূল্য পুতিন আর তার অলিগাদের ব্যাংক ব্যালেন্সকে নিয়ে যাচ্ছিল অকল্পনীয় উচ্চতায়।

সবকিছু মিলিয়ে আক্ষরিক অর্থেই আকাশে উড়ছিলেন পুতিন। সেই আকাশে ওড়া চলছিল ইউক্রেন আক্রমণের শুরুর দিনগুলোতেও। এবার মুদ্রার অপর দিক দেখছেন পুতিন। তিনি মাটিতে নেমে আসছেন ক্রমশ। ফিনল্যান্ড আর সুইডেনের ন্যাটো জোটে যোগদান নিয়ে আক্রমণের হুমকি থেকে পিছিয়ে আসা এবং যোগদানকে মেনে নেওয়া সেটারই এক দারুণ বহিঃপ্রকাশ।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
এফএ কাপে হাল্যান্ডকে নিয়ে সংশয়ে সিটি
এফএ কাপে হাল্যান্ডকে নিয়ে সংশয়ে সিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ