X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানবিকতার জন্য বাংলাদেশকে আর কত শাস্তি পেতে হবে?

শেখ শাহরিয়ার জামান
২৫ আগস্ট ২০২২, ১৬:৪৪আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২২, ১৬:৪৪
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখার জন্য ২০১৮ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফরকালে একজন বাংলাদেশি কূটনীতিক বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে মানবিকতা দেখিয়েছে, সেটির জন্য যেন দেশটিকে শাস্তি না দেওয়া হয়। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, একটি মানবিক ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার দায়িত্ব পালন করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন তাদের দায়িত্ব পালন করে। পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু শাস্তি এখনও শেষ হয়নি।

রোহিঙ্গারা এখনও তাদের আদি নিবাস রাখাইনে ফেরত যেতে পারেনি। কবে যাবে সেটির বিষয়েও রয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে কিন্তু এটি সমাধানের জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন সেটির দিকে নজর কম। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পড়েছে বিপদের মধ্যে। একদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারের বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় হচ্ছে অন্যদিকে তাদের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় হচ্ছে কক্সবাজারে। শুধু তাই না, রোহিঙ্গাদের কারণে গোটা অঞ্চলে বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি।

বর্তমান পরিস্থিতি

২০১৭-এর ২৫ আগস্টে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয় এবং তারা হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন ধরনের মানবিকতাবিরোধী অপরাধের শিকারে পরিণত হয়। এর ফলে ওই সময়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে। এর আগে থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। প্রতি বছর ৩০ হাজার নবজাতক জন্ম নেওয়ার কারণে এখন রোহিঙ্গা সংখ্যা ১২ লাখ হয়েছে।

সরকার এবং জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো কক্সবাজার ও ভাসানচরে তাদের দেখাশোনা করছে। এখন পর্যন্ত তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে দৃশ্যমান কোনও অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। একটি পাইলট প্রকল্পের অধীনে এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ২০২০ থেকে আলোচনা চলছে। এ বছর এটি করা সম্ভব হবে বলে অনেকে আশা পোষণ করছেন।

বাংলাদেশের ঝুঁকি

সম্পূর্ণ মানবিক কারণে অস্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল বাংলাদেশ। তখন ধারণা করা হয়েছিল তাদের দ্রুত ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে। এজন্য তিন মাসের মধ্যে তিনটি চুক্তিও হয় দুই দেশের মধ্যে। কিন্তু কোনও অগ্রগতি হয়নি এবং যতদিন যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকির আশঙ্কা তত বাড়ছে।

প্রথম অবস্থায় আর্থিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি বড় আকারে দেখা গেলেও এখন নিরাপত্তা ঝুঁকি বড় আকারে দেখা যাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং আশপাশের অঞ্চলে অপরাধের সংখ্যা এখন অনেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিচ্ছিন্ন রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা ক্যাম্পের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। শুধু তাই না, ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয় মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায়ের অভিযোগও আছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। ক্যাম্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। একই সঙ্গে নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত জনবলও ঝুঁকির মধ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

কয়েক হাজার হেক্টর বন বিভাগের  জমিতে রোহিঙ্গারা বাস করছে। এর ফলে কক্সবাজার অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই প্রভাব কাটিয়ে ওঠা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। আবার রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অসন্তুষ্টি বাড়ছে। কারণ, তাদের শ্রমবাজারে ভাগ বসাচ্ছে বিদেশিরা।

প্রত্যাবাসনে সমস্যা

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, বৌদ্ধ ভিক্ষু, গণতান্ত্রিক শক্তি এবং সাধারণ জনগণ সম্মিলিতভাবে কোনও বিষয়ে একমত হতে পারে না তাদের অভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে। কিন্তু একটি বিষয়ে তারা সবাই একমত এবং সেটি হচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনও অধিকার নেই। ওই জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের ঘৃণার মাত্রা এত বেশি যে গণতান্ত্রিক শক্তি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছে, তারাও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিলিটারি অভিযানকে সমর্থন করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সাফাইও গেয়েছে। অর্থাৎ এক কথায় তাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের কোনও আগ্রহ নেই, যেটি প্রত্যাবাসনে সবচেয়ে বড় বাধা।

দ্বিতীয় বড় সমস্যা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সমর্থনের অভাব। ২০১৮ সালে কক্সবাজার সফররত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ জনের প্রতিনিধি দলকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাদের ভেতরে কোন কোন দেশ প্রকাশ্যে ওই জনগোষ্ঠীকে ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে সম্বোধন করে থাকে। চীন ব্যতীত অন্য সব দেশের প্রতিনিধিরা বলেছিলেন তারা প্রকাশ্যে তাদের  ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে সম্বোধন করে থাকে। চীন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং ভেটো ক্ষমতার অধিকারী। এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদ কখনোই একমত হতে পারেনি।

তৃতীয়ত, বিভিন্ন ধরনের বৈশ্বিক সংকটের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা। ২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে যে রেজুলেশনটি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল সেখানে রোহিঙ্গাকে গৌণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই কারণে বাংলাদেশ ওই রেজুলেশনে ভোটদানে বিরত ছিল। এদিকে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি ও খাদ্য সংকটসহ অন্যান্য বিষয়ের কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুটি ক্রমেই পেছনে পড়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন দেশ ও মানুষের মনোযোগ হারাচ্ছে।

করণীয়

যেকোনও যুদ্ধে জেতার জন্য কৌশল নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছিল মিয়ানমারকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে ফেলার জন্য জনমত তৈরি করা। অন্য আরেকটি কৌশল ছিল আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নেওয়া এবং এর ফল হিসেবে রোহিঙ্গা গণহত্যাকে উপলক্ষ করে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এটি করার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গাদের সমস্যার একটি টেকসই সমাধান এবং তারা যেন আর বাংলাদেশে না আসে।  

মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনা অত্যন্ত শ্লথগতিতে চলমান রয়েছে। কিন্তু এ কারণে বাংলাদেশ হতাশায় পড়েনি এবং আলোচনা করার জন্য সরকার সবসময় প্রস্তুত রয়েছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সমর্থন পাওয়ার জন্যও চেষ্টা অব্যাহত রযেছে এবং সেটি সামনের দিনগুলোতে আরও বেগবান হবে বলে আশা করা যায়।

এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা হয়েছে এটি যদি ওই কোর্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে রোহিঙ্গাদের ওপর যারা নির্যাতন করেছে তাদের দায়বদ্ধতা তৈরি হবে, যা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও জোরদার করবে।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পরে ওই দেশের রাজনৈতিক শক্তির একটি অংশ রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে। এছাড়া ওই দেশের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীদের মধ্যে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। অন্যদিকে ১০ জাতির জোট আসিয়ানে ক্রমাগত গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে মিয়ানমার। এ প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কে ফাটল এবং আসিয়ানে ওই দেশ নিয়ে মতভেদকে বাংলাদেশ যদি নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করতে পারে তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও সহজতর হবে বলে মনে হয়।
 
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলা ট্রিবিউন
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ