X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাতের পথ হোক নিরাপদ, স্বস্তির

রাজন ভট্টাচার্য
১২ আগস্ট ২০২২, ১৯:২০আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২২, ১৯:২০
গভীর রাতে অস্ত্রের মুখে চালককে জিম্মি করার পর আলো নিভিয়ে অন্ধকার বাসে তিনঘণ্টা জুড়ে নারকীয় তাণ্ডব চালালো সশস্ত্র ডাকাত দল। যাত্রীদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। অথচ কেউ প্রতিবাদ করেননি। নিজের সবকিছু নীরবে ডাকাতদের হাতে তুলে দিলেন!

সভ্য সমাজে এ ধরনের বর্বরতা দেখে কারও সহ্য হওয়ার কথা নয়। তাই তো সাহস নিয়ে প্রতিবাদে এগিয়ে গেলেন এক পোশাককর্মী তরুণী বাসযাত্রী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, প্রতিবাদী এই তরুণী ডাকাত দলের উদ্দেশে বলতে থাকেন– ‘আপনাদের ঘরে কি ভাইবোন নেই। এগুলা শুরু করেছেন। সবগুলা জেলে যাবি। কপালে বড় বিপদ আছে...’।

তরুণীকে প্রতিবাদী হতে দেখে শেষ পর্যন্ত পাশবিকতাকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয় ডাকাতরা। বাসের মধ্যে অন্য যাত্রীদের সামনে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হতে হয় তাকে। গত চার আগস্ট ভোর-রাতে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে আসা ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনটি টাঙ্গাইল মহাসড়কে এলে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

টাঙ্গাইলে এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও একই ঘটলো গাজীপুরে। স্বামীকে মারধর করে মধ্যরাতে বাস থেকে নামিয়ে স্ত্রীকে পাশবিক নির্যাতন করলো একদল দুর্বৃত্ত।

রাতের পথে নারীদের একা চলা ঝুঁকিপূর্ণ। এখন তো স্বামীর সঙ্গে থেকেও নিরাপত্তা নেই। বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগের। এসব ঘটনা সবার জন্য উৎকণ্ঠার, চিন্তার। তাহলে সমাজ এ কোন অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে?

একের পর এসব ঘটনার পর সড়ক-মহাসড়কে যাত্রী নিরাপত্তার প্রশ্নে কয়েকটি বিষয় আবারও সামনে এলো। প্রথম হলো রাতে অরক্ষিত সড়কপথ। মহাসড়ক ডাকাতমুক্ত করার পাশাপাশি রাতে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আরও বেশি সচেতন হওয়া।

সেই সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশ যথাযথ কাজ করছে কিনা? তেমনি বাস ছাড়ার আগে যাত্রীদের ভিডিও ধারণ করে রাখার কথা থাকলেও কেন তা বন্ধ হলো? রাতের যাত্রায় মহাসড়কে যাত্রী না ওঠানো আনুষ্ঠানিক নিষিদ্ধ করা যায় কিনা? ডাকাতি থেকে শুরু করে নানা অঘটনের মধ্যে মহাসড়কে যদি বারবার বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হয় তাহলে বিপদ কীভাবে এড়ানো যাবে?

দিনের আলোতে বাসে কোনও নারী কী পাশবিকতার শিকার হননি? সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটলেও এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। প্রতিরোধে যে দু’একটি বিষয় আলোচনায় এসেছে এর ঢেউ দেশজুড়ে লাগেনি। ফলে সংকট যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। যা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।

একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকবে, আমরা সবাই নির্বিকার হয়ে বসে থাকবো? এর কোনও বিহিত নেই? নারীরা নিরাপদে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে ভয় পাবেন; এটা তো হতে পারে না। গোটা বিশ্বে যখন নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে নারীদের বাসে যাত্রী হতে ভয় পেতে হবে? এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্রীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করলে পুলিশি সহযোগিতা থেকে শুরু করে তিনটি সেবা মিলে; তখন এ ধরনের ঘটনা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে এটাই স্বাভাবিক।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা থেকে শুরু করে সমাজের সব সেক্টরে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। রাষ্ট্র নারীদের এগিয়ে নিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে রাষ্ট্রে কেন তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না? তবে নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি রাষ্ট্রের একার দায়িত্ব নয়, সবার। সামাজিক এই সমস্যা সমাধান করতে পুরুষশাসিত মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। সেইসঙ্গে পর্নোগ্রাফি বন্ধসহ অবাধ তথ্য প্রবাহের কুফল রোধে চিন্তা করা প্রয়োজন।  

নারীরা যে এগিয়ে যাচ্ছে এর বড় প্রমাণ হলো চার আগস্ট ঘটনার আগে পাশবিকতার শিকার হওয়া নারীর দৃঢ়চেতা মনোভাব। পুরুষদের আগে তিনি ডাকাতদের বিরুদ্ধে বাসে প্রতিবাদ করেছেন। এ কাজটি করে তিনি প্রমাণ করলেন সমাজে নারী-পুরুষ বলে কোনও ভেদাভেদ নেই। কর্মে ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিক থেকে সবাই সমান।

ঘটনার পর প্রতিবাদী নারী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ জানোয়ারদের বিচার চাই। ওদের কঠোর শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, শাস্তির জন্য যেখানে সাক্ষ্য দেওয়া দরকার সেখানে যেতে রাজি আছি। যেখানেই থাকি নিজের টাকা খরচ করে হলেও সাক্ষ্য দিতে যাবো। আর কেউ যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার না হয়’।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দুটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অনেককেই গ্রেফতার করেছে। অপরাধী চক্র পুলিশের কাছে অপরাধ শিকার করেছে।

কথা হলো, পাশবিকতার শিকার নারীরা শেষ পর্যন্ত বিচার পাবে কিনা? পরিবহন সেক্টরের প্রভাবশালীদের চাপে অপরাধীদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয় তবে তা হবে পুরো জাতির জন্য লজ্জার, তেমনি নির্যাতিত নারী আরও বেশি মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন। এতে আগামী দিনে অপরাধীরা আরও বেশি সাহস পাবে। নারীরা প্রতিবাদে বা ভালো কাজে এগিয়ে আসবেন না।

দুর্ঘটনার ঝুঁকি ছাড়া সড়কে চলাচলে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে এতদিন কারও মধ্যে ভয় কাজ করতো না। ভাড়ায় অন্য কোনও গাড়িতে ওঠার চেয়ে নিরাপত্তার কথা ভেবেই সাধারণ মানুষ বাসে চড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে গণপরিবহনে ডাকাতি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে গণপরিবহন। পথের বেশিরভাগ ঘটনায় দেখা গেছে, পরিবহন শ্রমিকরাই ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত।

গত ২৪ জুলাই রাজধানীতে এক নারী শিক্ষার্থী বাসে যৌন নিপীড়নের শিকার হন। বাস থেকে লাফিয়ে নিপীড়কের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেন তিনি। একই ধরনের ঘটনা ঘটছে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্য মহানগরেও। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে গণপরিবহনে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৬ জন নারী। ঘটনার শিকার বেশিরভাগই গৃহবধূ ও কারখানার শ্রমিক।

এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতে টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে এক ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করে রাস্তায় ফেলে দেন আসামিরা। নিহত ছাত্রীর ভাই পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে লাশের ছবি দেখে বোনকে শনাক্ত করেন। এ ঘটনায় করা মামলায় চার জন পরিবহন শ্রমিককে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চলন্ত বাসে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা অন্তত ৩৫-৪০টি। ভয়াবহ বিষয় হলো, এরমধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়! প্রায় ১২ শতাংশ দিনের বেলাতেই মাইক্রোবাস এবং বাসে সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

গত মে মাসে সাভার, নাটোর ও গোপালগঞ্জে পৃথকভাবে তিনটি বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। একই মাসে এ রকম আরও তিনটি ঘটনার কথা জানতে পেরেছে পুলিশ। সিলেট, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন মহাসড়কে ডাকাতির খবর সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরেই পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছিল। অথচ এসব ঘটনা প্রমাণ করে কোথায় যেন সবকিছু আটকে আছে। এ খাতে বিশৃঙ্খলার দায় সরকার এড়াতে পারে? তেমনি মহাসড়কের দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে পুলিশও কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না।

হাইওয়ের পুলিশের রাতের কার্যক্রমে মানুষের অসন্তুষ্টি দীর্ঘদিনের। কারণ, রাস্তায় তো পুলিশ দেখা যায় না। দু’একটি জায়গায় দেখা গেলেও পুলিশ নিরাপদ স্থানে থাকে। যদি মহাসড়কে অহরহ টহলে পুলিশ থাকতো তাহলে ডাকাতি থেকে শুরু করে এত অপ্রীতিকর ঘটনা কীভাবে ঘটছে?

মূলত কথা হলো, দীর্ঘদিন ধরে চলা অব্যবস্থাপনার কারণেই গণপরিবহন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। কোনও মালিক তাঁর বাসে ডাকাতি-ধর্ষণ হোক না চাইলেও মালিক-শ্রমিকদের এসব ঘটনার জন্য দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। মালিক-শ্রমিক সংগঠনে সরকারের লোক থাকে, তারা বেপরোয়া। একটি দুর্ঘটনার পর বাস মালিকদের কাছে শ্রমিকদের স্পষ্ট ডাটাবেজ পাওয়া যায় না।

তাই তো অপরাধ দমনে মালিক-শ্রমিকদের পাশাপাশি হাইওয়ে ও থানা পুলিশকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। হতে হবে জনবান্ধব।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের আগস্টের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। একটি নির্দেশনায় বলা হয়, গণপরিবহনে দৃশ্যমান দুটি জায়গায় চালক ও চালকের সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর ও মুঠোফোন নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এ নির্দেশনা পালন করা হচ্ছে না। তা নিশ্চিত করতে হবে।

সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতি, নারীদের ওপর পাশবিকতা বন্ধে সবার আগে পুলিশি তৎপরতা বাড়াতে হবে। রাতের বাসগুলো কাউন্টার ছাড়া কোথাও দাঁড়াতে পারবে না, এমন নির্দেশ দেওয়া প্রয়োজন। বাস ছাড়ার আগে প্রতিটি কাউন্টারে ভিডিও ফুটেজ রাখা বাধ্যতামূলক।

তাছাড়া প্রতিটি যাত্রীবাহী বাসে জরুরি সেবার সঙ্গে যুক্ত করে সুইচ স্থাপন করা যেতে পারে। এই সুইচে চাপ দেওয়া মাত্রই জরুরি সেবা দফতরে যানবাহনের লোকেশন নিশ্চিত হওয়া যাবে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পাশাপাশি অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে রাতে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিরোধে বাসে একাধিক চালক, সড়কে সাইন সিগন্যাল স্থাপন প্রয়োজন। অন্ধকার সড়কে সড়কে প্রাণহানি ঠেকাতে বিআরটিএ-পুলিশ মিলে আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বিশ্বাস করি।  

রাতের রাস্তা অন্ধকার হলেও নিরাপত্তা বেষ্টনীর কারণে যাত্রীরা যেন নিজেদের অনিরাপদ মনে না করেন। অন্ধকারের পথে যেন নিরাপত্তার আলো ছড়ায়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: ‘অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: ‘অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৮ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৮ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ