X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়াদের শেষ বছরে সরকারের চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা

মোস্তফা হোসেইন
১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫:০৭আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫:০৭

বৈশ্বিক মহামারি করোনা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ প্রভাবিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুর্যোগ কাটিয়ে সরকার পঞ্চম বছরে পা দিয়েছে। দুটি মহাদুর্যোগের মধ্যেও ঈর্ষণীয় অর্জন আছে সরকারের। বৈশ্বিক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জও কম ছিল না সরকারের। সবই উৎরে যেতে পেরেছে নেতৃত্ব এবং নিষ্ঠার কারণে।মেয়াদের শেষ বছরে সরকার কি ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারবে? করোনার ধকল কাটাতে পারলেও যুদ্ধসংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগের মধ্যে দলটির প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করতে পারবে, সঙ্গত কারণেই বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

উন্নয়নযাত্রা অবিরাম ছিল এই সত্য স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয়—কয়েক বছরে যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, সাধারণ মানুষের জীবন ধারণে কাঁপন ধরিয়েছে।পঞ্চম বছরে এসেও সরকারকে মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ানো এবং দেশে উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া এই লড়াইয়ে সাফল্যের সম্ভাবনা নেই।বিষয়টি বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের জন্য এত সহজ নয়। একই কারণে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক এক শতাংশ। বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য একবারেই ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানোর পরও এখানকার মূল্যস্ফীতি হয়েছে সমহারে। প্রশ্ন হচ্ছে—চলতি বছর এর প্রভাব কেমন হবে।বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমার পরও বিপিসিকে বড় অংকের টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে বলে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তার মানে নিকট ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের মূল্য কমার কোনও সম্ভাবনা নেই। জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাস না করে উৎপাদনব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। সুতরাং সরকারের পক্ষে এই বছর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হিসেবেই থাকছে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম পথ হচ্ছে জনশক্তি রফতানি।বাংলাদেশ শুরু থেকেই অদক্ষ শ্রমশক্তির ওপর নির্ভরশীল।বিনামূলধনে এই আয়কে সমৃদ্ধ করার কার্যকর কোনও উদ্যোগ প্রকৃতপক্ষে এখনও নেওয়া হয়নি।প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এই খাতে অবস্থান টিকিয়ে রাখা কিংবা এগিয়ে যাওয়ার জন্য দক্ষ জনশক্তি গঠন করতে না পারলে এই খাতে মুনাফা ধরে রাখা কতটা সম্ভব হবে তা প্রশ্নবিদ্ধ। আর উদ্যোগ নিলেও এর সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে বেশ কিছুটা সময়।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে না পড়লেও বর্তমান অবস্থানকে আশাব্যঞ্জক বলতে অনেকেই নারাজ। বিশেষ করে যে মুহূর্তে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বিষয়টি চিন্তা করতে হয়, তখন সঙ্গত কারণেই বোঝা যায় চ্যালেঞ্জটি বেশ কঠিনই বটে।

তবে কিছু বিশ্লেষক অতীতকে বাদ দিয়েই মূল্যায়ন করেন এবং তারা বৈদেশিক মুদ্রার স্ফীত রিজার্ভকেই উন্নয়নের প্রধান সূচক মনে করে থাকেন। অর্থনীতির ছাত্র না হওয়ার পরও আমি বুঝতে পারি না—তাদের এই ভাবনার পেছনে যুক্তি কী। এখনও অন্তত ৫ মাসের আমদানি ব্যয়ের ক্ষমতা রয়েছে। তাহলে এই সমালোচনা কেন? তবে মেগা প্রজেক্টগুলো সম্পূর্ণ কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত কিছুটা টানাপোড়েন তো থাকবেই। কিন্তু এতটা নেতিবাচক অবস্থা কি রিজার্ভের ক্ষেত্রে? পদ্মা সেতুর বিনিয়োগের বিনিময় আসতে শুরু করেছে। কুড়িটি মেগা প্রজেক্ট চলমান, কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের অপেক্ষায়, মেট্রোরেলের আংশিক বিনিময় আসতে শুরু করেছে। তবে হ্যাঁ, প্রজেক্টগুলো সম্পন্ন করার জন্য চীন, ভারত ও রাশিয়া থেকে যে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তা পরিশোধের চাপ তৈরি হবে ২০২৪ থেকে। যার প্রস্তুতি নিতে হবে চলতি বছর থেকেই। সেই হিসাব নিশ্চয়ই সরকার করেছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বিদেশে অর্থ পাচার রোধ করা। অর্থপাচারের পথ রোধ করার ক্ষেত্রে বিগত সময়গুলোতে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি। একইভাবে বিদেশ থেকে কোনও টাকা ফেরৎ আনাও সম্ভব হয়নি এই পর্যন্ত।এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য পাচার রোধ করাটা জরুরি।

ওয়েজ আর্নারদের জন্য ২.৫% প্রণোদনা দেওয়ার সুফল এসেছে গত কয়েকবছর ধরে। কিন্তু এই সুফল পেতে হলে বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু ওয়েজ আর্নারদের মধ্যে এখনও হুন্ডি ব্যবহারের প্রবণতা স্পষ্ট।প্রণোদনার বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে বলে মনে করি।

আওয়ামী লীগ সরকার অগ্রসরমান দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য কুড়িটি মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে হাত দিয়েছে। যেগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি অনেক মজবুত হবে এমনকি সরকারের রূপকল্প বাস্তবায়নও সম্ভব হবে।সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে তারা আর কোনও বড় প্রকল্প হাতে নেবে না। অর্থনৈতিক সংকটকালে নতুন প্রকল্প হাতে না নেওয়া সুবুদ্ধির পরিচয় বহন করে। কিন্তু চলমান প্রকল্পগুলো চালিয়ে নেওয়াটা এই মুহূর্তে সরকারের জন্য এবং সম্পন্ন করাটা তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার পূরণেরও প্রমাণ দেবে।

সরকার বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেই শুরু থেকেই। আঙ্কটাড-এর প্রতিবেদন বাংলাদেশকে আশার আলো দেখায়। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব উদ্যোগের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা গঠনের বিষয়টি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। কোভিড মহামারির প্রথম বছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) বড় ধরনের পতন হলেও সেই ধাক্কা ভালোভাবে সামলে পরের বছরেই ‘ঘুরে দাঁড়িয়েছে’ বাংলাদেশ; এক পঞ্জিকাবর্ষে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ১৩ শতাংশ। আরেকটি তথ্যে দেখা যায়—বৈদেশিক বিনিয়োগের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।

কিন্তু এত সুসংবাদের পরও আমাদের সংবাদ পড়তে হয়-বৈদেশিক বিনিয়োগের উদ্যোগ ‘ঢাকা বিমান বন্দর’ পেরিয়ে ‘ঢাকা’ প্রবেশের পর থেকে ভাটা পড়তে থাকে। কোন কারণে এই ভাটা তা সবার জানা। সরকারের শুভ উদ্যোগকে বিমান বন্দর থেকে ঢাকায় পা রাখার পর পরই যদি বাধাগ্রস্ত হতে হয়, তাহলে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন কঠিন হতে পারে।

সাধারণত এ ধরণের দুর্যোগ থেকে উত্তরণের প্রথম ধাপ হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় অর্জন করা। আশার কথা বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন আশানুরূপ এখনও। সবচেয়ে বড় ধাক্কা সামলে নেওয়া সম্ভব এক্ষেত্রে। শুধু তাই নয় খাদ্য উৎপাদনের পরও কৃষক ভালো মূল্য পাওয়ায় তারা এবার খুশিতেই আছে। এক্ষেত্রে সরকারের সামনে সবুজ সিগনালই আছে।

সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের। আশানুরূপ অগ্রগতি হয়েছে এমনটা বলার কারণ নেই—যা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য যথেষ্ট। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠা এক দিনের বিষয়ও নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সিস্টেম পাল্টাতে হলে যে সময়  প্রয়োজন সেটা কিন্তু আমাদের হাতে নেই। কারণ উন্নত বিশ্বের তালিকায় বাংলাদেশের নাম ঢুকাতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অধিকতর মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

মোট কথা, আওয়ামী লীগ নির্বাচনি ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সামগ্রিক অর্থে বিবেচনা করতে গেলে তার অনেকটাই পূরণ হয়েছে। এখনও অনেকই বাকি রয়ে গেছে। হয়তো আগামী একবছরে বাকি অংশেরও অনেকটাই পূরণ হয়ে যাবে। আর নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে দেশ এগিয়ে যাক, যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই যেন এগিয়ে যেতে পারে সেই কামনা করতে পারি।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ